দিনেমারদের শহর কোপেনহেগেন .................... ছবি: সংগৃহীত
দিনেমারদের শহর কোপেনহেগেন
ছাড়পত্র ডেস্ক:প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২৪
দিনেমারদের দেশে প্রথম যেদিন নামবেন, সেদিনই হয়তো ভালোবেসে ফেলবেন। এখানকারই এক আশ্চর্য শহর এই কোপেনহেগেন। নীল সাগরের তীরের এই শহর বিকালের সোনা রোদে কেমন প্রাণোচ্ছল হয়ে ওঠে! সুইডেনে আসার এক মজার ব্যাপার হলো, একই সীমান্তে সুইডেন ও ডেনমার্কের মেলবন্ধন। উপমহাদেশে সীমান্ত এলাকাজুড়ে যেমন আতঙ্ক এখানে যেন তার উল্টোরূপ। এই বৈচিত্র্য আপনায় মুগ্ধ করবেই। হয়তো ওরেসুন্ড সেতুর মাধ্যমেই কোপেনহেগেনের দিকে যাত্রা শুরু করতে পারেন। এই ষোলো কিলোমিটার দীর্ঘ সেতুর যাত্রাটিও চমৎকার। ভীষণ বাতাসে গাড়ির জানালা খোলা যাবে না। দুদিকে অনন্ত জলরাশি।
উন্মত্ত হাওয়ার আঘাত কেমন জানালায় কড়া নেড়ে যায়। একটু মনোযোগ দিয়ে তাকাতেই দূরে উইন্ডমিলের সারি দেখা যাবে। সুইডেন ঘুরতে এলে তাই ডেনমার্কে ঘুরে আসার সুযোগটা থেকেই যায়। সুইডেনে এসে ডেনমার্কের প্রতি এত টান থাকবে কেন? সাগরের তীরে দিনেমারদের দেশের প্রতি এত আগ্রহ কেন? একবার এখানে আসুন। লুন্ড শহর এক সপ্তাহ ঘুরুন। দেখবেন অদেখা ঐ দেশের প্রতি আগ্রহ ক্রমাগত বাড়তে থাকবে। সীমান্তের বাধা নেই। থাকবে অমোঘ আকর্ষণ।
লুন্ডে আসার সময় গাড়িতে এলেও কোপেনহেগেন যাবেন ট্রেনে। ওরেসুন্ড সেতু পাড়ি দেওয়ার সময় এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা হবে। রেলপথে প্রবেশ করবেন ঐতিহ্যমন্ডিত নগরী কোপেনহেগেনে। স্টেশনে ঢুকতেই চমক অপেক্ষা করছে। আকারে বিশাল এক স্টেশন। সাবেকি ইউরোপীয় স্থাপত্যশৈলী। ইতিহাস সম্পর্কে খুব জানাশোনা না থাকলেও এই স্থাপত্যশিল্প যে বহু পুরোনো তা ঠিকই আন্দাজ করতে পারবেন। অথচ পুরো স্টেশন আধুনিক সুযোগ-সুবিধায় ঘেরা। চারদিকে সংস্কৃতি ও রুচির ছাপ। বাহুল্য নেই দেখে স্বাভাবিক লাগে। স্টেশন চত্বরেই দেখা মিলবে কিওরিউর দোকান।
এখানে ড্যানিশ সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ আছে। সাহিত্যপ্রেমীরা চাইলে উল্টেপাল্টে দেখে নিতে পারেন। চারপাশেই ড্যানিস সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের সুস্পস্ট ছাপ। এছাড়াও এখানে রয়েছে বড় টুরিস্ট অফিস। আর আছে ছোট-বড় নানা ধাঁচের বাছাই করা দোকান। স্টেশনের বাইরে এসে দাঁড়ান। ঠিক উল্টোদিকে নজর কাড়বে টিভলিকোর্ট নামের বিনোদন পার্ক। কোপেনহেগের সবচেয়ে পুরনো ও বিশাল এই পার্ক ছোটবড় মানুষের আনন্দে কলরব। বলা হয় এটি বিশ্বের দ্বিতীয় প্রাচীন বিনোদন পার্ক। এমনিতে দিনের বেলা ভীড় কিছুটা ম্রিয়মান থাকলেও রাতে যেন অন্য রূপ ধারণ করে পার্কটি। কিন্তু পার্কে পড়ে ঘোরা যাবে। এবার ট্যাক্সি চেপে কোপেনহেগের প্রাণ নিহাভেনে পৌঁছাতে হবে।
শীতের দেশ কোপেনহেগেন। দিনের বেলা তবুও ঝকঝকে আকাশ কাচামিঠে রোদ বিকিরণ করবে। নিহাভেনে এই রোদের নিচে মানুষের ঢল দেখতে সুন্দর। সাপ্তাহিক ছুটির দিন এখানে অনেক মানুষ ভিড় করেন। সচরাচর ট্যাক্সি নিহাভেনে আপনায় এক বিস্তৃত চৌকো বাঁধানো উঠোনে রেখে যাবে। বিশাল উঠোনই বলতে হয়। পর্তুগীজরা পাথর বসানো এই উঠোনকে বলে প্রাসা। পাথর বসানো এই চত্বর ইউরোপের সাবেকি সংস্কৃতির অংশবিশেষ। ইউরোপের প্রায় প্রতিটি শহরের প্রাচীন ধাঁচে সাজানো ওল্ড টাউন স্কোয়ারে এই উঠোন দেখা যাবে। এখানে কোনো গাড়িঘোড়া চলাচল করে না। মানুষ হাঁটাহাঁটি করে। দেখে হয়তো ভাববেন, দেখো দেখি! আমার দেশে তো ফুটপাতেই হাঁটা যায় না। আর এখানে কিনা...সে যাহোক। প্রতি সপ্তাহান্তে এখানে নানা উইকেন্ড ফেয়ার ও স্ট্রিট শো-এর আসর বসে। প্রাসায় দাঁড়ালেই অনেক কিছু দেখতে পাবেন। এখানে ছোট ছোট হস্তশিল্প ও কিউরিওর দোকান সেজে উঠে। পাথরের চত্ত্বরে এক রঙিন পরিবেশ। আয়ত চত্ত্বরের বাইরে রাস্তায় অবাধে গাড়ি ছুটে চলেছে। এখানে মানুষের ঢলের যে চিত্র, তা আপনাকে মুগ্ধ করবেই।
চত্ত্বরে কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি ও দোকান-পাট দেখা শেষে চলে আসুন নিহাভেন কিংবা নিউ হার্বারে। এখানে বোট স্টেশন থেকে নৌকা ধরতে পারবেন। এই নামটি দিয়েছিল দিনেমাররা। সেই মধ্যযুগের প্রাক্কালে তারা এই নামকরণ করেন। তখন জায়গাটি ছিল জলদস্যুদের আখড়া। এখানে একদিকে মাছ চাষ করতেন স্থানীয়রা এবং অন্যদিকে জলদস্যুরা লুটের মালামাল জমা করতেন। জলদস্যুরা লুট নিয়ে হার্বারে এলেই বারবণিতার ঢল নেমে যেত। সুরার ফোয়ারা, নাচ-গানে মুখর হয়ে উঠতো নিহেভান। অবশ্য সময় অনেক বদলেছে। পনেরো শতকের দিকে কোপেনহেগেন ডেনমার্কের রাজধানী ঘোষণার পর অনেককিছু বদলাতে শুরু করে। জলদস্যুরা আগের মতো এখানে জড়ো হওয়ার আশ্বাস পায়নি। পরিবর্তন যেমনই হোক, নিহাভেন কিন্তু তার জৌলুস হারায়নি। হ্যাঁ, তার সাজ-সজ্জা কিছুটা বদলেছে। ব্যাস, ওইটুকুই।
বোট স্টেশনে টিকিট কেটে জেটির ধারে অপেক্ষা করুন। এই ফাঁকে চারপাশে মাথা ঘুরিয়ে প্রাচীন স্থাপত্যশৈলীর বাড়িগুলো দেখে নিন। সাবেকি ড্যানিশ বাড়ির মডেলগুলো বেশ চমকপ্রদ। ভেতরে নানা রঙের খোপকাটা। যাহোক, বেশ শক্তপোক্ত এক নৌকা একটু পরই এসে থামতে জেটিতে। প্রায় পঞ্চাশজন একসাথে ভ্রমণ করতে পারে এই নৌকায়। বড়সড় নোউকায় পাতা আছে শক্তপোক্ত চেয়ার। মাঝখানে আছে টেবিল এবং হাত বাড়ালেই অথৈ সাগরের নীল জল স্পর্শ করতে পারবেন। সাগরের বুকের এই অভিযানে তরুণী এক গাইড আপনাদের সঙ্গ দেবে। নিহেভানের বর্ণনা কতটা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সে দিচ্ছে দেখে অবাক হবেন আপনিও। দেখবেন বিখ্যাত রূপকথাকার হ্যান্ড ক্রিস্টিয়ান অ্যান্ডারসনের তিনটি বাড়ির আস্তানা।
একসময় খাড়িপথ ছেড়ে বোট মিশে যাবে সাগরে। জলে ভরা দিগন্তে আপনায় স্বাগতম। ঝকঝকে আকাশের নিচে ঘন নীল জলরাশি আর সমুদ্রের ঢেউ খুব কাছ থেকে ছলাৎ ছলাৎ করে বুকের কাছে এসে লাগে। ক্ষণিকের জন্য নিজেকে কুলহারা মনে হবে। ভেলার তরে অকূল পাথারে। মাঝে মধ্যে অবশ্য দু একটা ইমারত চোখে পড়বে। গাইড এক নিওক্ল্যাসিকেল শৈলীর লাইব্রেরির দিকে আপনার মনোযোগ আকর্ষণ করবে। এমন অপরূপ পরিবেশে মন স্থাপত্য দেখে ঈর্ষা হবে খুব।
কিছুক্ষণ নীলে ভেসে ভেসে একসময় বোট প্রবেশ করবে খাড়ির মধ্যে। প্রথমেই এক পুরোনো গীর্জা দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। চারপাশে ছোট ছোট হাউজ বোট দেখা যাবে। কোপেনহেগেনের এক বিরাট অংশজুড়ে দ্বীপ ও জলঢোকা খাড়ি। এই পথেই লিটল মারমেইডের প্রতিমূর্তিটা দেখতে পাবেন।
বোটট্রিপ শেষে ঘুরতে যাবেন কোপেনহেগের আরেক বিস্ময় রোজেনবার্গ ক্যাসেল। আরে বাবা। বিরাট প্রহরা এখানে। ক্যাসেলের ভেতর ঘুরে দেখার স্লট আছে। নিরাপত্তা বেশ জোরদার। তাতে একটু বিরক্ত হলেও ভেতরে ঢুকে মুগ্ধ হবেন। অপরূপ পরিখা কাটা জলাশয় ও মেডস ঘেরা নিখুঁত বাগান দিয়ে সাজানো এক নান্দনিক খোলা আঙিনার মধ্যে দাঁড়ানো বিশাল প্রাসাদগৃহটি মন ভোলায়। উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা তার সীমানা। বাইরের সামান্য আওয়াজও এসে ঢোকে না ভেতরে। বোঝাই যায় না বাইরে দুর্দমনীয় বেগে ছুটছে জীবন, ক্লান্তিহীন ভাবে ছুটে চলেছে মানুষ ওই আধুনিকা ড্যানিশ রাজধানীতে।এখানে তাড়াহুড়ো করে সব দেখতে হবে। তবে কোপেনহেগেন ভ্রমণের সময় এই জায়গাটিতেই ছেদ টানতে হবে। অতীত ও ঐতিহ্যের টানাপড়েনের মধ্যেই একসময় বের হয়ে আসবেন রোজেনবার্গ ক্যাসল থেকে।