তোদে যাত্রা

ফাল্গুনী পান

প্রকাশিত : মার্চ ৩১, ২০১৮

ভ্রমণ কাহিনি, এই শব্দবন্ধটা কেমন যেন খাপছাড়া! ভ্রমণের সামগ্রিকতা পূর্ণতা পায় না এই শব্দবন্ধের আলিঙ্গনে। ভ্রমণ একপ্রকার যাপন। প্রতিদিনের আদিখ্যেতার ঘ্যানঘ্যানানি থেকে বেরিয়ে এসে মানসিক অপূর্ণতাকে সামান্যাংশে পূর্ণতা প্রদান।

আমাদের প্রতিদিনের দৃশ্যাবলি আমাদের জীবণচারণকে একঘেয়ে করে ফ্যালে। প্রতিদিনের জীবনাচরণ ব্যাকুল করে আমাদের হৃদয়বাসনা। প্রকৃতি তার চেহারা পাল্টায়। সবুজ, ধূসর, রঙিন সাজে সেজে ওঠে তার নিজের তাড়নায়। পু্রোনোকে বিদায় দিয়ে নতনের আবাহন তো একটা অজুহাত মাত্র। আর এই প্রাকৃতিক অঙ্গভঙ্গিমা বারুদ জোগায় শারীরিক-মানসিক একঘেয়েমিকে ছিঁড়ে ফেলে কয়েকদিনের অমলিন ভ্রমণের পিপাসাকে।

তবে ওই যে বললাম, ভ্রমণের অভিজ্ঞতাকে শুধুমাত্র কাহিনি শব্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা যায় না। প্রত্যেকটি ভ্রমণ অভিজ্ঞতার একটি নিজস্ব যাপন আছে। আর সেই যাপনের সঙ্গে ওৎপ্রোতভাবে যুক্ত আছে সেই বিশেষ জায়গাটির প্রকৃতি, সংস্কৃতি, দৈনন্দিন জীবন এবং অবশ্যই মানুষ। আর মানুষ যখন আবশ্যিক তখন সেই মানুষের উপস্থিতিতে সেখানে অবশ্যই গড়ে উঠবে সেই স্থানভিত্তিক অর্থনীতি রাজনীতি। যা প্রত্যক্ষ বা পরক্ষো কিংবা উভয়ভাবেই নিয়ন্ত্রণ করে সেই সমাজের সমস্তটাকে।

গত বছর, পূজো সবে শেষ হয়েছে। একটু একটু করে হেমন্তের বাতাস বইছে শান্তিনিকেতনের আনাচে-কানাচে। মাথাভরা অস্থিরতা নিয়ে ঘরের চার-দেয়ালে শরীর তখন দুরন্ত হয়ে উঠেছে। পকেটে টাক- পয়সা কিছু ছিল। ভেবেছিলাম একাই বেরিয়ে পড়ব। তবে সঙ্গী জুটে গেল আরও তিনজন। ১৬ অক্টোবর চিতপুর স্টেশন থেকে ট্রেনে চেপে পড়লুম। উদ্দেশ্য ‘তোদে’। পাহাড়ের গায়ে একটা ছোট্ট গ্রাম। রেলগাড়ি বরাবরই আমার খুব ভালো লাগার বিষয়। সেই যখন সবে একটু বুঝতে শিখেছি, একবার ‘পথের পাঁচালী’ দেখেছিলাম আমাদের বাড়ির সাদা কালো টিভিতে। ধোঁয়াওঠা রেলগাড়ি যখন ঝমঝমিয়ে কাশবনের শুভ্রতাকে পাশ কাটিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছিল আর অপু দু’চোখ ভরে সেই সবটুকুকে  অগাধ বিস্ময়ে সারা শরীরে মাখছিল, তখন থেকেই বোধহয় রেলগাড়ি আমাকেও টানতে শুরু করেছিল তার দিকে।

এখন তো আমি বেশ বড়। তবুও যতবারই রেলগাড়ির ভোঁ শুনতে পাই, ততবারই ‘অপু’ আমার ভেতরের ‘দূর্গা’কে ডেকে ওঠে। শিলিগুড়ি পৌঁছলাম তখন রাত প্রায় আটটা। সেখান থেকে একটু খাওয়া-দাওয়া করে এক বন্ধুর বাড়ি। সেই রাতের মতো রেস্ট। একটা সুন্দর ঘুম। পরদিন ভোরবেলা উঠে আবার ট্রেন। এবার শিলিগুড়ি থেকে কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস। চারদিকে পাহাড় তখন শুরু হয়ে গেছে। এদিককার পাহাড় মালভূমির পাহাড়ের মতো ন্যাড়া নয়। চারদিক থেকে সবুজ ঘিরে রেখেছে তাকে। তবে সবুজের উপাদান সব একই তাও নয়; কোথাও গাঢ়, কোথাও স্নিগ্ধ, কোথাও একটু তামাটে। কত বর্ণের সবুজ যে সেখানে একসাথে বাস করে, তার হিসেব দেয়া আমার পক্ষে সম্ভবপর নয়। আর সেই বহুমাত্রিক সবুজের মধ্যে থেকে ছুটে আসে সূর্যের উজ্জ্বলতা; শুভ্র নির্মল আলোকচ্ছটা একটু একটু করে ছুঁয়ে যায় সবুজের আস্তরণ, গড়িয়ে পড়ে পাতার ফাঁক দিয়ে।

অবাক চোখে তাকিয়ে থাকি সেদিকে, পিপাসা যেন আর মেটেই না। তিস্তা পেরোলাম। এরপরেই সেবক স্টেশন। চারদিকে গাছে ঘেরা একটা স্টেশন। আবার ভোঁ, চলা শুরু। সেবক পেরিয়ে কিছুটা এগিয়ে গেলেই একটা টানেল পড়ে। রোদের ঝলকানির মধ্যে দিয়ে ছুটতে ছুটতে হঠাৎ ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসে কয়েক মুহূর্তের জন্য। আমাদের নামতে হবে ‘চালসা’ স্টেশন। সেবক থেকে আরও কিছুক্ষণ যাওয়ার পরেই ‘চালসা’ স্টেশন চলে এলো। নামলাম আমরা। সেখান থেকে হেঁটে পৌঁছলাম চালসা বাজার। চালসা বাজার থেকে সাধারণের যাতায়াতের জন্য যে সুমো ব্যবহার করা হয়, তাতে করেই আমরা তোদের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। মোট সময় লাগে কমবেশি প্রায় চার ঘণ্টা। তোদে যাওয়ার যে রাস্তা সেটা বড়ই সুন্দর। একটু একটু করে উচ্চতা বাড়ে। পাহাড়ের গা বেয়ে একটা পাহাড় থেকে আর একটা পাহাড়ে পৌঁছে যাই আমরা। যখন বেশ কিছুটা উঠেছি তখন ওই উপর থেকে নিচে একদিকে তিস্তা আর একদিকে চালসা দেখা যায়। ক্ষুদে ক্ষুদে ঘড়বাড়ি কিন্তু কত রঙের বৈচিত্র্য তার মধ্যে।

তোদে যাওয়ার পথে আমাদের একটা ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হয়। আমরা তখন পাহাড়ি রাস্তার বেশ উঁচুর দিকে, রাস্তা বেশ খাঁড়া। মধ্যিখানে একটি গ্রাম পেরিয়ে গাড়ি একটা বাঁক নিয়েছে আর সেই বাঁকের পরেই একটা রোডবাম্প। সেটা পেরোতে গিয়ে হঠাৎ গাড়ি বন্ধ। পাশে অতল খাদ আর ঠিক সেই জায়গাটাতেই রাস্তার ধারে কোনো আড়াল নেই। গাড়ি বন্ধ হয়ে পেছাতে শুরু করে। আমরা ছিলাম গাড়ির ছাদে। ভয়ের চোটে আমাদের আত্মারাম তখন প্রায় খাঁচাছাড়া। কোনোরকমে গাড়িতে ব্রেক দিয়ে গাড়ি হালকা করে আবার স্টার্ট দেয়া হলো। আমরা আবার চাপলাম গাড়িতে। আবার দুলুনি শুরু।

চলবে...


লেখক: ছাত্র ও রাজনৈতিক কর্মী, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়