দীনেন্দ্রকুমার রায়ের রহস্যগল্প ‘জাল ডিটেকটিভ’
প্রকাশিত : আগস্ট ২৬, ২০২০
রহস্যকাহিনি লেখক দীনেন্দ্রকুমার রায়ের আজ জন্মদিন। ১৮৬৯ সালের ২৬ আগস্ট তিনি জন্মগ্রহণ করেন। মারা যান ১৯৪৩ সালের ২৭ জুন। তিনি নদীয়ার মেহেরপুরের বাসিন্দা ছিলেন। তার পিতার নাম ব্রজনাথ রায়। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে তার রচিত গল্প ‘জাল ডিটেকটিভ’ পুনর্মুদ্রণ করা হলো:
চাকরির উপর আজীবনকাল আমার ঘৃণা। বাবা বিস্তর অর্থব্যয় করিয়া আমায় কিঞ্চিত লেখাপড়া শিখাইয়াছিলেন; অনেক টাকা মূল্যে কয়েকখানা মূল্যহীন সার্টিফিকেট ক্রয় করা গিয়াছিল; আমি বি. এ.। বাবার ইচ্ছা আমি ডিপুটি ম্যাজিস্টরি পরীক্ষা দিয়া মফস্বলের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হইয়া বসি} ডেপুটিগিরির সুখ আমার জানা ছিল; এক দিকে জেলার ম্যাজিস্টর, অন্যদিকে সেসন জজ, এই দুই নৌকায় পা দিয়া অনেক ডেপুটির প্রাণ ওষ্ঠাগত হইয়া উঠে; শ্যাম ও কুল এ উভয়ই মধ্যে মধ্যে অরক্ষণীয় হয়। বি. এল. পাশ করিয়া মুন্সেফি লাভ হইতে পারে, কিন্তু আমার ততদূর উৎসাহ ও অধ্যবসায় ছিল না। …ওকালতির ঝঞ্ঝাট অনেক। আমি স্থির করিলাম, যাহাতে স্বাধীনতা আছে, সেই রকম কোন কাজে লিপ্ত হইব; “বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী: -” আমি লক্ষ্মী লাভের আশায় বাবার ব্যবসায়ে যোগ দিলাম।
বাবা তখন খাণ্ডোয়ায় তুলার কারবার করিতেন। কারবারে বেশ লাভ ছিল। আমি খাণ্ডোয়া হইতে বোম্বে যাইতেছিলাম; বোম্বের প্রসিদ্ধ গুজরাটি বণিক মানিকচাঁদ রতনচাঁদের সঙ্গে ভাগে সেখানে একটা ‘এজেন্সি’ খুলিবার সংকল্প ছিল। ফাল্গুন মাসের রাত্রি। রাত্রি নটার পর মেলট্রেনে আমি একটা সেকেণ্ডক্লাস কম্পার্টমেন্টে উঠিয়া পড়িলাম। ট্রেন ধূম্র উদ্গীরণ করিতে করিতে শত দীপ দীপ্ত বেগে দক্ষিণ-পশ্চিম মুখে ছুটিয়া চলিল। একটু শ্রান্তি দূর হইলে আমি গ্ল্যাডস্টোন ব্যাগটায় ঠেস দিয়া সেই প্রভাতের একখানি প্রভাতী সংবাদপত্র পাঠ করিতে লাগিলাম; এঙ্গলো ইণ্ডিয়ান মহাশয়েরা আমাদের নেটিভদের প্রতি যে একটু ঘৃণা মিশ্রিত ব্যঙ্গোক্তি প্রয়োগ ক্রেন, তাহা উপেক্ষণীয় হইলেও, তাহার সহিত পরিচয় রাখা অকর্তব্য নহে।
দেখিলাম, গাড়িতে আর দুইজন আরোহী রহিয়াছেন, দুজনই মারাঠা যুবক; একজনের পাগড়িটা গদির উপর পড়িয়া আছে; মাথার চারিদিকে সমান করিয়া কামানো, টিকিটা গোছা করা মস্ত লম্বা, চীনেদের মতো বেণী পাকানো নয়; বৃহৎ চন্দন চিহ্ন তখনও কপাল হইতে বিলুপ্ত হয় নাই; গায়ে একটা লম্বা কোট। যুবক একবার মুখ তুলিয়া স্বপ্নাবিষ্টের ন্যায় আমার মুখের দিকে চাহিলেন; নীল চশমার সোনার ফ্রেম উজ্জ্বল গ্যাসালোকে ঝকমক করিয়া উঠিল। তাহার পর তিনি পূর্ববৎ বাহিরের ‘চন্দ্রমাশালিনী যা মধু যামিনীর’ দিকে চাহিয়া রহিলেন। আর একজন যুবক সাহেবি পোশাক পরা; তিনি নিবিষ্টচিত্তে একখানা ইংরেজি খবরের কাগজ পড়িতেছিলেন; বাঁশের সংক্ষিপ্ত সংস্করণের মতো মোটা একটা বিকটাকার চুরুট জ্বলিয়া জ্বলিয়া কুণ্ডলীকৃত ধূম্র উদগীরণপূর্বক সাহেবের সংবাদপত্রে মনঃসংযোগের পরিচয় প্রদান করিতেছিল।
লোক দুইজন আমার সমবয়স্ক বলিয়া বোধ হইল। আমি বাঙালি মানুষ; গাড়িতে নতুন লোক দেখিলেই ফস করিয়া বলিয়া ফেলি, মশায়ের কোথায় যাওয়া হইবে? নিবাস এবং বাপের নাম জিজ্ঞাসা করা অনেক দিন ‘আউট অব ফ্যাশন’ হইয়া গিয়াছে; ‘এটিকেট’ আইন জারি হইয়া নিবাস ও বাপের নাম প্রভৃতি অনেক শ্লীল জিনিস অশ্লীলের মতো পরিত্যক্ত হইয়াছে। ইউরোপে, যাহাদের গৃহ এবং পিতার নাম উভয়েরই অভাব আছে, তাহাদের কাছে এরূপ প্রশ্ন অত্যন্ত অশ্লীল কৌতূহল বলিয়া পরিগণিত হইতে পারে। কিন্তু আমরা এখন সাহেব হইয়াছি।
সুতরাং আমি চুপ করিয়া কাগজই পড়িতে লাগিলাম। অনেকক্ষণ পর, যে যুবকটি কাগজ পড়িতেছিলেন, তিনি তাঁহার কাগজখানা হাতে লইয়া উঠিয়া আসিলেন; ইংরাজিতে বলিলেন, “মশায় আমায় এক্সকিউজ করিবেন; আপনার কাগজখানা বোধ করি পড়া হইয়াছে; আমরা পরস্পর কাগজ বদলাইতে পারি কি?”
আমি হাসিয়া বলিলাম “অনায়াসে”– মুহূর্ত মধ্যে তাঁহার Bombay Herald নামক সংবাদপত্র আমার হাতে আসিল, আমার প্রভাতী কাগজ লইয়া তিনি স্বস্থানে গিয়া বসিলেন।
কাগজখানা হাতে লইয়াই দেখিলাম এক কোণে একটা নীল পেনসিল দিয়া ইংরাজিতে লেখা আছে, আমি বোম্বের একজন ডিটেকটিভ; আমাদের অন্য সহযাত্রীটি বিট্টলরাও খারে। আপনি জানে খারে কে? তাহাকে গ্রেপ্তার করিবার জন্য বোম্বে ওয়ারেণ্ট রহিয়াছে; কিন্তু সেখানে পঁহুছিবার পূর্বেই ইহাকে গ্রেপ্তার করা আবশ্যক। আপনার সাহায্যের প্রয়োজন হইবে; বরহাউপুরের ‘রিফ্রেশমেন্ট রুমে’ এ সকল কথা হইবে।”
বিট্টলরাও খারে। বোম্বের প্রসিদ্ধ জহরত ব্যবসায়ী সাপুরফি জাহাঙ্গীরজির দোকান হইতে বিশ হাজার টাকা দামের একখানি হীরক যে চুরি করিয়াছে? চুরি, বাটপাড়িতে বোম্বে অঞ্চলে সে সময় কেহই বিট্টলরাওর সমকক্ষ ছিল না। আমার সঙ্গেও কিছু টাকাকড়ি ছিল; ভাবিলাম আচ্ছা বদমাইশের সঙ্গে এক গাড়িতে উঠা গিয়াছে। মনটা বড়ই অপ্রসন্ন হইল, কাগজে মনঃসংযোগ করিতে পারিলাম না।
দুই একবার বক্রদৃষ্টিতে বিট্টলরাওর দিকে চাহিলাম। প্রায় একমাস হইতে সে সতর্ক পুলিশের চক্ষে ধূলি নিক্ষেপ করিয়া বেড়াইতেছে; তাহার সঙ্গে সঙ্গে যে ডিটেকটিভ ঘুরিতেছে, হয় তো সে তাহার কিছুই জানে না; কিন্তু তাহার চক্ষে চশমা, মুখে একটুও উদ্বেগের চিহ্ন ধরিতে পারিলাম না। সংবাদপত্রে তাহার কথা লইয়া হুলুস্থূল পড়িয়া গিয়াছি; এমন কি আমি যেদিনের কথা বলিতেছি, সেদিনও Bombay Herald-এ তাহার সম্বন্ধে একটা প্যারা দেখিলাম; পুলিশের কর্তব্য কার্যে শিথিলতা দেখিয়া সম্পাদক মহাশয় অনেক আক্ষেপ করিয়াছেন।
রাত্রি সাড়ে দশটার সময় ট্রেন স্টেশনে পহুঁছিল; পাঁচ মিনিট এখানে গাড়ি থামিবে। এখানে রিফ্রেশমেণ্ট রুমে না জানি কি দায়িত্বভার ঘাড়ে পড়িবে। আমি ভারি চঞ্চল হইলাম। গাড়ি প্ল্যাটফর্মে দাঁড়াইতেই সেই Bombay Herald-খানা পকেটে ফেলিয়া আমি ভোজনগৃহে প্রবেশ করিলাম; অনতিবিলম্বে ডিটেকটিভ মহাশয় আমার সঙ্গে যোগদান করিলেন।
ডিটেকটিভ যুবক অতি নিম্নস্বরে বলিলেন, “খুব সাবধান। যাহাতে আসামির সন্দেহ হয়, এমন কোন ব্যবহার করিবেন না। এখন পলাইলে তাহাকে গ্রেপ্তার করা কঠিন হইবে। ভুসাওয়াল স্টেশনে বোধ হয় তাহার কোন বন্ধু আসিয়া জুটিবে; সে জব্বলপুর হইতে টেলিগ্রাম করিয়াছে খবর পাইয়াছি।”
“তাহা হইলে এখন কি করা কর্তব্য?” আমি এই কথা জিজ্ঞাসা করিলাম।
“বদমাইশের দল বৃদ্ধি হইবার আগেই তাহাকে আটক করা দরকার; ট্রেনে উঠিয়াই ইহাকে বাঁধিয়া বেঞ্চির নীচে ফেলিয়া রাখা যাইবে। তাহার পর ভুসাোয়ালে যদি তাহার কোন বন্ধু আসে, তাহার গতিবিধির দিকে দৃষ্টি রাখিয়া আবশ্যক হইলে তাহাকেও ‘এরেস্ট’ করিবার ব্যবস্থা করিব। আমি জানি না, বামাল কাহার কাছে আছে। এই বামালের জন্যই আমাদের অধিক চেষ্টা।” আমি বললাম, “যদি এ গাড়িতে অন্য প্যাসেঞ্জার উঠে, তাহা হইলে তো আমাদের কাজের ব্যাঘাত জন্মিতে পারে।”
ডিটেকটিভ উত্তর দিলেন, “এ গাড়িতে অন্য লোক উঠিবে না, আমি তাহার বন্দোবস্ত করিয়াছি। আর সময় নাই, আমি চামড়ার একটা স্ট্র্যাপ কিনিয়া লই, বাঁধিতে দরকার হইবে; লোকটা ভারি জোয়ান। দরকার হইলে সাহায্য করিবেন।”
আমি হাসিয়া বলিলাম “অবশ্য।” ব্যাপারটা ক্রমে রোমান্টিক হইয়া উঠিতেছিল; এ যে আস্ত একখানা উপন্যাস।
ট্রেন ছাড়িবার ঘণ্টা পড়িল। আমরা প্ল্যাটফর্মে বাহির হইয়া আসিলাম; গার্ডকে জিজ্ঞাসা করিলাম “ট্রেন ভুসাওয়ালে ক’টার সময় পৌঁছিবে?”
গার্ড বলিল, “বারোটা পাঁচ মিনিট।” বুঝিলাম নিশীথ রাত্রে, এই দ্রুতগামী মেল ট্রেনের মধ্যে উপন্যাসের আর এক পরিচ্ছেদ আরম্ভ হইবে।
বিট্টলরাও প্ল্যাটফর্মে পদচারণা করিতেছিল। ট্রেন ছড়িবার সময় গাড়িতে লাফাইয়া উঠিল। ডিটেকটিভ ও আমি উভয়ে তাড়াতাড়ি একবার দৃষ্টি বিনিময় করিলাম। আমার বুকের মধ্যে ধপ ধপ করিতে লাগিল; একটি একটা ছোটখাটো যুদ্ধ ব্যাপার উপস্থিত হইবে। আমি ভালো করিয়া বিট্টলরাওর সর্বাঙ্গ দেখিয়া লইলাম; জোয়ানটি বড় কম নয়। ডিটেকটিভ লোকটা ক্ষীণকায়, আমিও তথৈবচ, দুজনে তাহাকে পারিয়া উঠা দুষ্কর।
ট্রেন ছোট ছোট গোটা দুই তিন স্টেশন পার হইয়া গেল। ডিটেকটিভ একমনে খবরের কাগজ পড়িতেছিলেন’ সহসা তিনি উঠিয়া দাঁড়াইলেন’ পকেট হইতে একখানা রুমাল বাহির করিয়া মুখ মুছিলেন; তাহার পর জানালার কাছে আসিয়া এক লাফে বিট্টলরাওর বক্ষের উপর চাপাইয়া দিলেন। বিট্টলরাও তাড়াতাড়ি তাহার দক্ষিণ হস্ত পকেটে ফেলিবে, এমন সময় ডিটেকটিভ আমাকে বলিলেন – “শিগগির আসুন, রাসকেলের হাত দুখানা আটকাইয়া ফেলুন।”
আমি মুহূর্ত মধ্যে দৃঢ়বলে তাহার উভয় হস্তের মণিবন্ধ চাপিয়া ধরিলাম। দেখিতে দেখিতে ডিটেকটিভ মহাশয় পকেট হইতে আর একখানা রুমাল বাহির করিয়া বিট্টলরাওর মুখ ঢাকিয়া ফেলিলেন, রুমালে অত্যন্ত উগ্র ক্লোরোফর্মের গন্ধ। বিট্টলরাও প্রায় এক মিনিট কাল আপনাকে মুক্ত করিবার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করিল; তাহার পর ক্লোরোফর্মে অভিভূত হইয়া অজ্ঞান হইয়া পড়িল। ডিটেকটিভ বলিলেন, “নির্বিঘ্নে কার্যোদ্ধার হইয়াছে। আপনি ঠিক সময়ে আমাকে সাহায্য না করিলে নিশ্চয়ই ও পকেট হইতে রিভলভার বাহির করিয়া আত্মরক্ষায় প্রবৃত্ত হইত। জানালা খুলুন, শীঘ্র খুলুন, নতুবা ক্লোরোফর্মের গন্ধে আমরা আবার এখনই অজ্ঞান হইয়া পড়িব।”
তাই তো; আমার মাথাটাও ঘুরিয়া উঠিয়াছিল; উৎসাহ ও উত্তেজনায় এতক্ষণ এ কথা মনেই ছিল না। আমি এক লাফে গাড়ির জানালা দরজা খুলিয়া দিলাম। গাড়ির মধ্যে নৈশ বায়ুর অবাধ প্রবাহ আরম্ভ হইল।
ডিটেকটিভ বলিলেন, “আপনি আজ আমার যে উপকার করিলেন, চিরদিন তাহা মনে থাকিবে; আপনার যদি আপত্তি না থাকে, তবে আমার উর্ধতন কর্মচারীর নিকট আপনার এই সহায়তার উল্লেখ করিতে পারি।”
আমি আমার নাম বলিয়া বলিলাম, “যদি আপনার কিছু কাজ করিয়া থাকি, সে কথা লইয়া আন্দোলন না করাই আমার কাছে ভালো বোধ হয়।”
ডিটেকটিভ অন্য প্রসঙ্গ তুলিলেন; বলিলেন, “আমাদের তস্কর বন্ধুকে আর এ ভাবে এখানে ফেলিয়া রাখা সম্ভব নয়; আসুন ধরাধরি করিয়া ইহাকে বেঞ্চির পাশে নামাইয়া রাখা যাক।”
বিট্টলরাও তখনও অজ্ঞান; তাহাে নীচে নামাইয়া ফেলিলাম; ডিটেকটিভ তাঁহার কালো ব্যাগটা তাহার মাথার নীচে বালিশের মতো স্থাপন করিলেন। গাড়ির বাহির হইতে যাহাতে সহসা কাহারও তাহার প্রতি নজর না পড়ে, এজন্য একখানা কম্বল টাঙ্গাইয়া তাহাকে আমরা আড়াল করিয়া রাখিলাম।
আমি বলিলাম, “চেতনা পাইলেই রাসকেল চেঁচাইতে আরম্ভ করিবে।” ডিটেকটিভ হাসিয়া বলিলেন, “তাহারও ব্যবস্থা হইবে, আমি উহার মুখ বাঁধিয়া দিতেছি। আপনার কোন ভয় নাই।”
রাত্রি বারোটার পর ট্রেন ভুসাওয়াল স্টেশনে পৌঁছিল। দেখিলাম প্ল্যাটফর্মে সকলের আগে একজন মধ্যবয়স্ক মারাঠা পুরুষ দাঁড়াইয়া আছে; ভারি জোয়ান, গালপাট্টা, চোখ দুটো গোলাকার, দুটি ভাঁটার মতো, মাথায় প্রকাণ্ড পাগড়ি, সোনালি আঁচলাটা স্টেশনের তীব্র আলোকে ঝকঝক করিতেছে।
চক্ষুর নিমিষে আমার দিকে চাহিয়া ডিটেকটিভ মহাশয় বলিলেন, “এ সেই, বিট্টলরাও যাহাকে টেলিগ্রাম করিয়াছিল। আপনি গাড়ির মধ্যে কিছুকাল অপেক্ষা করুন, আমি এ কামরা গার্ডকে বলিয়া রিজার্ভ করিয়া লইতেছি; এ লোকটা ইহার মধ্যে প্রবেশ করে এরূপ আমার ইচ্ছা নয়।”
ডিটেকটিভ নামিয়া গেলেন। চোরের সঙ্গে একাকী গাড়িতে বসিয়া রহিলাম। তাহার মুখটি বাঁধা বটে, কিন্তু যে রকম টানিয়া টানিয়া সে নিশ্বাস ফেলিতেছিল, তাহাতে তাহার শীঘ্রই চৈতন্যোদয় হইবে বলিয়া বুঝিতে পারিলাম। মনটা ভারি অপ্রসন্ন হইয়া উঠিল।
প্রথম ঘণ্টা পড়িল; আমি ডিটেকটিভকে দেখিবার জন্য প্ল্যাটফর্মে নামিয়া পড়িলাম; গার্ডের গাড়ির কাছে গিয়া তাঁহাকে পাইলাম না; এদিক ওদিক চারিদিক খুঁজিলাম, লোকটার কোন খোঁজ পাইলাম না। ঠং ঠং করিয়া গাড়ি ছাড়িবার ঘণ্টা পড়িল, গার্ড বাঁশিতে ফুঁ দিল; আমি দ্রুতবেগে আসিয়া গাড়িতে উঠিলাম।
গাড়ি ছাড়িয়া দিল। এতক্ষণ দেখি নাই, সেই জমকালো পাগড়িওয়ালা জোয়ান লোকটা এই গাড়িতেই উঠিয়াছিল। কি সর্বনাশ! সে এক লাফে আমার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল; অমার মুখের উপর একটা পাঁচনলা পিস্তল উঁচু করিয়া ধরিয়া বলিল, “স্থিরভাবে বসিয়া থাক, নড়িয়াছ কি মরিয়াছ।”
আমার ডিটেকটিভ বন্ধু গাড়িতে নাই; আমি নিরস্ত্র একা, সম্মুখে এই দুর্জয় জোয়ান সশস্ত্র, পাশে অর্ধচেতন বিট্টলরাও। মেলট্রেন নক্ষত্র বেগে ছুটিয়া চলিয়াছে। বুঝিলাম আর রক্ষা নাই। সমস্ত গাড়িখানা আমার চক্ষুর উপর ঘুরিতে লাগিল; নত মস্তকে মুক্তির উপায় চিন্তা করিতে লাগিলাম। মুক্তিলাভ অসম্ভব। তুলার ব্যবসায়ে লিপ্ত হইয়া কেহ এ পর্যন্ত বোধ করি এমন বিপদে পড়ে নাই বিধাতার বিড়ম্বনা।
আমাকে চিন্তামগ্ন দেখিয়া আগন্তুক বিকট হাসি হাসিয়া বলিল, “বৃথা চিন্তা; নিজে যে ফাঁদ পাতিয়াছ, তাহারই মধ্যে পা পাড়িয়াছে। এখন আমি যাহা বলি শুন, অন্যথা করিলে মাথার খুলি এক গুলিতে উড়াইয়া দিব। আমার বন্ধুর মাথার দিকটা ধর, তাহাকে উপরে তুলিতে হইবে। পলায়নের চেষ্টা করিও না।”
আমি জড়ের ন্যায় তাহার আদেশ পালন করিলাম। বিট্টলরাওর চৈতন্যোদয় হইল; সে শুইয়া শুইয়া দুই হাতে চক্ষু মুছিতে লাগিল। আগন্তুক বলিল, “কেমন আপাজি, বেশ সুস্থ হইয়াছ তো?”
আপাজি কি বিট্টলরাওর আর এক নাম? আপাজি উত্তর করিল, “কে ভাস্কর? তুমি আসিয়াছ, বদমায়েশেরা কি ভাগিয়াছে?”
“না একজন জালে পড়িয়াছে, আর একজন সরিয়াছে।”
আপাজি উঠিয়া বসিল। তাহার পর জিজ্ঞাসা করিল, “কিরূপে পলাইল? পলাইবে ভাবিয়াই আমি তোমাকে অনেক আগে লোকজন সঙ্গে লইয়া স্টেশনে উপস্থিত থাকিতে বলিয়াছিলাম।”
ভাস্কর বলিল, “আমি প্রথমে তোমাকে দেখিতে না পাইয়া কিছু আশ্চর্য হইয়াছিলাম; সহজেই বুঝিয়াছিলাম, বদমাশ বিট্টলরাও তোমার উপর কোন রকম কৌশল খাটাইয়াছে! শেষে আমি যখন এই গাড়িতে তোমার অবস্থা দেখিলাম, তখন বড়ই ব্যস্ত হইয়া পড়িলাম। ইত্যবসরে আসামি কিরূপ সরিয়া পড়িল বুঝিলাম না; তাহার সঙ্গী গাড়ি ছাড়িবার সময় আসিয়া আপনি ধরা দিয়াছে।”
আমার কপালে ঘর্মবিন্দু ফুটিয়া উঠিল। আপাজি কি বিট্টলরাও নহে? ইহাদের কথার কোন মর্ম গ্রহণ করিতে না পারিয়া আমি হতবুদ্ধির ন্যায় বসিয়া রহিলাম; বুঝিলাম ভিতরে একটা ভয়ানক রহস্য লুকানো রহিয়াছে।
কিন্তু আর চুপ করিয়া থাকা চলে না। আমি আমার সহযাত্রীদ্বয়কে সম্বোধন করিয়া বলিলাম, “মহাশয়, আমি বুঝিতেছি, আমি কি একটা বিষম ভুল করিয়া বসিয়াছি। আপনারা কে?”
ভাস্কর বিদ্রূপপূর্ণ স্বরে বলিল, “আমরা যে হই, সে খোঁজে আবশ্যক? তোমার ভুল শীঘ্রই ভাঙ্গিবে। তোমার নাম কি?”
অন্য সময় হইলে হয় তো এরূপ অভদ্র প্রশ্নের উত্তর দিতাম না। কিন্তু তখন এ অপমানও পকেটস্থ করাই সঙ্গত বোধ হইল। আম ইনাম ও নিজের ব্যবসায়ের পরিচয় দিলাম।
ভাস্কর বলিল, “ও তো গেল নকল পরিচয়, আসল পরিচয় দাও। দেখিতেছি তো বাঙালি, বিট্টলরাওর সঙ্গে কতদিন জুটিযাছ? অনেক বাঙালি আমাদের এ অঞ্চলে আসিয়া কেবল নিজের মুখে কালি লেপিয়া বেড়ায়, তুমিও তাহাদের একজন। চোরা মাল কোথায়?”
এবার আমার বড় রাগ হইল; বলিলাম, “তোমাদের এই রকম অভদ্র আচরণের প্রতিশোধ দিতে হইলে জুতা মারিয়া গাড়ির বাহিরে ফেলিয়া দেওয়াই উচিত। ভদ্রলোকের কাছে চোরা মালের কথা জিজ্ঞাসা করিতে প্রত্যেক ভদ্রলোকেরই লজ্জা হইয়া থাকে।”
আপাজি বলিল, “ভদ্রলোককে হঠাৎ ক্লোরোফর্ম দ্বারা অজ্ঞান করিয়া ফেলিতে ভদ্রলোকের লজ্জা হয় না?” – আপাজির স্বর গম্ভীর।
আমি বলিলাম, “সে ক্লোরোফর্ম আমি দিই নাই, ডিটেকটিভ দিয়াছিল। বদমাশকে বাঁধিবার জন্য আমি তাহাকে সাহায্য করিয়াছিলাম মাত্র; আমার বিশ্বাস ভদ্রলোকেই এরূপ কাজ করিতেন।”
“ডিটেকটিভ? কোন ডিটেকটিভ?”
“আমার সহযাত্রী বন্ধু, যিনি জব্বলপুর হইতে আসিতেছিলেন।”
আমি বলিলাম, “হাঁ, তুমি যাহাকে আপাজি বলিতেছ, ডিটেকটিভ আমাকে বলিয়াছে সে স্বয়ং বিট্টলরাও; তাহাকে বাঁধিবার জন্য ডিটেকটিভ আমার সাহায্য লইয়াছিল; এখন তাহাকে পলাইতে দেখিয়া আমার মনে নানা সন্দেহ হইতেছে।”
আপাজি বলিল, “জাল ডিটেকটিভ! সে নিজেই বিট্টলরাও। আমি তাহাকে গ্রেপ্তারের জন্য তাহার সঙ্গ লইয়াছি; চোরা মাল তাহার সঙ্গে আছে জানি। পথের মধ্যে একা গোলযোগ করিলে তাহা হাতছাড়া হইতে পারে বলিয়া আমি ভাস্করকে টেলিগ্রাম করিয়াছিলাম। পথিমধ্যে তোমার প্রিয় বন্ধু বোধকরি তাহা বুঝিয়া এই রকম করিয়া আমাদের চোখে ধূলা দিয়া পলাইয়াছে। যাহা হউক, তোমাকে এখন প্রমাণ করিতে হইবে তুমি প্রকৃত ব্যবসায়ী, জাল ডিটেকটিভ সহচর নও।”
জাল ডিটেকটিভের স্বহস্তে নোট করা সেই Bombay Herald তখনও আমার পকেটে ছিল; আমি তাহা বাহির করিয়া আমার সহযাত্রীদ্বায়কে সেই নোট দেখাইলাম।
আপাজি বলিল, “এ যথেষ্ট প্রমাণ নহে; তোমার নির্দোষিতার সন্তোষজনক প্রমাণ না দেখাইলে অব্যাহতি লাভের আশা নাই। তোমার ব্যাগ খোল।”
আমি তাড়াতাড়ি ব্যাগ খুলিতে গেলাম। উঠিয়া ব্যাগটা হাতে করিয়া তুলিয়াই তাহা নীচে ফেলিয়া দিলাম – আমি বসিয়া পড়িলাম!
আমার সর্বনাশ হইয়াছে! আমার ব্যাগটা জাল ডিটেকটিভ হাতে করিয়া সরিয়া পড়িয়াছে, তাহার ভিতর যে পাঁচ হাজার টাকার নোট ছিল!
আপাজি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে চাহিয়া আবার বলিল, “একবার প্রতারণা করিয়াছ, দ্বিতীয়বার আমাদের চোখে ধূলি দেওয়া অসম্ভব।”
আমি বলিলাম, “এ ব্যাগ আমার নহে, জাল ডিটেকটিভের। আমার ব্যাগটা সে কখন লইয়া সরিয়া পড়িয়াছে দেখি নাই; আমার পাঁচ হাজার টাকা গিয়াছে।”
আপাজি বলিল, “এ বিট্টলরাওর ব্যাগ! – দেখি” – সে তৎক্ষণাৎ একটা রিং সন্নিবদ্ধ এক তাড়া চাবি বাহির করিয়া তাহার একটা দিয়া ব্যাগ খুলিয়া ফেলিল। কতকগুলি কাগজপত্র উল্টাইতেই সেই চোরা হীরকখণ্ড বাহির হইয়া পড়িল। তাহাতে গ্যাসালোকরশ্মি নিপতিত হইয়া আমার ভীতিবিস্ময়সমাকূল চক্ষে প্রতিফলিত হইতে লাগিল।
আমি স্তব্ধভাবে বসিয়া রহিলাম।
ব্যাগ বদলানোটা বিট্টলরাওর জ্ঞাতসারে, কি অজ্ঞাতসারে হইয়াছে আমি বুঝিতে পারিলাম না। বোম্বে আসিলে আমাকে লইয়া পুলিশে একবার টানাটানি করিয়াছিল। সহজেই আমার নির্দোষিতা প্রমাণ হইল; বিচারক আমার বুদ্ধিবৃত্তির প্রতি অশেষ দোষারোপ করিয়া আমায় মুক্তিদান করিলেন।
তাহার পর বিট্টলরাওর আর কোন সন্ধান পাওয়া যায় নাই। যথাসময়ে সাপুরজি জাহাঙ্গীরজি তাঁহার হীরক ফিরিয়া পাইলেন। পাঁচ হাজার টাকা খোয়াইয়া আমার কেবল।