আলোকচিত্রী: দীপাঞ্জন সরকার
তোমায় পাব বলে স্বাধীনতা
এস এম শাহরুখ পিকলুপ্রকাশিত : ডিসেম্বর ১২, ২০১৭
শায়লা পঁচিশ বছরের একটা মেয়ে। বিবাহিত। তিন বছরের একটা ছেলে আছে, নাম স্বাধীন। সময়টা চুয়াত্তুরের শেষদিকে। বাপের পেনশনে চলে কি চলে না, তবুও চলে যায়- এভাবেই বাঙালি বেঁচে থাকে। বাড়ি ভাড়া বাকি, মুদির খাতায় পাওনার পেইজ শেষ হয়ে এসেছে। মুদি এখনও তবু ভদ্রতা রেখেছে, এই রক্ষে। কিন্তু এই আকালে আর কতদিন! ব্যাটার চোখ তো ঠিকই শায়লার হঠাৎ খাঁজে। শায়লার ভরা যৌবনটা কাজে দেয় বইকি, নারীর শেষ সম্বল। কিন্তু আকাল বলে কথা, ‘অশনি সংকেত’ এর সন্ধ্যা রায় হতে আর কত দিন! মুখপোড়া না হলেও কদু মুন্সির চুটকি দাড়িই কি কম কদাকার! হাড় থুত্থুড়ে বুড়ো কিন্তু জিহবা মা কালীর থেকে ধার করা। পানের আতিশয্যে লালে লাল, লকলকে।
শায়লা সধবা নাকি বিধবা, তা কেউ জানে না। তবে বিধবা ধরে নেয়াই যুক্তিসঙ্গত। সেই এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে তার স্বামী শাওন বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে, আর ফেরেনি। কেউ তার সম্বন্ধে কিছু জানে না। একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে যে ঘর ছেড়েছিল। কেউ জানে না যে, সে কী আদৌ সীমান্তের ওপারে পৌঁছেছিল, নাকি পথেই কোনও নদীর ধারে লাইন ধরা লোকদের সঙ্গে চোখবাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। নিমেষে পাকসেনার গুলিতে ঝাঁঝড়া হয়ে গেছিল তার বুক, পেট, ফর্সা মুখমণ্ডল। কেউ জানে না, তাই শায়লাও মানতে চায় না। শাওন যাওয়ার সময়ে শায়লার পেটে একটা টাইম বোমার বীজ রোপিত হয়েছিল। সে বীজ চারা হয়ে জন্মেছে ঠিক বিজয় দিবসে। একাত্তুরের ডিসেম্বরের ষোলতে যখন দেশের মানুষ উৎফুল্ল, তখন শায়েলা ব্যথায় কঁকিয়ে দু’পা ফাঁক করে এ জগতে এনেছে স্বাধীনকে। যেন শত ব্যথার পরে চরম আত্মত্যাগের পরে মুক্তি। নামটা রাখা উচিত চিল, বিজয়। কিন্তু স্বাধীনেই নামটা স্থির হলো।
শাওন আসবে বলে আজও পথ চেয়ে থাকে শায়লা। যখন পৃথিবী ঘুমিয়ে পড়ে। তা সে সব-সময় না, নৈমিত্তিকের ধকল আছে না! চরম এক বাস্তব অস্তিত্বকে উপেক্ষা করে কে! কিন্তু অলৌকিকের নয়, স্বপ্ন পিছু ছাড়ে না।
নাহ্। যারা টহল দেয়, তারা ‘রক্ষী’, তারা স্বাধীনতা চায় না, তারা চায় অন্য কিছু। শায়লা যে এখনো ‘কচি’। লোভনীয়! একাত্তুর এখন চার বছরের বিস্মৃতিতে।
যুবতী পানে কে না চায়? স্বয়ং দেবতার আশ্রয় করে কি রক্ষা? নাকি তার কামাতুর প্রতিভূর লোলুপ দৃষ্টি? আপনারা এর উত্তর জানেন তো, তাই না!
শাওন তবুও স্বপ্নেই থাকে। কতকাল? শায়েলা জানে না। কেউ কি জানে? স্বাধীনকে আকড়ে স্বাধীনতা চায়, মুক্তি চায়...। শাওনকেও চায়।