তালেবানরা বিরাট সন্ত্রাসী, তাদের যেন আর কোনো পরিচয় নেই

পর্ব ১৭

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২১

সাহসী মোল্লা ওমর ছিলেন গরিবের সন্তান, তার ওপর মানুষের বিশ্বাস তৈরি হলো। এদের সঙ্গে যোগ দিলেন সাবেক সমাজতন্ত্রী দলের লোকজনরাও। ব্যবসায়ীদের অর্থে, অন্যদিকে প্রবল আদর্শবোধে উদ্দীপ্ত তিরিশ জন ছাত্রের সংখ্যা বেড়ে গেল। বিভিন্ন এলাকা থেকে দ্রুত ছাত্র আর বিভিন্ন বয়সের যোদ্ধারা এসে উপস্থিত হলেন মোল্লার দলে। সঙ্গে বয়স্ক পাঠান যোদ্ধারাও। অন্যদিকে ১৯৯৬ সালে কান্দাহারের শিক্ষক ছাত্ররা মিলে স্থানীয় বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া দুই বালিকাকে উদ্ধার করলো। সেই ঘটনাটাই সাড়া ফেলে দিয়েছিল। ফলে মোল্লা ওমরের দলটার নাম হয়ে গেল তালিবান। কিন্তু ছাত্ররা ছাড়া সেখানে আরো ছিল বিভিন্ন বয়সের আর বিভিন্ন পেশার মানুষ।

১৯৯৬ সালের তেশরা এপ্রিল মীর মুহাম্মাদ ওমর নির্বাচিত হলেন আমির-উল-মোমেনীন বা মুসলিমদের সর্বোচ্চ নেতা। এক হাজার মোল্লা তাকে নির্বাচিত করলেন এই পদে। যখন মোল্লা ওমরের উত্থান হচ্ছিল, তখন হেকমতিয়ার ১৯৯৬ সালের ১৯ জুন দ্বিতীয়বার রাব্বানী সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করলেন। এরই মধ্যে নিত্যনতুন বিজয়ের খবর আসতে লাগল তালিবানদের। তখন পর্যন্ত কোথাও হারেনি তারা। ১৯৯৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর কাবুলের পূর্ণ দখল নিল তালিবান বাহিনী। কাবুল ছেড়ে পালালেন রাব্বানী-হেকমতিয়ার-মাসুদ। মাত্র তিন মাস প্রধানমন্ত্রী থাকতে পেরেছিলেন হেকমতিয়ার। কাবুলে রাব্বানী শাসনের পতনের পর সারা আফগানিস্তানে শুরু হলো তালিবানদের শাসন। তালিবানরা ক্ষমতায় এসেই গৃহবন্দী নাজিবুল্লাহকে ল্যাম্পপোস্টে ঝুলিয়ে ফাঁসি দিয়েছিল।

যখন তালিবানরা ক্ষমতা দখল করে তখন তাদের মদত দিতে থাকলেন পাকিস্তান-সৌদি আরব। তাদের পেছনে সিআইএ। কিছুদিনের মধ্যে সিআইএ-র বিরুদ্ধেই অস্ত্র উঁচিয়ে ধরলো তালিবানরা। রুশ সেনাদের বিরুদ্ধে আক্রমণকালে সিআইএ-র সাহায্য দরকার ছিল মুজাহিদিনদের। কিন্তু নতুন যোদ্ধা বাহিনী তালিবানদের আমেরিকার সাহায্য দরকার ছিল না। কারণ তাদের প্রতিপক্ষের তিনপক্ষই তখন পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ক্ষতবিক্ষত। রুশ সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সময় মুজাহিদিনদের ক্ষমতা দখলের মূলে ছিল তাঁদের আদর্শ। রুশরা ক্ষমতা ছেড়ে চলে যাবার পর যা মার্কিন-উস্কানী আর নানা কারণে ভিন্নখাতে প্রবাহিত হয়েছিল। নতুন যোদ্ধা তালিবানদের কাছে সবচেয়ে বড় অস্ত্র তাদের আদর্শ, সমাজের মানুষের প্রতি দায়বোধ।

অন্যরা যখন ক্ষমতার অপব্যবহারের জন্য ক্ষমতা পেতে চাইছিল, তালিবানরা তখন ক্ষমতা পেতে চেয়েছে তাদের আদর্শ বাস্তবায়ন করতে। হতে পারে সে আদর্শ ধর্মীয় গোড়ামি দ্বারা পরিপূর্ণ বা হতে পারে অনেকের দৃষ্টিতে তা পশ্চাদপদ। রাব্বানী মাসুদরা যখন ক্ষমতা লাভ করে তখন কাবুলেই ব্যস্ত ছিল। জনগণের বহু সমস্যার তাঁরা সমাধান দিতে পারেননি। তাঁদের শাসনে বিভিন্ন এলাকায় তৈরি হয়েছিল স্থানীয় যুদ্ধবাজদের রাজত্ব। এরা হয়ে উঠেছিলেন স্বৈরাচারী, দুর্নীতিগ্রস্ত এবং মাদক ব্যবসায়ী। এঁরা নতুন ক্ষমতা পেয়ে পুরানো জেহাদের কথা ভুলে গেছেন তখন। নিজেদের ব্যক্তিগত ক্ষমতা, প্রতিপত্তি আর সম্পদ বাড়াবার জন্য তখন তাঁরা হানাহানিতে লিপ্ত। বিনয় নয়, অহংকারই হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাঁদের ভূষণ। সুতরাং জনমানসে তাঁদের বিরুদ্ধে দেখা দিয়েছিল তীব্র অনন্তোষ।

তালিবানরা তখন সাধারণ মানুষের বন্ধু হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। ব্যবসায়ীদের মদতপুষ্ঠ তালিবানরা প্রথমেই মহাসড়ক জুড়ে অত্যাচার আর লুটতরাজ বন্ধ করে। বন্ধ করে মাদকের ব্যবসা, চুরি আর ধর্ষণ। বিন লাদেন এসময়ে তালিবান নেতা মোল্লা ওমরে পাশে এসে দাঁড়ান। তিনি নিজের কোনো স্বার্থ ছাড়াই প্রায় দুই হাজার টয়োটা হাইলাক্স পাঠান ওমরের সাহায্যার্থে। তিনি হয়ে ওঠেন ওমরের পরামর্শদাতা বন্ধু। তালিবানদের নীতি আর আদর্শকে রুখতে পারলো না কেউ। এটা তো সত্যি, আদর্শসম্পন্ন ব্যক্তিদের পরাজিত করা খুব কঠিন। ফলে আদর্শ রক্ষার জন্য যা পেরেছে তালিবানরা, তা পারেনি দস্তুম, রাব্বানী-মাসুদ বা হেকমতিয়ার; কারণ তাঁরা সকলেই লড়েছিল নিজেদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার জন্য। সেখানে তালিবানরা প্রতিষ্ঠাতা করতে চেয়েছে আল্লাহর হুকুমত বা ইসলাম ধর্মের ন্যায়। তালিবানরা ক্ষমতা দখল করলেও কিন্তু তখনো তিন গোষ্ঠীর লড়াইটা থেমে থাকেনি।

নতুন তালিবান সরকারকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র এই সহযোগিতার হাত বাড়ায় নিজেদের স্বার্থে। বারবারা এরেনরিখের এক লেখা থেকে জানা যায়, বুশ তালিবান সরকারকে আফিম চাষ বন্ধ করার জন্য অভিনন্দিত করেন। তিনি তেতাল্লিশ মিলিয়ন ডলারের একটি চেক তখন তালেবানদের হাতে তুলে দেন। ভিন্ন দিকে লাদেন তখন নতুন সঙ্কট তৈরি করে ফেললেন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য। লাদেন আফগানিস্তানে মার্কিন যোগসাজশে রুশ শক্তির বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে এটা উপলব্ধি করেছিলেন, তাঁর নিজের দেশ সৌদি আরব মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দখলে। যিনি আফগানিস্তানের মুসলমানদের রুশ সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে মুক্ত করতে নিজের জীবন বিপন্ন করতে প্রস্তুত ছিলেন, তিনি নিজের দেশে মার্কিনদের দৌরাত্ম্য মানতে আর রাজি ছিলেন না। ১৯৯০ সালেই তিনি মাতৃভূমি সৌদি আরবে ফিরে সৌদি রাজার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন।

এই সময় থেকেই তিনি হয়ে ওঠেন কট্টর আমেরিকা বিরোধী। তিনি সৌদি আরবে ডাক দিলেন মার্কিন আধিপত্য থেকে সৌদি আরবকে রক্ষা করার। ফলে বিরোধ বাধল তাঁর সঙ্গে সৌদি আরবের শাসক গোষ্ঠীর, তিনি নির্বাসিত হলেন সৌদি আরব থেকে। গেলেন সুদানে, গড়ে তুললেন সুদান বন্দর সড়ক। বিনিয়োগ করলেন কৃষিতে। ১৯৯৬ সালে সুদান ছাড়তে হলো তাঁকে আমেরিকার চাপে। সেখান থেকে গেলেন দক্ষিণ ইয়েমেনে, একই সঙ্গে তাঁর ঠিকানা হলো আফগানিস্তান।  বিভিন্ন রকম সন্ত্রাসী কার্যক্রমের দায় তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাপিয়ে দিল লাদেনের উপর প্রমাণপত্র ছাড়াই। লাদেন তখন বললেন, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী। ক্লিনটন লাদেনকে হত্যার বহু চেষ্টা করেন। লাদেনের মাথার দাম ঘোষিত হয় পাঁচ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু লাদেনকে হত্যা করা গেল না, বরং বেড়ে গেল তাঁর জনপ্রিয়তা। সেই সময়ে লাদেনের পক্ষে আফগান পণ্ডিত আবদুর রহিম ঘোষণা করলেন, ক্লিনটনের মাথা এনে দাও তাহলে পাবে পাঁচ মিলিয়ন আফগানি।

তালিবান সরকারের অতিথি তখন লাদেন। যুক্তরাষ্ট্র দাবি করলো লাদেনকে তাদের হাতে তুলে দিতে। তালিবান সরকার রাজি হলো না। আফগানিস্তানের পশতুনদের পুরানো ঐতিহ্য এটা, অতিথির প্রতি সম্মান। যুক্তরাষ্ট্রকে তালিবানরা বললো, প্রমাণপত্র দাও লাদেন অপরাধী; তাহলে আমরাই তার বিচার করবো। যুক্তরাষ্ট্র প্রমাণ দিতে রাজি নয়। বরং বললো, তালিবানদের বিচারে তাদের আস্থা নেই। লাদেনের নিজস্ব সংগঠনের নাম আল কায়দা, যার অর্থ ক্ষেত্র বা ভূমি। আল কায়দার পেছনে কোনো সরকার নেই, তবুও আল কায়দা বিশ্বের বহু সরকারের কাছে ত্রাস। নাইন ইলেভেনের ঘটনায় লাদেনের নাম পুনরায় যুক্ত করে আমেরিকা। কিন্তু কোনো প্রমাণপত্র উপস্থিত করতে পারেনি। লাদেন আর মোল্লা ওমরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র তথা আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে। পাঁচ বছরের শাসনের পর মার্কিন দখলদারদের হাতে উৎখাত হয় তালিবান সরকার। মার্কিন বাহিনী যখন মোল্লা ওমরের বাড়িতে হামলা চালায় তিনি তখন নিজের বাড়িতেই ছিলেন।

পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলি তখন মোল্লা ওমরকে এক পৈশাচিক ব্যক্তিত্বরূপে বিশ্ববাসীর কাছে উপস্থাপন করে। কিন্তু মূল সত্যটা ভিন্ন। তিনি ক্ষমতায় বসেও সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে তাদের খোঁজখবর নিতেন। তালিবান শাসনে তারা শান্তিতে আছেন কিনা জানতে চাইতেন। নব্বইয়ের দশকে যুদ্ধবিধস্ত আফগানিস্তানে আইন-শৃঙ্খলাহীন রাস্তাঘাটের পাশে ওৎ পেতে থাকা যৌনশিকারীদের কঠোর হাতে দমন করে তিনি আফগানবাসীর কাছে কিংবদন্তীতে পরিণত হন। যখন নিজেদের মধ্যে কোনো বিরোধ হতো সকলে ছুটে যেতেন মোল্লা ওমরের কাছে। ঝগড়া মীমাংসার ব্যাপারে তার ছিল অসাধারণ ক্ষমতা। তিনি বেশ রুচিবোধসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। বিশ বছর পর পুনরায় তালিবানদের হাতে এসেছে আফগানিস্তানের ক্ষমতা। যুক্তরাষ্ট্র বাধ্য হয়েছে আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যেতে। মোল্লা ওমর আর তখন বেঁচে নেই, না লাদেন। নতুনভাবে তালিবানরা ক্ষমতায় আসার পর তারা এখন পর্যন্ত তেমন কোনো অঘটন ঘটায়নি, বরং বিভিন্ন রকম সহনশীলতার পরিচয় দিচ্ছে। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব আর তার দালালরা তালিবানদের সম্পর্কে করে চলেছে কুৎসা। নানারকম বানানো অপপ্রচার চালাচ্ছে।

বিশ্বের নানা প্রচারমাধ্যম বলছে, তালিবান শাসন প্রতিষ্ঠা মানে আফগানিস্তান ফিরে যাবে বর্বর যুগে। নারীদের উপরে নেমে আসবে নিষ্ঠুর নির্দয় অত্যাচার। বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে আফগানিস্তানে তালিবান শাসন সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করবে আর তার কুফল ছড়িয়ে পড়বে বিভিন্ন দেশে। কীসের ভিত্তিতে এসব বলা হচ্ছে? তালিবানরা এখন পর্যন্ত কি বাইরের কোনো দেশে গিয়ে আক্রমণ চালিয়েছে? আফগানিস্তানের বৃহত্তর জনগণ কি বলেছে, তারা তালিবান শাসন চায় না? সেরকম কি কোনো তথ্য আছে কারো হাতে যে, জনগণ তালিবান শাসন চায় না? তালিবান শাসন চায় না, এই কথাগুলি উচ্চারিত হচ্ছে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ভোগী বিলাসী কিছু মার্কিন দালাল আফগানদের মুখে। যারা পুরো গ্রামকে. সাধারণ মানুষকে অভুক্ত রেখে রাজধানী কাবুলে বসে ভোগ বিলাসিতা করেছে আর নিজেদের ভোগবিলাস বাড়াবার জন্য মার্কিনদের পদলেহন করেছে। চলবে