
দীপাবলি প্রতিটি মেয়ের অনুপ্রেরণা
মো. খালিদ সাইফুল্লাহ ফয়সলপ্রকাশিত : জুলাই ২৯, ২০১৮
স্বাধীনতা-উত্তর বাঙালি জীবনে স্বাধিকার অর্জনের লক্ষ্যে পৌঁছনোর প্রয়াসে মেয়েদের সাধ, সংকল্প ও সংগ্রামের এক জীবন্ত ধারাবাহিক ছবি ফুটিয়ে তোলার জন্য অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে সমরেশ মজুমদারের সুদীর্ঘ, সুকল্পিত, সুবিন্যস্ত এই উপন্যাস ‘সাতকাহন’। ‘সাতকাহন’ উপন্যাসটি শুরু হয় নিজস্ব এক কেন্দ্রীয় চরিত্র নিয়ে, যে সাহসী ও স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত এক মেয়ে। নাম দীপাবলী। যার নামের মধ্যে নিহিত অন্ধকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আভাস। নিয়ত সংগ্রামরতা প্রতিমার মতো সেই মেয়ে দীপা, আর চালচিত্রে একের পর এক বর্ণাঢ্য ছবি। উত্তরবাঙলার চা-বাগান, গাছগাছালি আর আংরাভাসা নদী দিয়ে সে চালচিত্রের সূচনা। ক্রমান্বয়ে ফুটে ওঠে পঞ্চাশ দশকের কলকাতা ও শহরতলি, কো-এডুকেশন কলেজ, ছাত্র আন্দোলন ও রাজনৈতিক পটভূমি। সর্বভারতীয় কর্মজীবনের পরিবেশ ও প্রতিকূলতার জীবন্ত চিত্রাবলি।
সমরেশ মজুমদার দীপাবলীর সাথে পরিচয় দেন এক সন্ধে নামা মুখে, যখন আকাশে ভয়ঙ্কর মেঘ করেছে। দীপা দাঁড়িয়ে আছে কদম গাছের নিচে। মনে তার ভয়, সন্ধে হয়ে এলো। এখনো সে বাড়ি ফিরতে পারেনি। সেই ডুয়ার্সের চা বাগান, গাছগাছালি, বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট্ট নদীটার উপর রাতের জোনাকির খেলা, চাঁপার ঘ্রাণ আর খুব ভোরে শিউলি কুড়ানো দীপার গল্প যেন প্রকৃতির মাঝে বেড়ে ওঠা প্রতিটি মেয়ের গল্প। মায়ের চোখরাঙানি, পিটুনি, ঠাকুরমার নিষেধ উপেক্ষা করে বারবার খোলা মাঠে ছুটে যাওয়া, পথ-ঘাট পেরিয়ে কখনো ফুল কুড়োতে, তো কখনো বড়শি নিয়ে বন্ধুদের সাথে মাছ ধরতে যাওয়া। অদ্ভুত প্রাণ শক্তিতে ভরপুর এক মেয়ে সে। তার বন্ধু খোকন আর বিশু। কোনো মেয়ে বন্ধু নেই তার। তাদের সাথে হৈচৈ করতে দেখলে মা-ঠাকুরমা রেগে ওঠেন। কেন মা-ঠাকুরমার বিপত্তি তার মেয়ে হয়ে বাইরে যাওয়ায়, তা দীপা বোঝে না। খোকন, বিশুরা ফড়িং বা মাছ ধরতে যেতে পারলে সে পারবে না কেন? ওরা হাঁটুর উপরে প্যান্ট পরলে কোনো দোষ নেই - অথচ দেয়াল টপকে পার হতে, গাছে উঠতে বা কোছা ভরে ফুল কুঁড়োতে তার যদি একটু হাঁটু বের হয়েই যায়, তাতেই বা তার কি দোষ?
এরকম নানা প্রশ্ন তাকে তাড়া করে বেড়ায় প্রতিনিয়ত। তারপর সেই চঞ্চল মেয়েটির জীবনে ঘটে যায় এক ভয়ঙ্কর ঘটনা। অপরিণামদর্শী জীবন তার ভাগ্যে রেখে যায় বিধবার কালো দাগ। তবুও তীব্র প্রাণ শক্তির জোরে জীবনের এই নির্মম অধ্যায় মুছে ফেলে সে শুরু করতে চেয়েছে নতুন জীবন। পুঁজি ছিল প্রতিকূলতায় হার না মানা তার দৃঢ় মনোবল। কঠোর পরিশ্রমে গড়ে নিতে চেয়েছে নিজের ভাগ্য। সাথে তার স্রোতের মতো গতিশীল মনে ঝড় তুলত নানা প্রশ্ন, যার উত্তর সে পায়নি কারো কাছে। বিধবারা পেঁয়াজ, ডিম, মাছ-মাংস খেলে কি হয়? কেন মেয়েদের পদে পদে কঠোর অনুশাসনের মধ্যে না চললে নরকবাসী হতে হবে? এই কঠিন নিয়মগুলোর বিরুদ্ধে এভাবে তার ভেতরে ফুটে ওঠে প্রতিবাদী স্বাধীনচেতা এক রূপ। দীপাবলী এমন এক চরিত্রের নাম, যাকে ভাগ্যদেব সুপ্রসন্ন হয়ে কখনো নিরবিচ্ছিন্নভাবে কিছু দেয়নি।
বেঁচে থাকার জন্য, সমাজে নিজের জায়গা করে নেয়ার জন্য যাকে প্রতিটি মুহূর্ত লড়ে যেতে হয়েছে। কখনো পারিপার্শ্বিকতার সাথে, তো কখনো নিজের সাথে। কঠোর পরিশ্রমে অর্জন করে নিয়েছে আয়করের চাকরি, সম্মান, প্রতিষ্ঠায় বেছে নিয়েছে জীবনসঙ্গী। তারপরেও তার লড়াই থামেনি। জীবনের সর্বোচ্চ সম্মানের পর আত্মমর্যাদা ও আদর্শের লড়াইয়ে নামতে হয় তাকে। কাছের মানুষের আত্মকেন্দ্রিক লোভি চেহারাগুলো তাকে ক্ষতবিক্ষত করলেও নিজের নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে সে থেকেছে অনড়। তবুও কি পেয়েছে সে জীবনের শেষে? অনেক সংগ্রাম, অনেক ব্যর্থতা, অনেক না পাওয়া কষ্টানুভূতির পরও দীপাবলি প্রতিটি মেয়ের অনুপ্রেরণা। প্রকৃতি শ্রেণিকাঠামো বা ছেলে-মেয়ের মধ্যে তার অকৃত্রিম রং-রূপ-রস ঢেলে দিতে বাছবিচার করে না। আমাদের দীপাবলীর বন্ধু খোকন আর বিশু ছেলে, তাতে কি! ওদের কাছেও তো আঙরাভাসা নদীটা নীল আর চা বাগানগুলো সবুজ, একই রঙ একই গন্ধ। তাহলে কেন মা-ঠাকুমার যত বিপত্তি তার মেয়ে হয়ে বাইরে যাওয়ায়। এরকম চারপাশের প্রকৃতির প্রতি একটি শিশুর সরল-সহজাত আকর্ষণ, আর পদে পদে বাধা পেয়ে অন্ধকারে নিত্য আলোর শিখা খুঁজতে থাকার মতোই তার ছোট মনে দানা বেঁধে উঠতে থাকা মেয়েদের উপর সমাজ আরোপিত নানা বিধিনিষেধের প্রতি প্রশ্ন। কেন মেয়েদের পদে পদে কঠোর অনুশাসনের মধ্যে না চললে ভগবানের কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে?
ধর্মের এই একচোখা নিয়মগুলোর বিরুদ্ধে এভাবেই তার ভেতরে ফুটে ওঠে প্রতিবাদী স্বাধীনচেতা এক রূপ। দীপাবলী এমন এক চরিত্রের নাম, যাকে ভাগ্যদেব সুপ্রসন্ন হয়ে কখনো নিরবিচ্ছিন্নভাবে কিছু দেয়নি। কেন দীপাবলীর মতো এমন একটি চরিত্রটি তার মনে এলো এ প্রশ্নের উত্তরে সমরেশ বলেছিলেন, “আমি এগারো বছর বয়সের একটি বিধবা মেয়ে দেখেছিলাম। সে আমাদের চা বাগানের। তাকে দেখে আমার মনে হয়েছিল এত সুন্দর, কোমল, নিষ্পাপ একটি মেয়ে কেন এভাবে হারিয়ে যাবে? শেষ হয়ে যাবে? সাতকাহন লেখার সময় সেই মেয়েটিকেই আমি আমার মতো করে রূপ দিয়েছি। তাকে সমাজ, সংসারের বেড়াজালের ভেতর দিয়ে আমি পরিপূর্ণ মানুষ করে তুলতে চেয়েছি।”
দীপাবলীর একা থেকে যাওয়াটা অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি, এব্যাপারেও লেখকের বক্তব্য স্পষ্ট, “বাংলাদেশের মেয়েরা যে আতত্মমর্যাদা সম্পন্ন, এটা আমাদের শ্রদ্ধার সঙ্গে মনে রাখা দরকার।” নিজের ব্যক্তিগত পাঠ প্রতিক্রিয়া যদি বলতে থাকি তবে সত্যিকার অর্থে আজ পাঠকদের বিরক্তি এসে যাবে। সাতকাহন নিয়ে কিভাবে, কি ইঙ্গিতে, কি সুরে লিখবো তা এক কথায় আমার কাছে দুশ্চিন্তা ও ভয়ের কারণ
সমরেশ মজুমদার জন্মগ্রহণ করেন বাংলা ১৩৪৮ সনের ২৬শে ফাল্গুন, ১০ মার্চ ১৯৪২। তার শৈশব কেটেছে ডুয়ার্সের চা বাগানে। প্রথম উপন্যাস ‘দৌড়’ ছাপা হয় দেশ পত্রিকায় ১৯৭৬ সালে। তিনি শুধু তার লেখনি গল্প বা উপন্যাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি। ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী থেকে কিশোর উপন্যাস লেখায় তার জুড়ি মেলা ভার। কলকাতা তথা বাংলার সর্বকালের অন্যতম সেরা লেখক হিসাবে তিনি পাঠকমন জয় করেন।