দেশ-বিদেশের ঈদ
শামীমা জামানপ্রকাশিত : আগস্ট ১৩, ২০১৯
গতকাল পালিত হলো পবিত্র ঈদুল আজহা। এদিকে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে ডেঙ্গু। পথে পথে জীবাণু। দোকানে দোকানে বিষ। সেই বিষ কাড়ি কাড়ি টাকা দিয়ে লোকে কেনে। গৃহিণীরা সেই বিষ জাল দিয়ে আধেক করবে। গরম মশলা ঘি সহযোগে সেমাই রাঁধবে। রাস্তাঘাট গরুর মলমূত্রে সয়লাব করে দিয়ে ধনী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ কোরবানি দেবে। ঘরে ঘরে মাংস কাটাকাটি। গরিবেরা সেই মাংস কুড়াতে দল বেধে ছুটবে। তাদের দেখে দারোয়ানেরা গেট লক করে দেবে। তারা কিঞ্চিত চেষ্টা করে দু’তিন পিস মাংস সংগ্রহ করে অভিশাপ দিতে দিতে পরের বাড়ি ছুটবে। মহিলারা মেকআপ টিউটোরিয়াল মাথায় রাগে গজগজ করতে করতে মাংস ছেনবে। বেছে বেছে হাড় তেলগুলো বুয়ার জন্য তুলে রেখে এক ফাঁকে এসে ফেবুতে স্ট্যাটাস দিয়ে যাবে, ‘আমিই কি সেই ব্যক্তি যার কখনো কাজ শেষ হয় না।’
সারা বছর যেসব আত্মীয়র খবর নেই, সেসব আত্মীয় ফোন করে ঈদ মোবারক জানাবে। মন থেকে ভালবাসা জেগে উঠবে, আফটারঅল আজকের দিনে সব ভেদাভেদ ভুলে আত্মীয়ের খোঁজ নিতে হবে, কোলাকুলি করতে হবে। কোন কোন আত্মীয় কখন আসবে, মোটেও আসো না বলে বলে আহ্লাদ করবে আর ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে শুনিয়ে দেবে, অমুক সময় তো একটু বের হবো। ফেসবুকে মেহেদি রাঙা হাতগুলো দেখে কেউ দীর্ঘশ্বাস ফেলবে, ‘এত সময় কই পায় মানুষ!’ চ্যানেলগুলো একদিনের ঈদকে চুইংগামের মতো টেনে সাত দিন বানাবে। শত উপহাস তুড়ি মেরে মাহফুজ, হেলেনা তাদের সংগীত সম্ভার মেলে ধরবে। তাদের কাছাকাছি গলার কিছু গায়ক গায়িকাও চেচাতে থাকবে নানান ভঙ্গিমায়। তাদের তলব করে গোফে তা দিয়ে কেউ বলবে না, ‘চেচাইছিলি কেনে?’ সকলে মাহফুজ আর হেলেনার টিআরপি বাড়াবে।
তারপর আছে নাড়ির টান। বাপরে বাপ! এই নাড়ির টান সাংঘাতিক জিনিশ। সারা বছর যাই করুক ঈদে বাড়ি যেয়ে একসাথে ঈদ না করলে কিসের ঈদ! মরে ফুটে হলেও বাড়ি যেতে হবে। ভাগ্যক্রমে লঞ্চে ডুবে না মরলে বাড়ি পৌঁছাতে পারলে শান্তির দেখা মেলে। যে শান্তির খোঁজে একদিন সে বাড়িছাড়া হয়েছিল, শান্তির খোঁজে আবার তাকে সেই বাড়িতেই ফিরতে হয়।
এত গেল দেশের ঈদ। প্রবাসের ঈদ ব্যাচেলর জীবন আর মধ্যপ্রাচ্য হলে এক রকম। করুণ রসে সিক্ত। কিন্তু এই পশ্চিমা সমাজে ঈদ আসে খুশির বারতা নিয়ে। শহরের নানান জায়গায় অনুষ্ঠিত হয় ঈদের নামাজ। সে নামাজে পুরুষের পাশাপাশি মেয়েরাও সমান তালে অংশ নিচ্ছে। নামাজ শেষে জায়নামাজ হাতে আপিদের গ্রুপ ছবিতে ফেসবুক সয়লাব। আমাদের দেশে মেয়েদের মসজিদে যেয়ে নামাজ আদায়কে ভীষণভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়। বিষয়টা যেন হারাম। কোনো কোনো মসজিদের সামনে নারীর চলাচল নিষিদ্ধ লেখাও দেখা গেছে। এগুলো কতটা ধর্মের কতটা পুরুষতান্ত্রিক চাপানো, গবেষণার বিষয়। প্রবাসে এসবের বালাই নেই। প্রতিটা মসজিদেই নারী-পুরুষ সমান তালে নামাজ আদায় করছে আলাদা আলাদা জায়গায়। আমেরিকায় এখন ঈদে স্কুল ছুটি থাকে। কাজের জায়গাগুলোতে সে সুযোগ না থাকলেও সবাই ছুটি নিয়ে ঈদ উদযাপন করে। এই উদযাপন শুরু হয় ঈদের আগের রাত থেকে।
রোজার ঈদের চাঁদরাত কোরবানি ঈদেও চাঁদরাত রূপেই উদযাপিত হয়। নিউ ইয়র্কের বাঙালি পাড়াগুলো সরব হয়ে ওঠে বাঙালিদের পদচারনায়। জ্যাকসন হাইটস, জ্যামাইকার হিলসাইড এভিনিউ ও ব্রঙ্কসের পার্কচেস্টার সব জায়গার একই চিত্র। বাঙালির ভিড়ে গিজগিজ রাস্তা। থরে থরে জামাকাপড় আর মনোহরি জিনিশের পশরা সাজিয়ে ফেসবুকের লাইভ আপুরা ক্রেতা সামলাতে ব্যস্ত। চলছে মেহেদি উৎসব। গান, চটপটি আর ফুসকা। গরম গরম সিংগাড়া আর মজাদার চা খেতে ঢুঁ মারতে হবে হাটবাজার, খাবার বাড়ি কিম্বা প্রিমিয়াম সুইটসে। শেষ সময়ের কেনাকাটায় হাতের কাছেই রয়েছে মান্নান হালাল সুপার শপ, ইত্যাদি, আপনা বাজারের মতো বড় গ্রোসারি শপগুলো। রাত তিনটে অব্দি এই তামাশা চলে। এতরাতে বাসায় ফিরে আবার চুলে রঙ লাগিয়ে চুলায় ফিরনি, পুডিং, পায়েস হরেক রকমের রান্না চাপিয়ে এখানকার সুপার উইমেনরা দু’এক ঘণ্টা ঘুমিয়েই আবার সকালের নামাজ ধরতে উঠে পড়ে।
ব্যাস শুরু হয়ে গেল ঈদের দিন। এখানেও কোরবানি দেয়া হয়। গুলি করে নয়, হালাল উপায়ে জবাই হয়ে। তবে সেই মাংস প্রসেস হয়ে আসতে আসতে ঈদের পরের দিন দুপুর। প্রায় প্রতিটা মুসলমানের ঘরেই ডেজার্ট, এপেটাইজারসহ বিশ ত্রিশ পদের রান্না হয়। দলবেঁধে এক হয়ে চলে খাওয়া, আড্ডা আর এখানকার অবধারিত আয়োজন সংগীত সন্ধ্যা। সব বাড়িতেই ছোটখাট অনুষ্ঠান সারার মতো মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট থাকে। এখানে পার্টি হবে আর গান হবে না এমন খুব কম। জমজমাট আয়োজন শেষে মানুষ ঘরে ফেরে একরাশ উদ্যম আর বেঁচে থাকার দারুণ অনুপ্রেরণা নিয়ে।
তবে দেশের ঈদ আর প্রবাসের ঈদ যাই বলি, সত্যিকারের ঈদ ছিল শৈশবে। তারমানে কি এই যে, ঈদ মানে ছোটদের আনন্দ! মোটেই তা নয়। আজকালকার শিশুরা কি ঈদকে সেই আনন্দের উৎসব ভাবতে পেরেছে? কি দেশে কি বিদেশে এখনকার বাচ্চাদের কাছে ঈদ তেমন কোনো আনন্দের দিন নয়। পরিবারের চাপিয়ে দেয়া বিরক্তিকর ট্রাডিশান মাত্র। আমরা আমাদের সোনালি সময়ের শৈশবকে ওদের অবধি পৌঁছতে পারিনি।
লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক