দ্বিতীয় নরক অথবা মধ্যদুপুর

মারিয়া সালাম

প্রকাশিত : নভেম্বর ১৪, ২০১৮

টুকটুকি তীব্র ব্যথায় ছটফট করছে, প্রসব ব্যথা। অন্ধকারে হাতরে কুপি বাতিটা খোঁজার চেষ্টা করতে করতে কিছু একটার সাথে হোঁচট খেয়ে মেঝেতে হুড়মুড়িয়ে পরল। হঠাৎ ব্যথাটা আর নেই, ঘরের ভেতরের অন্ধকার অনেকটাই কেটে গেছে। পায়ের কাছে সাদা বস্তামতো একটা কিছু, এটার সাথেই হোঁচটটা খেয়েছে কিছুক্ষণ আগে। আতংকে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে টুকটুকির। জিনিসটা কাফনে মোড়ানো লাশের মতো, একটা নবজাতকের লাশ হবে বড় জোর। কাঁপা কাঁপা হাতে মাথার দিকের কাপড়টা সরাতেই বাচ্চাটার মুখটা বেরিয়ে পরলো। টুকটুকি বেশ বুঝতে পারছে, এটা তার সদ্যজাত মেয়ের লাশ। গলা শুকিয়ে আসছে ওর, চিৎকার দিয়ে বাড়ির সবাইকে ডাকতে যেয়ে পারছে না, গলা দিয়ে একটাও শব্দ বের হচ্ছে না।

 

এপাশ ওপাশ ছটফট করে ও লাফিয়ে উঠে বসল মশারির ভেতরে, ঘরে সেই অন্ধকার। আতংকে সারা শরীর কাঁপছে ওর, ঘামে ভিজে জবজব করছে ব্লাউজটা, বুঝতে একটু সময় লাগলো ওর। এই দুঃস্বপ্নটা ও ইদানিং প্রায় দেখছে। আট মাস চলছে, আর বেশি সময় বাকি নেই, এ সময় এ রকম স্বপ্ন সবাই কম বেশি দেখে, তাই বলেছিল সালেমা কবিরাজ। একটা তাবিজও দিয়েছিল। গলায় হাত দিয়ে বুকটা ধড়াস করে উঠল, তাবিজ কই? আতিপাতি করে খুঁজতে গিয়ে পাশে শুয়ে থাকা আমজাদের গায়ে হাত পরে গেল।

 

কিরে হারামজাদি? আবার কি নাটক শুরু ক্যোরলি রাইতের বেলায় শুয়্যাও আরাম নাই তোর জোন্নে, শুয়োরের বাচ্চা, লাত্থি দিয়্যা বিদায় না করলে আমার নাম আমজাদ না। এসব কথায় টুকটুকির কিছু এসে যায় না এখন, বিছানা থেকে তাবিজটা কুড়িয়ে নিয়ে গলায় বাঁধতে বাঁধতে উঠে কলপাড়ের দিকে হাঁটা দিল ও। ফজরের আযান হয়ে গেছে। ওযু করতে হবে, নামাযে বসে পাঁচ ওয়াক্ত আল্লাহর কাছে খালি একটা দোয়াই করে যাচ্ছে আজ আট মাস ধরে, এবার যেন একটা ছেলে হয়।

 

এছাড়া এ বাড়িতে ওর আর থাকা হবে না এটা বুঝে গেছে ও। চাহিদা মতো যৌতুক দিতে পারে নি ভাইয়েরা, তারপরেও খুব একটা খারাপ ছিল না এ বাড়িতে। বিপদটা হয়েছে মেয়েটা হবার পরে। এখানে মেয়ে কেউ চায় নি, তারপর থেকে কথায় কথায় মার-গাল এসব প্রতি দিনের ব্যাপার। আল্লাহর কাছে তাই দিন রাত বলে যাচ্ছে, এইবার যেন ছেলে হয়।

 

আপনাখে আল্লাহর কিরা লাগে, আমাখে মেডিক্যালে লিয়্যা যান, সকাল থেকে এই একটা কথায় বলতে পারছে কষ্ট করে টুকটুকি। ক`দিন থেকেই স্বামী আর শাশুড়িকে বলে আসছিল, তার পেটটা ভার ভার লাগছে, যে কোন সময় ব্যথা উঠবে। তাতে কাউকে তেমন কোন গুরুত্ব দিতে দেখা যায় নি। আমজাদ তবু একবার ভেবেছিল হসপিটালে নেয়ার কথা। কিন্তু, ফিরোজা বেগমের এক কথা, আমরা যে বাড়িতে ছেল্যা জন্ম দিয়্যাছি, তো কি মোর‍্যা গেছি?

 

দাইকে বুলা আছে, অ্যাজ না হলেও কাল অ্যাস্যা পোরব্যে, তুই ওর কথায় কান দিস ন্যা, ছেলেকে বুঝায় ফিরোজা বেগম। আপনি ইকটু ভ্যান ডাকেন, চলেন মেডিক্যালে যাই, আমি মুনে হয় আর বাচপো না আম্মা, ব্যথার তীব্রতায় টুকটুকির গলার স্বর ক্ষীণ হয়ে আসে। রক্তশূন্য শরীরটা হলুদ হয়ে ফুলে উঠেছে, ঠোঁটগুলো নীল থেকে ক্রমশ গাঢ় নীল হয়ে উঠছে। ফিরোজা বেগমের এসব দেখে কিছুটা মায়া হল বলে মনে হল। এক বাটি গরম দুধ এনে খাইয়ে, মাথায় বাতাস করতে করতে বলল, চুপ কর বেহায়া মাগী। পাড়ার সব ভাতারকে জ্যানাতে হবে যে ওই ছেল্যা পয়দা করবে।

 

আজ সাত দিন হলো, মেয়েটার চেহারা দেখে না টুকটুকি। ওর দাদী সরিয়ে রেখেছে। আমজাদও কোন খোঁজ নেয় নি। শুনেছে, তাকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিবে। আপাতত, ওকে রাখা হয়েছে রান্না ঘরের পাশে যে কাঠখড়ি রাখার মাচা আছে তার নিচে। এই বাড়িতে থাকার সব অধিকারই সে হারিয়েছে। চল্লিশ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে বর্ষা কাদার দিনে দাই আসতে পারে নি। বাড়িতে ফিরোজা বেগম নিজেই অনেক চেষ্টা করেছে, তাতে শেষ রক্ষা হয় নি। জন্মের সময় বিলম্বিত প্রসবের জন্য ছোট মেয়েটা মারা গেছে, আর টুকটুকির ওপরে পড়েছে অভিশাপ। সে নিজেই জানে না, তার কি হয়েছে! প্রসবের রাস্তা দিয়ে অনবরত প্রস্রাব যাচ্ছে আর বাজে দুর্গন্ধে তার কাছে যাওয়া মুশকিল।

 

হারামজাদী, এমুন পাপ কোইর‍্যাছে, তার শাস্তি প্যাছে, ছি! ভাল মানুষ হ্যোলে এমুন হোত্যো না, ফিরোজা বেগম বারান্দায় বসে চিল্লে চিল্লে বলে। ওর পাপে ম্যায়েডাও মরা হইছে। মেয়ে ব্যাঁচা থ্যাকলেও ওখে র‍্যাখতাম না, আর এখুনতো এম্নিতেও র‍্যাখপো না, আমজাদ যেন নিজেকেই শোনায় কথাটা।

 

বাড়ির দুয়ারে রিকশা ভ্যান দাঁড়ানো, আজ টুকটুকিকে তার ভাইরা নিতে এসেছে। তাদের তেমন কোন ইচ্ছা ছিল না ওকে নিয়ে যাওয়ার কিন্তু, আমজাদের বিয়ে এই মাসে, তাই এলাকার লোকজনের চাপে বাধ্য হয়েই বোনকে তারা নিয়ে যাবে। তবে কথা হয়েছে, সাথে বড় মেয়েটাকে তারা নিতে পারবে না, সে বাপের সাথেই থাকবে। টুকটুকি এ কদিনে অনেক বার নিজে নিজে হিসাব মিলাতে চেয়েছে, এখন তার হাতে অফুরন্ত সময়। ঘরের কাজ নাই, নামায-রোজার বালাই নাই। সে খালি ভাবে, কিন্তু হিসাব কিছুতেই মেলে না, কোন পাপের শাস্তি এটা। যৌতুক দিবে বলে দিতে পারেনি ওর ভাইরা, সেটা কি বড় পাপ? আচ্ছা, যৌতুক চাওয়া কি পাপ না? মেয়ে জন্ম দেয়া তাহলে পাপ? তাহলে, সংসারে বউ আনা পাপ না?

 

এর চেয়ে বেশি ভাবতে পারে না, চিন্তা আটকে যায়। মাঝে মাঝে লুকিয়ে মেয়েকে দেখে আর বাড়ির কুকুরটার সাথে রাতে শুয়ে শুয়ে আপন মনে বিড়বিড় করে এ সব হিসাব মিলায়। যাবার সময় উঠানে বসে খেলা করা মেয়েটাকে শেষ বারের মতো কোলে তুলে আদর করতে যায় টুকটুকি। ফিরোজা বেগম তেড়ে আসে, খবরদার মাগী, ছেল্যার গায়ে হাত দিবি না। টুকটুকি সুবোধ মেয়ের মতো ভ্যানে উঠে বসে, চোখ ফেটে পানি গড়িয়ে পরলেও মুখে কিছু বলে না। ও এখন মৃত মানুষের মতো, কিছু বলা আর না বলা সমান। ভ্যান গাড়ি চলতে শুরু করে, পেছন থেকে মেয়েটা মা মা করে ডেকে উঠে।

 

মা আছেন, মা, পরিচিত ডাকটা কানে আসতেই টুকটুকি উঠে বসে চটের বিছানার উপরে। শীর্ণ শরীরে ভর দিয়ে কোন রকমে বের হয় গোয়াল ঘর থেকে। গত চল্লিশ বছরে এই গোয়াল ঘরেই কেটে গেছে তার জীবন। ঐ যে স্বামীর বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছে, সেই থেকে বাপের বাড়ির গোয়াল ঘরেই তার জায়গা হয়েছে। ভাবীরা বলেছিল, নামায প্যড়তে পারিস ন্যা, রোজা করিস ন্যা, আল্লাহ তুখে য্যা কুন দোযখে দিবে! তোর ভাইরা বুল্যা, তাও গুয়ালে থ্যাক্তে দিছে। 

 

এই বিশাল সময়ে পৃথিবীর অনেক কিছু বদলে গেছে। ফিরোজা বেগম মরেছে, আমজাদও মরেছে। মেয়েটার বিয়ে হয়েছে। ভাইদের কুঁড়ে ঘরের জায়গায় দালান উঠেছে। শুধু, তার জগতে কোন পরিবর্তন নেই। আসলে মৃত মানুষের জন্য পৃথিবীটা যেমন, তেমনই, আলাদা কিছু না। এই চল্লিশ বছরে, এই গরু-ছাগলের সাথেই তার জীবন কেটে গেল। কখনও কখনও গ্রামে অন্য বাড়ি গুলোতে বেড়াতে যেত প্রথম প্রথম। অনেকেই মুখের ওপরে মানা করে দিত, কেউ কেউ আকারে ইংগিতে বুঝিয়ে দিত, সে অভিশপ্ত, অচুৎ। কেবল, এই গরু-ছাগল গুলোই ছিল নির্বিকার, এই সহাঅবস্থানে কেবল ওদেরই কিছু যায় আসে না। 

 

মা, আপনি কেমন আছেন? টুকটুকির চোখ গুলো আবেগে টলমল করে উঠে, আঁচলের কোণায় চোখ মুছতে মুছতে বলে অনেক ভাল আছিগো বাবা। তুমি অ্যাসলে আমি ভাল হোয়্যা যাই, আমাখে লিয়্যা যাবা বুল্যাছিলা তুমার সাথে, অ্যাজ লিব্যা?  

 

তমাল ঘাড় নেড়ে বলে, হ্যা মা, আজকেই নিব। স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে অনেক ফিস্টুলা আক্রান্ত নারীকে সে সেবা দিয়েছে। কিন্তু, টুকটুকি বেগমের মতো হতভাগা একজনও দেখেনি। আঠারো বছর বয়সের এক তরুণী কেবল মাত্র অজ্ঞতা আর হিংসার শিকার হয়ে গোয়াল ঘরে ঠাঁই নিল আর সেখানে পার করে দিল জীবনে চল্লিশটা বছর! তমাল এই কেসটা খোঁজ পেয়েছে অনেক কষ্টে, টুকটুকির আসলে কি রোগ কেউ বলতে পারে নি তাকে। কেবলমাত্র আন্দাজের ওপরে, অনেক সাহস করে সে যোগাযোগটা করেছে। 

 

প্রথম দিকে টুকটুকি একদমই রাজি হয়নি চিকিৎসা নিতে, পরে অনেক বুঝিয়ে মেনে নিয়েছে। তার সমস্যাটা খুব অল্প, একটা সার্জারী করলেই ভাল হয়ে যাবে, অথচ এই সামান্য সমস্যার জন্য চল্লিশটি বছর একটা মানুষ গোয়ালে শুয়ে শুয়ে জীবন পার করে দিল! তমালের চোখ ভিজে আসে, মমতা নিয়ে টুকটুকির হাতটা ধরে তাকে রিকশায় তোলে। 

 

অপারেশনের পরে এক মাস হয়ে গেছে, টুকটুকি একদম সুস্থ এখন। মিশনারি হসপিটালের ফাদার স্যামসন আর তমাল দাঁড়িয়ে আছে টুকটুকির বিছানার পাশে। আজ তাকে বাড়ি নেয়া হবে। ভাইদের বাড়িতে মিশনের অর্থে একটা ঘর উঠানো হয়েছে তার জন্য, দেয়া হয়েছে সেলাই মেশিন আর নগদ কিছু টাকা, যেন সে নিজের মতো করে চলতে পারে।

 

আপনার মেয়েকে খুঁজে আমরা খবর দিয়েছি, সে আসবে আপনাকে নিতে, ফাদার স্যামসন একটা পরিতৃপ্তির হাসি দেয়। মা, বাড়ি গিয়ে সব আগে কি করতে মন চায়, তমালের চোখে মুখে দারুণ আনন্দ।

 

বাড়ি য্যায়্যা সব আগে অযু কোর‍্যা জায়নামাযে ব্যোসপো, আর নামায পোর‍্যা আল্লাহকে জিজ্ঞ্যাস ক্যোরবো, আমিতো চল্লিশ বছর তুমাখে ডাকি নিখো, তুমার কালাম হাতে ল্যিই নিখো, চল্লিশ বছরতো দোযখেই ছিল্যাম, তুমি আমাখে ত্যাহেলে এখুন কুন দোযখে ল্যিবা? টুকটুকি দ্রুত পায়ে বারান্দার দিকে এগিয়ে যায়, বাইরে তখন মাঝ দুপুর।

 

গল্পটি একজন ফিস্টুলা রোগীর জীবনের ওপরে লেখা। এদেশে এখনও প্রায় ২০,০০০ টুকটুকি বেগমেরা রয়ে গেছে।