দার্শনিক গোবিন্দ চন্দ্র দেবের আজ জন্মদিন

ছাড়পত্র ডেস্ক

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০১, ২০২৫

দার্শনিক গোবিন্দ চন্দ্র দেবের আজ জন্মদিন। সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার লাউতাতে ১৯০৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তার জন্ম। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পাকিস্থানি সৈন্যরা তাকে হত্যা করে।

তার পূর্বসূরীরা ছিল উচ্চগোত্রীয় ব্রাহ্মণ, যারা গুজরাট থেকে সিলেট এসেছিল। পিতার মৃত্যুর পর জিসি দেব স্থানীয় মিশনারীদের তত্ত্বাবধানে বড় হন। শৈশবেই তিনি মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

তিনি ১৯২৫ সালে বিয়ানীবাজার উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে প্রথম বিভাগে এন্ট্রাস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। কলকাতার রিপন কলেজ থেকে তিনি ১৯২৭ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

তিনি ১৯২৯ সালে সংস্কৃত কলেজ থেকে ব্যাচেলর অব আর্টস এবং ১৯৩১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন শাস্ত্রে মার্স্টাস সম্পন্ন করেন। জিসি দেব ১৯৪৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

ড. জিসি দেব কোলকাতা রিপন কলেজের শিক্ষক হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু করেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন সময়ে রিপন কলেজ কলকাতা থেকে দিনাজপুর স্থানান্তরিত হলে তিনিও কর্মসূত্রে দিনাজপুর আসেন। কিন্তু যুদ্ধ শেষে রিপন কলেজ পুনরায় কলকাতায় স্থানান্তরের সময় তিনি দিনাজপুরে থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নেন এবং সুরেন্দ্রনাথ কলেজের (বর্তমানে দিনাজপুর সরকারি কলেজ) প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেব যোগ দেন।

পরবর্তীতে ১৯৫৩ সালের জুলাইয়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। তিনি পূর্বতন ঢাকা হলের (বর্তমান শহীদুল্লাহ হল) হাউস টিউটর হিসেবে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন, পরবর্তীতে একই বছর তিনি জগন্নাথ হলের প্রভোস্টের দায়িত্ব পান।

ড. দেব ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের চেয়্যায়ম্যানের দায়িত্ব নেন এবং ১৯৬৭ সালে প্রফেসর পদে পদোন্নতি লাভ করেন।

ষাটের দশকের শেষের দিকে ড. দেব পেনসেলভেনিয়ার wilkes-Barre কলেজে শিক্ষকতা করেন। স্বল্প সময়ের মধ্যেই তিনি সেখানে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন এবং সেখানে তার গুণমুগ্ধরা তার মানবিক দর্শন প্রচারের লক্ষ্যে The Govinda Dev Foundation for World Brotherhood প্রতিষ্ঠা করে।

ড. দেব ১৯৬০ থেকে আমৃত্যু পাকিস্তান দর্শন সমিতির নির্বাচিত সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। এছাড়া ড. দেব তার জীবন ঘনিষ্ঠ মানবিক দর্শন প্রচারের জন্য সমস্ত সম্পত্তি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করে গেছেন যা পরবর্তীতে ১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন কেন্দ্র (ডিসিপিএস) প্রতিষ্ঠিত হয়।

গোবিন্দ চন্দ্র দেবের মোট গ্রন্থ নয়টি, যার মধ্যে দুটি বাংলায় এবং সাতটি ইংরেজিতে। জীবদ্দশায় প্রকাশিত বইগুলো হচ্ছে: Idealism and Progress (আদর্শবাদ এবং অগ্রগতি), Idealism: A New Defence and a New Application (আদর্শবাদ: একটি নতুন প্রতিরক্ষা এবং একটি নতুন প্রয়োগ), আমার জীবন দর্শন, Aspirations of the Common Man (সাধারণ ব্যক্তির আকাঙ্ক্ষা), The Philosophy of Vivekananda and the Future of Man (বিবেকানন্দের দর্শন এবং মানুষের ভবিষ্যৎ), তত্ত্ববিদ্যা-সার এবং Buddha, the Humanist (বুদ্ধ, মানবতাবাদী)।

মৃত্যুর পরে প্রকাশিত বইগুলো হচ্ছে: Parables of the East (পূর্বের উপমা) এবং My American Experience (আমার মার্কিন অভিজ্ঞতা)।

ড. দেবের পালিত কন্যা রোকেয়া বেগম আর তার স্বামী তার বাসায় থাকতেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে সারারাত ধরেই তার বাড়ির উপর গুলিবর্ষিত হয়। ভোরের দিকে তিনি তার মেয়েকে বললেন, মা তুমি একটু চা করো। আমি ততক্ষণে ভগবানের একটু নাম করি। এ সময় দরজা ভেঙে পাকিস্তানি সেনারা ঘরে ঢোকে। ‘কাঁহা মালাউন কাঁহা’ বলে তারা প্রফেসর দেবকে খোঁজ করে। পালিতা কন্যা রোকেয়া বেগমের স্বামী গোবিন্দ চন্দ্র দেবকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেন এবং সৈন্যদের মন গলানোর জন্য কলেমা পড়েন। কিন্তু এতে কাজ হয়নি। ড. দেব নিজেও দু`হাত ওপরে তুলে ‘গুড সেন্স গুড সেন্স’ বলে তাদের নিবৃত্ত করতে চান।

কিন্তু হাত কয়েক ব্যবধানে থেকে সেনাসদস্যরা ব্রাশ ফায়ার করে গোবিন্দ চন্দ্র দেব ও রোকেয়া বেগমের স্বামীকে হত্যা করে। রোকেয়া বেগম আকস্মিক আক্রমণ ও হত্যাকাণ্ডে অচেতন হয়ে পড়ায় বেঁচে যান। ২৬ মার্চ বিকেলে জগন্নাথ হলের পশ্চিম পাশ (যেখানে তার লাশ ফেলে রাখা হয়) ঘেঁষে উত্তর-দক্ষিণ বরাবর গর্ত খুঁড়ে মাটি চাপা দেয়া হয় হলের প্রভোস্ট ড. দেবসহ অন্যদের লাশ।

এমএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ড. দেব কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে `বিশ্ববিদ্যালয় স্বর্ণপদক` ও `হেমচন্দ্র মুখার্জি রৌপ্যপদক লাভ করেন। এছাড়া ১৯৬১ সালে `পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষিত সমাজ` কর্তৃক `দর্শন সাগর` উপাধি পান। ১৯৮৫ সালে পান মরণোত্তর `একুশে পদক`। ২০০৮ সালে পান স্বাধীনতা পুরস্কার (মরণোত্তর)।