দেবাশীষ তেওয়ারীর গল্প ‘অখিল অথবা আমি’
প্রকাশিত : জুলাই ২১, ২০২২
ধরি, এই গল্পের নায়কের নাম অখিল ঘোষ। সে ক্লাস থ্রিতে পড়ে। অষ্টমীর স্নানের দিন সে বাড়ির সকলের সাথে রিকশায় না গিয়ে বন্ধুদের সাথে তিন মাইল হেঁটে মেলায় যায়। দুপুরের দিকে স্নান সেরে তাদের বাড়ির মহিলারা রিকশায় বাড়ি ফিরে গেলেও থেকে যায় তার কাকা ও সে। কাকা তার বন্ধুদের সাথে বাড়ি ফিরবে আর সে বাড়ি ফিরবে তার বন্ধুদের সাথে।
দুপুর গড়িয়ে গেলে কাকা একটা তরমুজ কিনে ভাতিজাকে ধরিয়ে দিলেন। বললেন, আমার আইতে রাইত হইবো, যাওনের সময় তুই এই তরমুজটা লইয়া যাইস গা।
বিকেল বিকেল তরমুজ মাথায় নিয়ে একদল শিশুর সাথে সেই শিশুটি অষ্টমীর মেলা থেকে বাড়ি ফিরছিল। শিশুরা খুব ভালো করে না বুঝলেও তারা জানে তাদের দলে একজন হিন্দু আছে। একজন পেক দেওয়া শুরু করলো, হিন্দু হিন্দু কলার মুথা, গরু না খাইলে মারবাম জুতা। প্রথমে একজন তারপর সকলে। রাস্তা দিয়ে লোকেরা ফিরছিল। রিকশা-সাইকেল যাচ্ছিল এবং শেষবিকেলের রোদে রাস্তায় শুকোতে দেয়া খড় উল্টে দিচ্ছিল। সকলে ব্যাপারটা দেখছিল এবং অখিলের বেহাল অবস্থা দেখে সকলেই আনন্দে হাসছিল।
সহ্যের সীমানা ছাড়িয়ে যাচ্ছিল। বাড়ির কাছাকাছি এসে সেই ছেলেটি মানে অখিল ঘোষ মাথা থেকে তরমুজটা ফেলে দিয়ে সামনে যাকে পেল তাকে জাপটে ধরে মাটিতে পড়ে গেল। কিল-ঘুষি। তারপর সকলে মিলে একজনকে আচ্ছামতো কেলিয়ে ওখানেই ফেলে রেখে যায়। একরত্তি শিশু, তখনো জানে না এটা মুসলমানদের দেশ। শুধু শুনতে হয়, প্রতিবাদ করা যায় না।
সারা শরীরে আঘাতের চিহ্ন নিয়ে সেই আধাভাঙা তরমুজটি মাথায় নিয়ে আবার বাড়ি ফিরতে থাকে অখিল। বাড়ি থেকে আসা ছোট রাস্তাটি যেখানে বড় রাস্তায় এসে মিশেছে সেখানে আসতেই দেখে, বাড়ির মহিলারা সেখানে উদগ্রীব দাঁড়ানো। মা তাকে বুকে নেয়। কাঁদে হয়তো। এরই মধ্যে তাদের কানে এ খবর পৌঁছে গেছে।
রাতে অখিলের বাবা ফেরে অগ্নিশর্মা হয়ে। সেও পথেই শুনেছে, তার ওপর যে ছেলেটিকে অখিল মেরেছিল তার পরিবার এর বিচার চেয়েছে। বিচারের আগেই পিটিয়ে অখিলের বাবা অখিলের পিঠ লাল করে দেয়, কাঁচা কঞ্চির ২৩ জোড়া দাগ সেখানে, তারপর থেকে কেউ ‘হিন্দু হিন্দু কলার মুথা, গরু না খাইলে মারবাম জুতা’ বললেও অখিল শুধু চুপ করে থাকে।
তার মাস তিনেক পর একদিন অখিলের বাবা অখিলকে ডেকে বলে, চল রেডি হয়ে নে। তোকে কেলকাতা রেখে আসা হবে। সেখানে কেউ তোকে ‘হিন্দু হিন্দু কলার মুথা, গরু না খাইলে মারবাম জুতা’ বলতে আসবে না।
সেই থেকে অখিলের কোনও দেশ নেই। ভারত তার দেশ না, এটা বোঝার পর এসএসসি পরীক্ষার আগে আগে সে আবার বাংলাদেশে ফিরে আসে। পাঁচ বছরে দূরত্ব বাড়ে বাবার সাথে, ভাইবোনের সাথে, এমনকি মায়ের সাথেও। এই দূরত্ব তার আর ঘুচবে না কোনোদিন।
ওয়াজ মাহফিলের রাতগুলোতে সারারাত ভেসে আসে কাফির (হিন্দু), ইহুদি-খ্রিস্টান ফোবিয়া। জিহাদিদের জিহাদ চাই, অথচ ইহুদি-খ্রিস্টান কাফির (যদিও যাদের সাথে তাদের নবি যুদ্ধ করেছিল তারা কেউ বাংলাদেশের হিন্দু বা বৌদ্ধ পরিবার থেকে মক্কা মদিনায় গিয়ে যুদ্ধ করে আসে নাই) এই দেশে ত্যামন নাই। তাই জিহাদিদের সুন্নতি সওয়াব আদায়ের সবচেয় বড় টার্গেট গোষ্ঠী হিন্দু আর পাহাড়ে বৌদ্ধ ও আদিবাসীরা।
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েই ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া বা ল্যাটিন আমেরিকা কোথাও চলে যেতে চায় সে। বলা সহজ, কিন্তু দেশছাড়া কি এত সহজ? এত টাকা? আলু-পটল কলেজ থেকে ভালো রেজাল্টও খুব সহজ কিছু না। তাই দেশ ছাড়তে ছাড়তে তার চলে গেল আরও দশটি বছর।
যে ছেলেটি ভালো না বেসে চুমু খেতে পারে না, তার আরও পনেরটি বছর চলে যায় ‘কোথায় আমার দেশ’ খুঁজে খুঁজে।
অখিল এখন পঁয়তাল্লিশ। সে জানে, তার কোনও দেশ নেই। দরকারও নেই কোনো। আপসোসও নেই। কারণ সে জানে, পৃথিবী অনেক বড়। মানুষ ও মনুষ্যত্ব বাদে ঈশ্বরের যত গল্প তা আসলে ঈশ্বরের ছদ্মবেশে শয়তান বলে গিয়েছিল, আর রুহানি সন্তান শুধু ঈশ্বরের নয়, শয়তানেরও আছে।
পৃথিবীজুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে শয়তানের সেই সব সন্তানেরা। আর কয়টা যুদ্ধ দরকার ওদের? কত হত্যা আর? এসব নিয়ে ভাববার ভাবনারও তেমন সময় নেই আর অখিলের। দু’দণ্ড বসলে কোথও পিঠের ব্যথাটা জেঁকে আসে। ঘুম পায়।