তুহিন খানের গদ্য ‘আইসিস-তালেবান যুদ্ধ সহসাই শেষ হওয়ার নয়’
প্রকাশিত : আগস্ট ২৭, ২০২১
সো, আইএস ইজ ইন দ্য সিন এগেইন। তালেবান-আইএস দ্বন্দ্ব ভবিষ্যত আফগানিস্তানের প্রধান দ্বন্দ্ব হইতে পারে, অনেকেই এমন ধারণা করছেন। এমনকি, ২০১৫ সাল থেকে সিআইএ আইএসরে এই অঞ্চলে হেল্প করতেছে, এমন অভিযোগও আছে। ২০১৮ সালের জুনে, রাশিয়ার সাথে তালেবানের মিটিং হয়। এই মিটিংয়ে রাশিয়া আইএসের বিরুদ্ধে তালেবানরে হেল্প করার আশ্বাস দিলে, ইউএসের তৎকালীন এসিস্ট্যান্ট স্টেট সেক্রেটারি এলিস ওয়েলস রাশিয়ার এই পদক্ষেপের বিরোধিতা কইরা স্টেটমেন্ট দেন। যদিও, এই ধরনের স্টেটমেন্ট খুবই ডিপ্লোমেটিক হওয়ার সম্ভাবনা আছে, কিন্তু তালেবানবিরোধী হিশেবে খোরাসান আইএসের সাথে ইউএস ও আফগান গভমেন্টের এক ধরনের সখ্য যে ছিল, তা অস্বীকার করার উপায় নাই।
আফগানিস্তানে আইএস কারা? আফগানিস্তান আইএস কাঠামো ও চরিত্রে বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ। বেসিক্যালি, পাকিস্তানের টিটিপি, সেন্ট্রাল এশিয়ার দায়েশ রিক্রুটমেন্ট, তালেবানের বিভিন্ন বিদ্রোহী গ্রুপ, আফগানিস্তানে অবস্থানরত বিভিন্ন গ্লোবাল জিহাদিস্ট মুভমেন্ট— এরাই আফগানিস্তানে আইএস ও আইএসের মিত্র। এই আমব্রেলা প্লাটফর্মটাই ২০১৫ থেকে, নানা ইস্যুতে তালেবানের সাথে যুদ্ধ করে আসতেছে।
আফগানিস্তানে আইএসের জন্ম ২০১৫-র জানুয়ারিতেই। ২০১৫ সালের ১০ জানুয়ারি `আইএস-বিলায়াতে খোরাসান`র জন্ম হয়। টিটিপির টপ লিডার হাফিজ সাইদ খানরে মেইন লিফার ও এক্স তালেবান লিডার আব্দুর রউফ আলিজারে ডেপুটি লিডার ঘোষণা দিয়া, আবু বকর বাগদাদির হাতে ছয়জন লোকের বাইয়াত নেওয়ার একটা ভিডিও ভাইরাল হইছিল তখন। আস্তে আস্তে আইএস নানগারহার, কুনার, লোগারসহ আরো কিছু প্রদেশে শক্তিশালী হইতে থাকে।
মিনহোয়াইল, তালেবানের ভিতরেই কয়েকটা ইস্যু লইয়া শুরু হইছিল দ্বন্দ্ব। ইস্যুগুলা এইরকম:
১. মোল্লা ওমরের পরে লিডারশিপ ক্রাইসিস।
২. আমেরিকা ও আফগান সরকারের সাথে পিস টকের দিকে তালেবানের ঝোঁক।
৩. `জিহাদ` ছাইড়া পলিটিক্সের দিকে ঝোঁকা, কাতারে পলিটিকাল অফিস খোলা।
৪. ইরানের সাথে সম্পর্ক তৈরি।
৫. তালেবানদের জাতিবাদী মনোভাব এবং গ্লোবাল জিহাদের ন্যারেটিভের বাইরে গিয়া, রেজিওনালি সরকার গঠনের উদ্যোগ। ইত্যাদি।
এইসব ইস্যুতে বেশ কয়েকটা ফ্রাকশন তালেবানের লিডারশিপ মানতে অস্বীকার করে। যেমন:
১. আব্দুর রউফ আলিজা। তালেবানের প্রথম শাসনামলে, ইনি ছিলেন আইএসের স্ট্রংহোল্ড কুনার প্রদেশের গভর্নর। আমেরিকার আফগান আক্রমনের পরে তারে গুয়েন্তানামো বে কারাগারে নেওয়া হয়। ছাড়া পাওয়ার পরে, আফগানিস্তানে ফিরা, কিছুদিন তালেবানের সাথে থাকলেও, পরে ইনি ডেপুটি লিডার হিশাবে আইএসে যোগ দেন।
২. মুহাম্মদ রসুল। তালেবানের প্রথম শাসনামলে নিমরুয প্রদেশের গভর্নর ছিলেন ইনি। পশতুনদের মধ্যে যারা তালেবানবিরোধী, তাদের প্রতি কঠোরতার অভিযোগ আছে এর বিরুদ্ধে। এছাড়া, নিমরুযের বর্ডার এরিয়ায় ড্রাগ স্মাগলিংয়ের চেইনগুলা উনিই হ্যান্ডেল করতেন, এবং সেখান থেকে উনি বেশ মোটা অঙ্কের দৌলত কামাইছেন মর্মে শক্ত অভিযোগ আছে।
রাসুলের বর্তমান দলের নাম `হাই কাউন্সিল অব আফগানিস্তান ইসলামিক আমিরাত`। মোল্লা ওমরের মৃত্যুর পরে, তালেবান হেড হিশাবে মোল্লা মানসুরের অভিষেক নিয়া ২০১৬ সালে তালেবানের সাথে তার দ্বন্দ্ব হয় এবং যুদ্ধ শুরু হয়। হাই কাউন্সিল `আইএস` ও `আল কায়েদা`রে আফগানিস্তানে ওয়েলকাম জানানোর ব্যাপারটা অস্বীকার করলেও, তারা গোপনে গোপনে আইএসের অ্যালাই। অন্যদিকে, আফগান গভমেন্টও গোপনে এই রাসুল-গ্রুপরে হেল্প করছে। ২০১৯ সালে তারা তালেবান চিফ হিবাতুল্লাহ আখুন্দযাদাহর উপর বোমা হামলা চালায়; এই হামলায় হিবাতুল্লাহর বাবা ও ভাই নিহত হয়।
৩. মোল্লা দাদুল্লাহ ফ্রন্ট। বিখ্যাত তালেবান লিডার মোল্লা দাদুল্লাহর গ্রুপ এইটা। ২০১৫ সালে মোল্লা মানসুরের অভিষেক মাইনা নিতে না পাইরা, বিদ্রোহ ঘোষণা করে দাদুল্লাহ ফ্রন্টের তৎকালীন লিডার, মোল্লা দাদুল্লাহর ভাই মানসুর দাদুল্লাহ। জাবুল প্রদেশে তালেবান ও দাদুল্লাহ গ্রুপের মধ্যে যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধ চলাকালে, দাদুল্লাহ সদ্যগঠিত আইএসের হেল্প পায়। যদিও যুদ্ধে সে পরাজিত ও নিহত হয়।
৪. ফিদায়ে মহয। এইটা দাদুল্লাহ ফ্রন্টেরই একটা ফ্রাকশন। মোল্লা নাজিবুল্লাহ এই গ্রুপের লিডার। এরা আফগানিস্তানে তালেবানের বর্তমান পলিসির কট্টর বিরোধী। মোল্লা মানসুরের অভিষেক, তালেবানের ক্রমে ক্রমে জিহাদিস্ট থেকে পলিটিকাল হইতে চাওয়া, কাতারে পলিটিকাল অফিস খোলা, জাতিবাদী মনোভাব, ইরানের সাপোর্ট নেওয়াসহ আরো বিভিন্ন ইস্যুতে তালেবানের সাথে এদের দ্বন্দ্ব হয়। এদের নেতা নাজিবুল্লাহর মতে, মোল্লা মানসুর মোল্লা ওমররে বিষ দিয়ে খুন করছে, এবং তালেবান মুভমেন্ট হাইজাক করছে।
২০১৭ সালে আফগান-ইরান বর্ডারে আইএস-তালেবানের মধ্যে সবচাইতে ভয়াবহ সংঘর্ষটা হয়। এতে দুইপক্ষের প্রায় ২৩ জন মারা যায়। এই হামলার কয়েকদিন আগেই, ইরানের সাথে সিক্যুরিটি ইস্যুতে মিটিং করে তালেবান লিডারশিপ। আইএস ও ফিদায়ে মহযের দাবিমতে, ইরানের সামরিক ও ইকোনমিক সাপোর্ট নিয়া, তাদের সাথে যৌথভাবে এই হামলা করছে তালেবান। ইরান ও রাশিয়া আইএসবিরোধী। ফলে ইরান ও রাশিয়ার সাথে তালেবানের সম্পর্ক একদিকে আইএস ও তার অ্যালাইদের জন্য হুমকির কারণ হইছে। অন্যদিকে ইউএসও এই বিষয়গুলা পছন্দ করে নাই।
এর বাইরে, গ্লোবাল জিহাদিস্ট অর্গানাইজেশনগুলার মধ্যে ইসলামিক মুভমেন্ট অব উযবেকিস্তান IMU এবং ইসলামিক রেনেসাঁ পার্টি অব তাজিকিস্তান IRPT ও আফগানিস্তানে দায়েশের মিত্র।
দায়েশের সাথে তালেবানের দ্বন্দ্ব কী?
ইডিওলজিকাল দ্বন্দ্বগুলা তো আছেই। দায়েশ বেসিক্যালি নজদি-ওহাবি ধারার চরমপন্থী তাকফিরি দল, গ্লোবাল জিহাদের মতবাদে বিশ্বাসী। এছাড়া, `কাফের` আর `কাফেরের সহযোগী মুসলিম`— এদের মধ্যে কোন ভেদ করে না আইএস; বরং দ্বিতীয় দলরে আগে খুন করা উচিত বইলা মনে করে। মার্ক্সবাদের ভাষায় বললে, এইটাই তাদের পার্টি লাইন। বিশ্বব্যাপী এখন তারা `খারেজি` নামে পরিচিত; যদিও বাঙলাদেশে এখনো তাদের সাপোর্টার আছে। অন্যদিকে, তালেবান ধর্মীয় আদর্শের দিক দিয়া দেওবন্দি হানাফি, তালেবান মুভমেন্টের সাথে পশতুন জাতিবাদের সম্পর্ক খুব গাঢ়, তালেবান পলিটিকাল ফোর্স হিশাবে স্বীকৃতি পাইতে ও ক্ষমতায় গিয়া আফগান রাষ্ট্র চালাইতে আগ্রহী। এছাড়া, দায়েশের পার্টি লাইনের সাথেও বিস্তর ফারাক তালেবানের।
এছাড়া, যেহেতু তালেবান এখন আফগানিস্তানের ক্ষমতাভোগী দল, ফলে আফগানে অবস্থিত অন্যান্য জিহাদি গ্রুপ হয় ক্ষমতায় ভাগ চাইবে, নতুবা তালেবানের পার্টি লাইনের বিরোধিতা করবে— এইটাই স্বাভাবিক। এই সংঘর্ষের অর্থনৈতিক দিকও আছে। আফিমের চালান ও আফিম ব্যবসার উপর আধিপত্য বিস্তার নিয়াও ২০১৭ সালে, তালেবান-আইএস সংঘর্ষ হইছে।
২০১৮ সালে আইএসের বিরুদ্ধে জযওয়ান প্রদেশে যুদ্ধ ঘোষণা করে তালেবান। এই যুদ্ধে আইএস ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও পরাজিত হয়; নানগারহারের দুইটামাত্র গ্রাম তাদের হাতে থাকে। আইএস এই সময় তালেবানের হাত থেকে তাদের রক্ষা করার শর্তে, আফগান গভমেন্টের কাছে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দেয়। আফগান এয়ার ফোর্স তালেবানের উপর এয়ার অ্যাটাক করে; বিনিময়ে প্রায় ২০০ আইএস সেনা আফগান প্রশাসনের হাতে আত্মসমর্পণ করে। আইএসের সাথে আফগান গভমেন্টের এই ডিল, আত্মসমর্পণ এবং পরবর্তী আরো কিছু ইস্যু নিয়া সেসময় নানা প্রশ্ন উঠছিল৷
কাবুল অ্যাটাক অ্যান্ড আফটারম্যাথ
কাবুল এয়ারপোর্ট অ্যাটাকে এখন পর্যন্ত শতাধিক নিহত হইছে; আমেরিকান সেনা আছে ১৩ জন। স্বাভাবিকভাবেই, পশ্চিমা মিডিয়ায় প্রশ্ন উঠছে— তালেবানের আফগানিস্তানে আল কায়েদা বা আইএস নিজেদের আবারো শক্তিশালী করার সুযোগ পাবে কিনা? তালেবান গ্লোবাল জিহাদিস্টদের হেল্প করবে কিনা? সামনের দিনে এইটাই হবে তালেবানের জন্য ডিসাইসিভ চ্যালেঞ্জ। যদিও এই হামলার সাথে অনেকেই হাক্কানি নেটওয়ার্কের লিংক দেখছেন, আমার ধারণা তালেবান এতে জড়িত না। যেকোন বিবেচনায়ই এইটা তালেবানের জন্য আত্মঘাতী। তাছাড়া, ইউএস, ইউকে ও অস্ট্রেলিয়ান এম্বেসিতে আগেই জানানো হইছে হামলার ব্যাপারে, সতর্ক করা হইছে৷ তারা কি ঘটনাস্থলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিছিল? সেটাও জটিল এক প্রশ্ন।
তবে, এই হামলার মাধ্যমে তালেবান গভমেন্টরে চ্যালেঞ্জ করল আইএসসহ অন্যান্য গ্লোবাল জিহাদিস্টরা। তালেবান যদি আফগানিস্তানে শান্তি আনতে চায়, একটা স্ট্যাবল গভমেন্ট ফর্ম করতে চায়, তাইলে এদের যেকোন মূল্যে থামাইতে হবে। তালেবানশাসিত আফগানে এদের যেকোন মুভমেন্ট, একদিকে তালেবান গভমেন্টের ব্যর্থতা, অন্যদিকে তাদের ধর্মীয় অথরিটির গ্রহণযোগ্যতারে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। অন্যদিকে, এই সংগঠনগুলা তালেবানশাসিত আফগানে নিজেদের আরো শক্তিশালী করতে চাইবে। তালেবানের ভিতরেও হয়ত, এই দলগুলার ব্যাপারে গৃহীত পলিসি নিয়া দ্বন্দ্ব-বিবাদ হবে। কারণ, উপরে উপরে অস্বীকার করলেও, তালেবানের বিভিন্ন গ্রুপের সাথে আল-কায়েদা ও অন্যান্য গ্লোবাল জিহাদিস্ট গ্রুপের সম্পর্ক এখনো বেশ গভীর৷ ফলে, এদের ব্যাপারে পলিসি গ্রহণের ক্ষেত্রে, অন্তর্দ্বন্দ্বের মুখে পড়তে পারে তালেবান।
তালেবান কাবুল এয়ারপোর্টের অ্যাটাকরে কনডেম করছে, এবং `ইভিল সার্কেল`গুলারে পরাজিত করার ঘোষণা দিছে। কিন্তু এই ইভিল সার্কেলের রুট তালেবানের ভিতরেও থাকতে পারে। ফলে ফিউচার আফগানে, গ্লোবাল জিহাদিস্ট গ্রুপস লাইক ETIM, IMU, ISMT, ISIS অর আল কায়েদা, তালেবান শাসনের জন্য বড় থ্রেট/ডিলেমা হয়ে দাঁড়াবে। তারা যদি তালেবানের আনুকূল্য পায়, আফগানিস্তানরে বেজ হিশেবে ইউজ করে ইওরোপে হামলা চালাইতে চায়, তাইলে তালেবান গভমেন্ট স্ট্যাবল হইতে পারবে না। অন্যদিকে, যদি তারা আফগানিস্তানের ভিতরেই হামলা চালাইতে থাকে, সেক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা বিধানের দায়িত্ব তালেবানের নেওয়া লাগবে, অ্যাজ আ গভমেন্ট। তখন এদের ব্যাপারে গভমেন্ট পলিসি নেওয়া লাগবে, এদের দমন করা লাগবে। নাইলে দেশের মধ্যেই তালেবানের জনপ্রিয়তা কমতে থাকবে।
আপাতত এই হইল পরিস্থিতি৷ অবস্থাদৃষ্টে মনে হইতেছে, আইসিস-তালেবান যুদ্ধ সহসাই শেষ হওয়ার নয়। তবে ফারাক এই যে, এবার তালেবান আর `যোদ্ধা` বা `ইনসারজেন্ট` না, তারাই আফগান গভমেন্ট। ফলে, তাদের অ্যালাই হবে দেশের পলিটিকাল দল ও লিডাররা; গভমেন্টবিরোধী জিহাদিরা না। ফলে তালেবানের সামনে জটিল রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বৈধতার সংকট তৈয়ার হইতে পারে। অন্যদিকে, গ্লোবাল জিহাদিস্টদের দিয়া তালেবান যদি প্রক্সি ওয়র চালায়, তাইলে আজ হোক কাল হোক, এর ফল ভোগ করা লাগবে, লাইক পাকিস্তান। আবার, আমেরিকাও আইএস ও অন্যান্য গ্রুপ দিয়া এই অঞ্চলে প্রক্সি ওয়র চালানোর ট্রাই করতে পারে। ফলে, নতুন তালেবান গ্লোবাল জিহাদিস্ট নেটওয়ার্করে কীভাবে ডিল করে, এর উপরেই ভবিষ্যত আফগানের রাজনীতির অনেককিছু নির্ভরশীল।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক