তুহিন খানের প্রবন্ধ ‘জালালুদ্দিন সুয়ুতি ও যৌনসাহিত্য’

প্রকাশিত : জুলাই ২৫, ২০২৩

শাইখুল ইসলাম আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ুতি (৮৪৯-৯১১ হি.) মামলুক আমলের শেষভাগে মিশরে জন্মগ্রহণ করেন। মামলুক যুগের একজন প্রলিফিক স্কলার ও ইন্টেলেকচুয়াল ছিলেন উনি। ওনার রচনার পরিমাণ বিস্ময়কর। ইসলামি দুনিয়ায় তখন পর্যন্ত বিকশিত প্রায় সকল শাস্ত্রে লেখালেখি করছেন এই স্কলার। হাদিস, তাফসির, ফিকহ, উসুল, আকিদা, সুফিবাদ, ভাষাতত্ত্ব, ব্যাকরণ, অলঙ্কারশাস্ত্র, কালামশাস্ত্র, দর্শন, চিকিৎসাবিদ্যা, কবিতা, সাহিত্য, ইতিহাস— কোন বিষয়ে লেখেন নাই তিনি! তার রচনাসংখ্যা এক্সাক্টলি কত, সে-বিষয়ে এখনও নিশ্চিত হইতে পারেন নাই ঐতিহাসিকরা৷ সতর্ক হিশেবমতে এই সংখ্যা প্রায় ৫০০; আর তার দিকে সম্পৃক্ত তবে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না, এমন বইগুলারে হিশাবে আনলে এই সংখ্যা প্রায় ১০০০!

 

সমকালে সুয়ুতি ‘শাইখুল ইসলাম’ উপাধি পাইছিলেন। বিদ্যাচর্চা ও অধ্যাপনায় প্রায় কীংবদন্তির পর্যায়ে পৌঁছাইছিলেন; কাজি বা প্রধান বিচারপতির পদেও ছিলেন বেশ কিছুদিন। সুয়ুতির ব্যক্তিত্বের একটা বৈশিষ্ট্য ছিল প্রচণ্ড আত্মমর্যাদাবোধ ও নিজের জ্ঞান সম্পর্কে অগাধ আস্থা। একপর্যায়ে সুয়ুতি নিজেরে ‘মুজতাহিদ’ ও ‘মুজাদ্দিদ’ দাবি করেন; নিজেরে সমকালের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ঘোষণা করেন। ইবনে আরাবিরে ডিফেন্ড করাসহ আরো বিভিন্ন ইস্যুতে, সুয়ুতির সাথে ব্যাপক মতবিরোধ হয় সমকালীন অনেক স্কলার ও সুফির; এমনকি খোদ সুলতান কায়তবাইয়ের। সাখাভি, ইবনুল কারাকিসহ সমকালীন আরো অনেকেই তার বিরুদ্ধে প্লেজিয়ারিজম, পাণ্ডুলিপি চুরি, ভুয়া মুজাদ্দিদিয়তের দাবি করাসহ আরো নানা অভিযোগ তোলেন৷ আকিদা সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রশ্নেও এদের সাথে ব্যাপক মতবিরোধ হয় সুয়ুতির। সুয়ুতি প্রচণ্ডরকম আত্মবিশ্বাসী, একরোখা ও ইতিহাস-সচেতন মানুশ ছিলেন; নিজের ব্যাপারে সমকালীনদের তোলা প্রত্যেকটা অভিযোগের জবাব উনি আলাদা আলাদা বইতে লেইখা গেছেন।

 

একপর্যায়ে সুয়ুতি পাবলিক লাইফ পুরাপুরি ত্যাগ কইরা কায়রোর রাওদা নামক দ্বীপে স্বেচ্ছা-নির্বাসনে যান। আর তার লাইফের অধিকাংশ রচনাই ওই স্বেচ্ছা-নির্বাসনের টাইমে লেখা। ৯১১ হিজরি সনে, উনি মারা যান। জীবদ্দশায়ই তার রচনার খ্যাতি ছড়ায়ে পড়ছিল দেশে-বিদেশে। মৃত্যুর পর সেই খ্যাতি উত্তরোত্তর বাড়ছেই কেবল। তার প্রমাণ হইল, আজও বাঙলাদেশসহ সারা দুনিয়ার দেওবন্দি ধারার মাদ্রাসাগুলায় তাফসিরশাস্ত্রের প্রধান টেক্সট হিশাবে যে বইটা পাঠ্য, তাফসিরে জালালাইন (দুই জালালের তাফসির), তার এক অংশের লেখক উনি (অন্য অংশের লেখক জালালুদ্দিন মাহাল্লি)।

 

২.
সুয়ুতির জীবন নিয়া লেখতে গেলে উপন্যাস লেখা যাবে। তবে আজ আমরা তারে নিয়া ডিটেইল আলাপ করতে বসি নাই। এই বিখ্যাত পলিম্যাথের বিপুল রচনার একটা অংশে ফোকাস করাই আমাদের এই লেখার উদ্দেশ্য। সেইটা হইল: ইরোটিক লিটারেচার বা যৌনসাহিত্য বা কামশাস্ত্র।

 

খৃস্টীয় ৯ম শতক থেকে ১৫ শতকের মধ্যের সময়টা ছিল মুসলিম বিশ্বে এই শাস্ত্রের উত্থান ও বিকাশের স্বর্ণযুগ। মধ্যযুগের আরবে ইরোটিক লিটারেচার ফ্লারিশ করছিল বেসিক্যালি জাহেলি যুগের আরবি কবিতা, ফোকলোর ও আদব লিটারেচারের মধ্য দিয়া৷ পরে উমাইয়া ও আব্বাসি যুগে, তৎকালীন শাসকশ্রেণীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্যাট্রোনাইজেশনে, প্রধানত সাহিত্য, কবিতা ও ফোকলোর, পাশাপাশি দাস-দাসী ও হেরেম কালচারের মধ্য দিয়া, কোর্টলি লাভ ও ইরোটিক লিটারেচারের (প্রেম ও যৌনতা সম্বন্ধীয় লেখাজোকা) বিপুল উৎপাদন সম্পন্ন হয়।

 

শুরুতে এই উৎপাদনে কেবল সাহিত্যিক, ভাষাবিদ, সংগীতজ্ঞ, ইতিহাসবিদ তথা ‘সেক্যুলার’ বিদ্বানসমাজ অবদান রাখলেও, আস্তে আস্তে ওলামা তথা ধর্মীয় স্কলাররাও এ বিষয়ক লেখাজোকা উৎপাদনে অংশ নেন। ফলে, ভাষাতত্ত্ব, সাহিত্য, ফোকলোর, প্রবাদ-প্রবচন, লোকমুখে চালু চুটকি, দাস-দাসীদের নানা কাহিনী, আদিরসাত্মক কৌতুকের পাশাপাশি, ধর্মশাস্ত্র, নীতিশাস্ত্র, ফিকহ, ব্যাকরণসহ, ইসলাম-প্রভাবিত বিভিন্ন শাস্ত্রেরও নানা উপাদান যুক্ত হয় এই ইরোটিক লিটারেচারে।

 

আলেম-ওলামাদের একটা বিরাট অংশ এই ধরনের লিটারেচার উৎপাদনে অংশগ্রহণ করছেন। তবে, তারা সবাই আলাদাভাবে এই বিষয়েই বই লিখছেন, এমন না। রাগিব ইস্পাহানির ‘মুহাদারাতুল উদাবা’ বা ইবনুল জাওযির ‘আখবারুন নিসা’র কথাই ধরা যাক। এসব বই মূলত নীতিশাস্ত্র ও সাহিত্যের বই; কিন্তু এসব বইতে বিয়ে ও যৌনতা সংক্রান্ত আলোচনায়, আরবের পপ কালচার থেকে বিপুল পরিমাণ ইরোটিক উপাদান নেওয়া হইছে।

 

যেসব আলেম আলাদাভাবে কেবল এই বিষয়েই লেখালেখি করছেন, তাদের মধ্যে জালালুদ্দিন সুয়ুতি অন্যতম। কেবল এই এক বিষয়েই উনার রচনার পরিমাণ দেখলে বোঝা যায় যে, জ্ঞানচর্চা ও লেখালেখির পেছনে কী নিরলস পরিশ্রম উনি করছেন। এসব বইয়ের কন্টেন্ট বিশ্লেষণ করলে আরো বোঝা যায় যে, জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে কতটা সাহসী ও প্রিজুডিসমুক্ত ছিলেন এই স্কলার।

 

সুয়ুতির লেখা এবং তার নামে প্রচারিত এই বিষয়ক বইয়ের সংখ্যা অনেক। তবে এসব বইয়ের মধ্যে অনেকগুলাই ভুলভাবে তার নামে প্রযুক্ত। এই লেখায় আমরা সুয়ুতির এই বিষয়ে লেখা ৮টা বই নিয়া সংক্ষেপে আলাপ করব।

 

৩.
সুয়ুতির এই বিষয়ে লেখা বইপত্রগুলার বিষয়বস্তুরে আরবিতে বলে ‘ইলমুল জিনস’ বা সেক্সিওলজি। এসব বিষয়রে কয়েক ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:
১. কামশাস্ত্র ও শৃঙ্গারকলা
২. উইমেন ফিজিক্স/অ্যানাটমি
৩. বিয়েশাদির সামাজিক কেতা
৪. জনযৌনসংস্কৃতি

 

সুয়ুতির বইগুলার মূল বিষয় কামশাস্ত্র বটে। তবে সুয়ুতির ব্যবহৃত ম্যাটেরিয়াল ইন্টারডিসিপ্লিনারি। ভাষাতত্ত্ব, সাহিত্য, পপ কালচার, প্রবাদ-প্রবচন, ইতিহাস, ফিকহ, কোরআন-হাদিস, চিকিৎসাবিদ্যা ইত্যাদি বিভিন্ন মাধ্যম থেকে উপাদান সংগ্রহ করছেন সুয়ুতি। ফলে এসব বইয়ের প্রত্যেকটাই রেয়ার তথ্য-উপাত্তের একেকটা খনি হয়ে উঠছে।

 

আমরা এখানে সংক্ষেপে সুয়ুতির বইগুলা নিয়া আলাপ করব:
১. আল-ভিশাহ ফি ফাওয়াইদিন নিকাহ। সুয়ুতির এই বিষয়ে লেখা বইপত্রের মধ্যে সবচে উল্লেখযোগ্য ও আলোচিত বই এইটা। এই বইয়ের ভূমিকায় সুয়ুতি লিখছেন যে, এই বিষয়ে একাধিক পাণ্ডুলিপি তিনি রেডি করছেন (পৃ. ৩৪)। ভূমিকায় সুয়ুতি আরো জানাইতেছেন, এই বই মূলত ওনার ম্যাগনাম ওপাস ‘মাবাসিমুল মিলাহ’র শর্ট ভার্শন। সুয়ুতি বলতেছেন:

 

‘মাবাসিমুল মিলাহ ওয়া মাবাসিমুস সিবাহ ফি মাওয়াসিমিন নিকাহ’ নামে প্রায় ৫০টা খাতার একটা পাণ্ডুলিপি তৈরি করছিলাম আমি...আমার মনে হইল, এটা অতিরিক্ত বড় হয়ে গেছে; (এটা লিখতে লিখতে) আমি ভীত ও ক্লান্ত হয়ে পড়লাম, তারপর এই শর্ট ভার্শনটা বানাইলাম...এইটা মূল বইয়ের ১০ ভাগের এক ভাগ।’ (পৃ. ৩৪-৩৫)

 

বইয়ের ভূমিকার শেষদিকে, আলেম-ওলামার সাধারণ রীতি অনুসারে, সুয়ুতি শরিয়ত থেকে ‘সেক্সিওলজি’ বিষয়ক বই লেখার অনুমোদন খুঁজছেন। ‘সিহা সিত্তা’র অন্যতম প্রধান লেখক আবু দাউদ সিজিস্তানির ‘কিতাবুল মাসাহিফ’র বরাতে সাহাবি যায়েদ ইবনে সাবেতের একটা হাদিস উনি আনছেন, যেখানে হযরত যায়েদ বলতেছেন যে, রাসুল (সা.) সবকিছু নিয়াই আমাদের সাথে আলাপ করতেন (সেখানে নারীরও উল্লেখ আছে)।

 

‘মাবাসিমুল মিলাহ’ আর ‘আল ভিশাহ’র অধ্যায়বিন্যাসও একই ধরনের। বইটা ৭ অধ্যায়ে সাজানো:
১. হাদিস ও আসার
২. ভাষাতত্ত্ব। এই অধ্যায়ে সুয়ুতি সেক্স, নারী-পুরুষের যৌনাঙ্গ ও শীৎকারের জন্য আরবি ভাষায় ব্যবহৃত বিচিত্র সব শব্দ ও এক্সপ্রেশনের এক বিশাল লিস্ট দিছেন। এই লিস্ট ১০৬ পৃষ্ঠা লম্বা (৯১-১৯৬)।
৩. ইতিহাস ও চুটকি
৪. গদ্য ও পদ্য
৫. অ্যানাটমি
৬. চিকিৎসাবিদ্যা
৭. সঙ্গম। এই অধ্যায়ে বিভিন্ন বইয়ের সূত্রে সুয়ুতি সেক্সের প্রায় ১০০ টা পজিশনের কথা সবিস্তারে লেখছেন; পাশাপাশি জানাইছেন যে, এই তালিকা সংক্ষিপ্ত; তার অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি ‘মাবাসিমুল মিলাহ’তে সেক্সুয়াল পজিশনের পূর্ণাঙ্গ তালিকাটা আছে (পৃ. ৩৯৩)।

 

২. আল-য়াওয়াকিতিস সামিনা ফি সিফাতিস সামিনা। এই বইয়ের বিষয়বস্তু হইল উইমেন অ্যানাটমি। মোটা বা স্বাস্থ্যবান নারীদের বিবরণ লিপিবদ্ধ করা হইছে এই বইয়ে। বইটা প্রধানত তিন ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগে সুয়ুতি স্বাস্থ্যবান নারীদের জন্য আরবিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন শব্দের ৩২ পেজ লম্বা একটা লিস্ট দিছেন। পরের ভাগে হাদিস ও ইতিহাস থেকে স্বাস্থ্যবান ও মোটা নারীদের নানা ধরনের কাহিনী আনছেন। তৃতীয় ও চতুর্থ ভাগে মোটা নারীদের নিয়া আরব ও অনারব কবিদের বিভিন্ন পংক্তি ও কবিতা আনছেন।

 

৩. শাকাইকুল আতরুজ্জ ফি রাকাইকিল গুনজ। এই বইয়ের বিষয়বস্তু প্রায় ‘আল ভিশাহ’র মতই। এই বইতে সুয়ুতি শৃঙ্গারশাস্ত্র, শৃঙ্গারকলা ও আরবিতে শৃঙ্গারকলার নানারুপ বুঝাইতে ব্যবহৃত শব্দের এক দীর্ঘ তালিকা প্রণয়ন করছেন।

 

৪. নাওয়াদিরুল আইক ফি মা`রিফাতিন নাইক। এই বই আমি আমার অন্য এক লেখায় ইন ডিটেইল আলাপ করছি। বইয়ের বিষয়বস্তু ‘আল ভিশাহ’ ও ‘শাকাইক’র মতই। এই বইতে সেক্স ও নারী-পুরুষের যৌনাঙ্গের জন্য ব্যবহৃত বিচিত্র শব্দ আরবি শব্দের তালিকার পাশাপাশি, সেক্সুয়াল পজিশন, সেক্স সম্পর্কিত বিভিন্ন কবিতা, উক্তি, চুটকি, সেক্সুয়াল টিপস, নারী-পুরুষের বীর্যের বর্ণনা ইত্যাদি লিপিবদ্ধ করা হইছে।

 

৫. রাশফুয যুলাল মিনাস সাহরিল হালাল। এইটা সুয়ুতির বেশ ইউনিক একটা ফিকশনাল বই। বইটারে ‘মাকামাতুন নিসা’ও বলা হয়। ‘মাকামা’ আরবি গস্যসাহিত্যের একটা জনরা। বইয়ের বিষয়বস্তু সংক্ষেপে এমন: মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফকিস, সুফি, তর্কশাস্ত্রবিদ, ভাষাবিদসহ বিভিন্ন শাস্ত্রে পণ্ডিত লোকদের একটা সার্কেল একত্রে মিলিত হইয়া, নিজ নিজ শাস্ত্রের পরিভাষা, বিদ্যা ও ইশারা-ইঙ্গিত ইউজ কইরা, তাদের বাসর রাতের কাহিনী সবিস্তারে বর্ণনা করে। কামশাস্ত্রে এই বই সুয়ুতির ইউনিক সংযোজন। পাশাপাশি এই বইয়ের সাহিত্যরসও অনবদ্য।

 

৬. আল-মুস্তাযরাফ মিন আখবারিল জাওয়ারি৷ এই বইতে সুয়ুতি আরব ও আজমের মোট ৪৭ জন দাসীর নানা ধরনের কাহিনী বয়ান করছেন। বইটা মূলত ইতিহাস ও চরিতাভিধান জনরার। তবে এই বইতে কামশাস্ত্র, সাহিত্য, জনসংস্কৃতি ও ভাষাবিদ্যার নানা উপাদান ও তথ্য মজুদ আছে।

 

৭. নুজহাতুল উমার ফি তাফদিল বাইনাল বিদি ওয়াস সুদি ওয়াস সামার। এই বইয়ের বিষয়বস্তু রেস বা বর্ণ। শাদা, কালো না তামাটে— কোন বর্ণ শ্রেষ্ঠ? এই প্রশ্নের আলোকে বইটা লেখা হইছে। বইতে সুয়ুতি কোরআন, হাদিস, আসার, ইতিহাস, মনীষীদের উক্তি ইত্যাদ ব্যবহার কইরা, বেসিক্যালি শাদা বর্ণরে অন্যসব বর্ণের উপর প্রাধান্য দিছেন। তবে বইয়ের ম্যাটেরিয়াল থেকে জানা যায় যে, শাদা বর্ণের শ্রেষ্ঠত্বের রেটরিকটা আরবে সর্বসম্মত মত ছিল না। বইয়ের ভূমিকা থেকে জানা যায় যে, মুহাদ্দিস ও গ্রহণযোগ্য রাবি ইবনুল মার‍যুবান (মৃ. ৩০৯ হি.) ও আব্বাসি কবি আবুল আব্বাস নাশি (মৃ. ২৯৩ হি.) শাদাবর্ণের উপর কালোর শ্রেষ্ঠত্ব নিয়া বই লেখছিলেন।

 

৮. নুজহাতুল মুতা`আম্মিল ওয়া মুরশিদুল মুতা`আহহিল। এই বইতে বিয়ে সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়া আলাপ করা হইছে। বইটা ৯ অধ্যায়ে সাজানো। এই ৯ অধ্যায়ে কোরআন, হাদিস, আসার ও অন্যান্য উপাদান ইউজ কইরা বিয়ের উপকার, অপকার, বিয়ের প্রস্তুতি, পাত্র-পাত্রী নির্বাচন, বউয়ের কাছে বরের ও বরের কাছে বউয়ের অধিকার, ওলিমা, সঙ্গম, বাসর রাত ইত্যাদির আদবসহ আরো নানা বিষয়ে আলাপ করা হইছে। বইটারে এ যুগের বিবাহ ম্যানুয়াল জাতীয় লিটারেচারের সাথে (স্বামী-স্ত্রীর মধুর মিলন ইত্যাদি) তুলনা করা যায়। তবে পার্থক্য এই যে, বইটা লেখছেন দ্য গ্রেট সুয়ুতি। বইটার আরো একটা উল্লেখযোগ্য দিক হইল, বইটাতে আলাদা একটা অধ্যায়ে স্বামীর উপর স্ত্রীর অধিকার নিয়া আলাপ করা হইছে; আর এই সূত্রে বিভিন্ন অনালোচিত ও বিরল হাদিস ও ঘটনার রেফারেন্স আনা হইছে।

 

এছাড়া এই শাস্ত্রে আরো কিছু বই লেখছেন সুয়ুতি। যথা:
৯. আল ইফসাহ ফি আসমাইন নিকাহ। বইটার মূল বিষয়বস্তু ভাষাতত্ত্ব; বিবাহ, সঙ্গম ও যৌনতা বুঝাইতে আরবি ভাষায় ব্যবহৃত বিচিত্র শব্দের লিস্ট আছে এই বইতে।

 

১০. দওউস সাবাহ ফি লুগাতিন নিকাহ। এইটাও একই বিষয়ে লেখা।

 

এরমধ্যে কিছু কিছু বই, যেমন: ইফসাহ, দওউস সাবাহ, নাওয়াদিরুল আইক, আল ভিশাহ, শাকাইক— এগুলার বিষয়বস্তু ও কন্টেন্ট সিমিলার এবং রিপিটেড। সম্ভবত, সুয়ুতির অপ্রকাশিত ও অসমাপ্ত ম্যাগনাম ওপাস ‘মাবাসিমুল মিলাহ’ থেকে বিভিন্ন কায়দায় সংক্ষেপ কইরা, একেক বইতে একেক ধরনে ও পদ্ধতিতে তথ্য যোগ-বিয়োগ কইরা, এসব বই প্রস্তুত করা হইছে। ফলে বইগুলার কন্টেন্ট প্রায় সিমিলার।

 

৪.
সুয়ুতির দিকে সম্পৃক্ত এই বিষয়ক এমন অনেক বই আছে, যেগুলা সুয়ুতির লেখা না। যেমন: আল ইযাহ ফি ইলমিন নিকাহ। এই বইয়ের লেখক হিশাবে আরো দুইজনের নাম পাওয়া যায়। এই বইয়ের কন্টেন্ট, ফর্ম ও অন্যান্য বিষয় ব্যাখ্যা কইরা জাক্কো হামিন আন্তিলা দেখাইছেন যে, বইটা সুয়ুতির না হওয়াই যুক্তিযুক্ত (দেখুন: জাক্কো হামিন আন্তিলা, আস-সুয়ুতি অ্যান্ড ইরোটিক লিটারেচার (‘সুয়ুতি: আ পলিম্যাথ অফ দ্য মামলুল পিরিয়ড’ বইতে সন্নিবেশিত), পৃ. ২২৭-২৪২)

 

তবে, ক্ল্যাসিক ও আধুনিক যুগের অনেক স্কলার আরো কিছু বইয়ের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করছেন যে, এগুলা সুয়ুতির কিনা। জর্দানের মুতা ইউনিভার্সিটির আরবি বিভাগের অধ্যাপক সামির দ্রৌবি লিখেছেন যে, ‘আল ভিশাহ’, ‘য়াওয়াকিত’, ‘রশফুয যুলাল’ ও ‘শাকাইকুল গুনজ’ ছাড়া এই শাস্ত্রে আর কোন বই-ই সুয়ুতি লেখেন নাই। বাকি যেসব বই ওনার নামে চালু, সেগুলা অন্য কারও লেখা। (দেখুন: আস-সুয়ুতি ওয়া রিসালাতুহু ‘ফিহরিস্তু মু`আল্লাফাতি’, পৃ. ৪৮-৪৯)।

 

এই বক্তব্যের ভিত্তিতে অনেকে বলেন যে, ‘নাওয়াদিরুল আইক’ সুয়ুতির লেখা বই না। কিন্তু, এই অনুমান নির্ভুল বা নিশ্চিত না। কারণ, এই বই সুয়ুতির না হওয়ার পক্ষে যেসব যুক্তি দেওয়া হয়, সেগুলা দুর্বল৷ যুক্তিগুলা হইল:

 

১. সুয়ুতির নিজের লেখা অটোবিবলিওগ্রাফিতে এই বইয়ের নাম নাই। এটা দুর্বল যুক্তি কারণ, সুয়ুতির ‘আল ভিশাহ’র নামও তার অটোবিবলিওগ্রাফিতে নাই; অথচ এই বই সন্দেহাতীতভাবে তারই (আন্তিলা, প্রাগুক্ত, পৃ. ২২৮)।

 

২. এই বইয়ের কন্টেন্ট সুয়ুতির মত একজন আলেমের পক্ষে লেখা অযৌক্তিক ও অশোভনীয়। এই যুক্তি আরো দুর্বল। কারণ, এই শাস্ত্রে যেসব বই সুয়ুতির লেখা হিশাবে সর্বজনস্বীকৃত, সেসব বইয়ের কন্টেন্ট প্রায় হুবহু এই বইয়ের মতই। ফলে, সুয়ুতির মত আলেম এমন বই লিখতে পারেন না, এটা দুর্বল যুক্তি৷

 

আমরা বিশেষত এই বইয়ের পক্ষে, এবং ইন জেনারেল সামির দ্রৌবির মতের বিপক্ষে পালটা কিছু কাউন্টার আর্গুমেন্ট খাড়া করতে চাই। সেগুলা হইল:

 

১. ‘নাওয়াদিরুল আইক’ যে সুয়ুতিরই লেখা, তা এর রচনাশৈলী ও কন্টেন্ট বিশ্লেষণ করলে ভালভাবেই বোঝা যায়। কারণ, এই বইয়ের কন্টেন্ট প্রায় হুবহু ‘আল ভিশাহ’র মতই।

 

২. বইয়ের ভূমিকায় লেখা আছে যে, এই বই ‘আল ভিশাহ’র পরিশিষ্ট হিশেবে লেখা (পৃ. ৩১)।

 

৩. গবেষক জাক্কো হামিন আন্তিলা তার পূর্বোল্লেখিত প্রবন্ধেও দেখাইছেন যে, এই বই সুয়ুতিরই লেখা।

 

৪. ‘আল মুস্তাজরাফ মিন আখবারিল জাওয়ারি’ বইতে সুয়ুতি পষ্টই তার নিজের লেখা হিশেবে এই বইয়ের রেফারেন্স ইউজ করছেন (পৃ. ২৬)। আর ‘আল মুস্তাজরাফ’ যে তারই রচনা, এ ব্যাপারে তিনি নিজেই সাক্ষ্য দিছেন।

 

৫. সামির দ্রৌবি এই শাস্ত্রের ৪ টা বইরে সুয়ুতির লেখা বইলা রায় দিছেন, তার বাইরেও এমন বই আছে, যা সুয়ুতির লেখা হিশেবে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। যেমন, সুয়ুতি তার ‘আল ভিশাহ’র ভূমিকায় এই শাস্ত্রে নিজের লেখা অন্য যে বইগুলার নাম বলছেন, তারমধ্যে একটা হইল: আল ইফসাহ ফি আসমাইন নিকাহ (পৃ. ৩৪)। এছাড়া, ‘মাবাসিমুল মিলাহ’ নামের ম্যাগনাম ওপাস তো আছেই। ফলে সুয়ুতির নিজের বক্তব্যমতেই, দ্রৌবির উল্লেখিত ৪ বইয়ের বাইরেও, এই শাস্ত্রে সুয়ুতির লেখা আরো বই থাকার সম্ভাবনাই বেশি।

 

৬. সুয়ুতি তার নিজের লেখা বইয়ের যে লিস্ট নিজেই বানায়ে গেছেন, যার নাম ‘ফিহরিস্তু মু`আল্লাফাতি’, সেখানে ‘নুজহাতুল মুতা`আম্মিল’ বাদে, এই লেখায় উল্লেখিত আর সবগুলা বইয়ের নামই পাওয়া যায়।

 

মূলত, এই শাস্ত্রে সুয়ুতির লেখা বইগুলার কন্টেন্ট অপছন্দ করার কারণেই, আধুনিক যুগের অনেক ধর্মীয় স্কলার এগুলারে সুয়ুতির লেখা হিশাবে মানতে অস্বীকৃতি জানাইছেন। যেহেতু সুয়ুতির নামে প্রচলিত কিছু জাল বইয়ের নজির বিদ্যমান, ফলে তারা ওই বইগুলার সূত্র ধইরা এমন আরো অনেক বইরে নাকচ করছেন, যেগুলা স্পষ্টতই সুয়ুতির রচনা। বাকিটা আল্লাহ জানেন।

 

লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক