তুহিন খানের প্রবন্ধ ‘পশ্চিমা দর্শনে থিওডিসির ধারণা’

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২২

ইবলিস বিষয়ক যে প্রস্তাব পেশ করছেন কিছু মানুশ, যা নিয়ে অনলাইন স্ফিয়ারে উত্তপ্ত বিতর্ক চলমান, তা নতুন কোন বিষয় না। ইসলামি থিওলজি কেবল না, ক্রিশ্চান থিওলজি ও মডার্ন ওয়েস্টার্ন ফিলোসফিরও একটি কেন্দ্রীয় তর্ক এইটা, এবং কালামশাস্ত্রে এই বিষয়ে প্রোফাউন্ড আলাপ হইছে। কথাটা বলার কারণ হইল, এই তর্ক না বুঝলে ধর্মসাগর গ্রুপের (আমি এই নামায়ন পছন্দ করি না; যেহেতু কোন নাম নাই ওনাদের, তাই আলাপের স্বার্থে এই নাম) আলাপ পর্যালোচনা ও মোকাবেলার জন্য প্রয়োজনীয় রসদ আমরা পাব না। এই তর্কের গোড়া পোঁতা আছে `থিওডিসি` (খোদার ন্যায়বিচার) বিষয়ক তর্কের মধ্যে। থিওডিসি নিয়ে এই পোস্টে আমি খুব বিস্তারিত আলাপ করব না। শুধু নোকতা দিয়ে রাখার জন্য থিওডিসির কেন্দ্রীয় তর্কটা উপস্থাপন করব।

থিওডিসি শব্দটা দার্শনিক লাইবনিজের (১৬৪৬-১৭১৬) আবিষ্কার। ১৭১০ সালে প্রকাশিত `এসেস ডে থিওডিসি`তে উনি ওনার থিওডিসি বিষয়ক চিন্তা প্রকাশ করেন; যা পরবর্তীতে পশ্চিমা দার্শনিকদের মধ্যে দীর্ঘ বিতর্কের জন্ম দেয়। মূলত খোদার ন্যায়বিচার, খোদায়ি ইচ্ছা ও খোদার অনন্ত কুদরত বা শক্তি (ওমনিপটেন্স)— এই তিন জিনিশের ব্যাপারে কিছু প্রশ্ন হাজির করে। থিওলজি ও ফিলোসফির ইতিহাসে এরে `প্রবলেম অব ডেভিল`-ও বলছেন কেউ কেউ। থিওডিসির মূল তর্কটা কী? ডেভিড হিউম সংক্ষেপে এই তর্কটা উপস্থাপন করছেন এভাবে— `আল্লাহ কি দুনিয়ার সকল শয়তানি ও খারাপি বন্ধ করতে চান, কিন্তু পারেন না? তাহলে তো উনি শক্তিহীন বা ওমনিপোটেন্ট না। নাকি তিনি পারেন, বাট চান না? তাইলে তো তিনি অমঙ্গলকামী। আর যদি  তিনি সব শয়তানি বন্ধ করতে চান এবং পারেনও, তাইলে শয়তান কোথায়?` Dialouge Concerning Natural Religion, ed. Pike, p. 88)

অর্থাৎ, খোদার অনন্ত ও নিঃশর্ত কুদরত বা ওমনিপোটেন্স, আর তার ন্যায়বিচারক ও দয়াময় হওয়ার সাপেক্ষে, এই দুনিয়ায় ঘইটা চলা সকল শয়তানি, ইল ইভেন্ট, মানুশের কষ্ট, যন্ত্রণা, ক্লেশ— এসবরে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? খোদা কি এসব চান? নাকি তিনি এসব ঠেকাইতে চান? নাকি এগুলা সবই খোদায়ি হেকমতের অংশ, যা ঘটে সবই `জাস্ট` ও `পারফেক্ট`?

এই প্রশ্নের উত্তরে পশ্চিমা দার্শনিকরা নানাভাগে ভাগ হইছেন। `অপটিমিস্ট` বা ইতিবাদী দার্শনিকরা মনে করতেন, এই দুনিয়ায় যা ঘটে, সবই জাস্ট ও সঠিক, সবই খোদায়ি হেকমতের অংশ। বিখ্যাত ইতিবাদী কবি আলেক্সান্দার পোপের ভাষায়— Whatever is, is right. লাইবনিজ, ক্রিশ্চিয়ান উল্ফ ও আলেক্সান্দার পোপ ছিলেন এই ইতিবাদী ধারার দার্শনিক। তাদের মতে: আমাদের এই দুনিয়াই সর্বোচ্চ সুন্দর, সর্বোচ্চ ন্যায়পরায়ণ, সবচেয়ে সন্তোষজনক, সবচেয়ে সম্ভাব্য দুনিয়া। ফলে, `যা বিদ্যমান, তার চেয়ে জাস্ট আর কিছুই হইতে পারে না।` গোটা দুনিয়া একটা গ্রান্ড সিস্টেমে চলে, যারে বলে `খোদায়ি হেকমত`; আর এই গ্রান্ড সিস্টেমের প্রতিটা অংশই দুনিয়ার সিস্টেমরে সচল রাখার জন্য জরুরি। লাইবনিজ এই অপটিমিজমরে ব্যাখ্যা করছেন পুরোপুরি থিওলজিকাল টোনেই—

`পরিশেষে, এই বিশ্বজগতের কোনকিছুই উপেক্ষিত নয়; আল্লাহর জগত থেকে কোনকিছুই হারায় না; আমাদের মাথার প্রত্যেকটা চুলের হিশাব রাখা হয়, এক গ্লাশ পানির হিশাবেও কোন গড়বড় হয় না;...সব ভাল কাজের বিনিময়ে আছে পুরস্কার, সব খারাপ কাজের জন্য আছে শাস্তি; অসীম অপরের সম্মেলন ছাড়া এই দুনিয়া পারফেক্ট হইতে পারে না।` (লাইবনিজ, ফিলোসফিকাল পেপারস অ্যান্ড লেটারস, পৃ. ২১৯-২০)

বাট এই দর্শন খোদার জাস্টিসরে গুরুত্ব দিলেও, তার ওমনিপোটেন্স বা সর্বময় সভরেইন কুদরত প্রশ্নের মুখে পড়ে— তাইলে এর চাইতে অধিক জাস্ট বা সুন্দর কোন দুনিয়া কি খোদা বানাইতে পারেন না?

১৭৫৬ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর নেতিবাদী দার্শনিক ভল্টেয়ার এক চিঠিতে লেখেন: `দুনিয়ার সকল সম্ভাব্য রুপের মধ্যে সবচাইতে ভাল রুপটাও ভয়ানক বিশ্রী।` ১৭৫৫ সালের পয়লা নভেম্বর লিসবনে এক ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়। এই ভূমিকম্পে হাজার হাজার মানুশ মারা যায়। ওইদিন ছিল `অল সেইন্ট ডে`। লিসবনের চার্চে আশ্রয় নেওয়া অনেক লোক ভয়ে পালাইতে গিয়া একে অন্যের পায়ের তলে পড়ে মারা যায়; বন্দরে আশ্রয় নেওয়া লোকেরা সামুদ্রিক ঢেউয়ে তলায়ে যায়। এর দুই মাস পর ভল্টেয়ার লেখেন তার বিখ্যাত কবিতা `পোয়েমে সার লে ডিজাস্টারে ডে লিসবন`। এই কবিতায় ভল্টেয়ার অ্যাটাক করেন ইতিবাদরে; আলেক্সান্দার পোপ`র `যা ঘটে, সবই সঠিক`র বিরুদ্ধে লেখেন— `এটা আমাদের জীবনের দুঃখ যন্ত্রণার প্রতি ভয়াবহ উপহাস।` ভল্টেয়ারের এই নেতিবাদের সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটে দুই বছর পর প্রকাশিত বিখ্যাত উপন্যাস `কাঁদিদ`-এ।

ভল্টেয়ারের পাশাপাশি ডেভিড হিউম, স্যামুয়েল জনসন, আর্থার শোপেনহাওয়ারসহ আরো অনেকেই এই নেতিবাদী ধারার লোক। ইমানুয়েল কান্ট এই বিতর্কে এক ধরনের স্থিতাবস্থা তৈয়ার করেন। তিনি বলেন, এসব প্রশ্ন `মানুশের বোধবুদ্ধির অনেক উর্ধ্বে`।

যাহোক, পশ্চিমা দর্শনে এই ইতিবাদী ও নেতিবাদী থিওডিসি নিয়া অনেক তর্ক আছে। বাট এর সাথে শয়তানের সম্পর্ক কী? সম্পর্ক এই— আল্লাহ যদি সর্বশক্তিমান ও ন্যায়বান হন, তাইলে এই দুনিয়ার চাইতে আরেকটু বেটার দুনিয়া কি তিনি বানাইতে পারেন না? যদি না পারেন, তাইলে তার ওমনিপোটেন্স থাকে না। কিন্তু যদি পারেন, তাইলে করেন না কেন? ইচ্ছা কইরা? তাইলে তিনি তো জাস্ট না। এখান থেকে প্রশ্ন ওঠে, তার ইচ্ছায়ই যদি সব হয়, তাইলে শয়তানের রোল কী? শয়তানের মত একটা ক্যারেক্টার কেন প্রয়োজন, যদি আল্লাহই সব করেন? শয়তান কি তাইলে আল্লাহর ইচ্ছায়ই তার `আনজাস্ট` ইচ্ছারে বাস্তবায়ন করার জন্য নিয়োজিত কেউ? সে কি খোদার হুকুমে চলে? এই চিন্তাভাবনা থেকে অনেকে শয়তানরে ভাবেন খোদায়ি সিস্টেমের অংশ। শয়তান এই সিস্টেম চালু রাখতে নিজেরে সেক্রিফাইস করছে।

অনেক দার্শনিক সুফি দুনিয়ার ব্যাপারে এক ধরনের নিও-প্লেটোনিক ভিশন রাখতেন। যার সারকথা এই যে, জগতের সকল কিছু একটা পারফেক্ট `ওয়াননেস` বা `সকল আলোর আলো` (নুরুল আনওয়ার) থেকে চ্যুত, পরিবর্তিত, বিকৃত বা পরিবর্তিত। ফলে, তারা ইবলিসরে ভাবতেন এই গ্রান্ড সিস্টেমের অংশ, যে খোদার প্রেমে নিজেরে সেক্রিফাইস করছে। কেউ কেউ তারে ভাবতেন কঠিন একেশ্বরবাদী, যে খোদার `ইচ্ছা` ও `আদেশ`র মধ্যে `ইচ্ছা`রে বেছে নিছে। কেউ কেউ ভাবতেন, খোদার গ্রান্ড সিস্টেমের জন্য সে নিজেরে সেক্রিফাইস করছে।

এক্সট্রিম স্যাটানিস্টরা আবার শয়তানরে ভাবে খোদাবিরোধী আরেক ওমনিপটেন্ট শক্তি; ফলে তারা শয়তানের পূজা করে। এইখানে এসে এই তর্কের সাথে যোগ হয় `ফ্রি উইল` বা স্বাধীন কর্তাসত্তা ও প্রিডেস্টিনেশন বা কদর বা ভাগ্যের প্রশ্ন। শয়তান কি খোদার ইচ্ছাধীন, না স্বাধীন? একইভাবে, মানুশ কি খোদার ইচ্ছাধীন, না স্বাধীন? শয়তান যে মানুশরে ধোঁকা দেয়, খারাবি ঘটায় দুনিয়ায়, তা কি আল্লাহর ইচ্ছায় না স্বাধীনভাবে? আর আল্লাহর ইচ্ছায় যদি হয়, তাইলে ইবলিস বা শয়তান কি শাস্তি পাবে?

ইসলামি থিওলজিতে কদর ও ফ্রি উইলের কোশ্চেন নিয়া যেমন যুগ যুগ ধরে বিতর্ক চলছে, তেমনি বিতর্ক হইছে থিওডিসি নিয়াও। এবং এরই পরিপ্রেক্ষিতে শয়তান বা ইবলিসের ব্যাপারে নানা ধ্যান ধারণা তৈয়ার হইছে। মুতাযিলা, আশ`আরি, মাতুরিদি, সালাফি-আসারি ও সুফি ধারা এই বিতর্কে ক্রমাগত কন্ট্রিবিউট করছে।

লেখক: কবি