সাইয়ীদ রাহমাতুল্লাহ হাশেমী

সাইয়ীদ রাহমাতুল্লাহ হাশেমী

তালেবানরা বিরাট সন্ত্রাসী, তাদের যেন আর কোনো পরিচয় নেই

পর্ব ১০

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০৬, ২০২১

সাইয়ীদ রাহমাতুল্লাহ হাশেমী তালিবানদের ভ্রাম্যমান দূত হিসেবে দুই হাজার এক সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, দীর্ঘ বক্তৃতায় সেখানে তিনি বলেছিলেন, আমরা ১৮ শতকে দুর্যোগ সয়েছি, ১৯ শতকে এবং এখন এই শতকেও চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছি। আমরা ব্রিটিশদের আক্রমণ করিনি। আমরা রুশদের আক্রমণ করিনি। তারাই আমাদের আক্রমণ করেছে। তাহলে দেখেন আফগানিস্তানের সমস্যা আমাদের তৈরি করা নয়। আফগানিস্তানের সাম্প্রতিক সমস্যার সূত্রপাত ঘটে ১৯৭৯ সালে। আফগানিস্তান একটা শান্তিপূর্ণ দেশ ছিল। রুশরা তাদের ১ লাখ ৪০ হাজার সৈন্যসহ ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বর মাসে আফগানিস্তান আক্রমণ করলো, সেখানে এক দশক ধরে থাকলো, পনেরো লাখ মানুষ মেরে ফেললো, আর দশ লাখ মানুষকে পঙ্গু করলো এবং রাশিয়ার সৃশংসতার কারণে পৌনে দু কোটি লোকের মধ্যে ষাট লাখ দেশান্তরী হলো।

তিনি আরও বলেন, আমরা সন্ত্রাসবাদকে পৃষ্ঠপোষকতা করার দায়ে অভিযুক্ত। আর মার্কিনীদের কাছে সন্ত্রাসবাদ কিংবা সন্ত্রাস বলতে বোঝায় কেবল বিন লাদেন। বিন লাদের ১৭ বছর ধরে আফগানিস্তানে আছেন, এমনকি আমাদের তালিবানদের অস্তিত্ব তৈরি হওয়ার ঢের আগে থেকে। বিন লাদেন আফগানিস্তানে ছিলেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন এবং রোনাল্ড রিগ্যান, মার্কিনের তখনকার রাষ্ট্রপতি এবং ডিক চেনি এসব মানুষজনকে বলতেন মুক্তিযোদ্ধা কিংবা বলতেন স্বাধীনতার বীরসন্তান। কারণ এরা তখন তাদের স্বার্থে লড়েছিলেন। এখন যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন টুকরো টুকরো হয়ে গেছে, এসব লোকের আর দরকার নেই এবং তারা সন্ত্রাসবাদীতে রূপান্তরিত হয়েছেন। বীর থেকে সন্ত্রাসবাদী। কারণ তারা রুশদের দখলদারীর যেমন বিরোধিতা করে, একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রের। যুক্তরাষ্ট্রের দখলদারী মেনে নিলেই তালিবানরা হতো তাদের প্রচারে বীরযোদ্ধা আর নারীর ত্রাতা।  

সাইয়ীদ রাহমাতুল্লাহ হাশেমী বলেন কথা হলো, বিন লাদেন যে সকল কর্মকাণ্ডের জন্য অভিযুক্ত তার সঙ্গে ১৯৯৮ সালের আফগানিস্তানে ক্রুজ মিসাইল হামলার পার্থক্য কী? দুটোর কোনোটাই ঘোষিত ছিল না এবং দুটোই সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছে। যদি নির্বিচারে সাধারণ মানুষ মারার প্রসঙ্গ আসে তাহলে দুটোতেই তা ঘটেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার একজন লোককে মারতে চেষ্টা করেছে তাকে ন্যায্য বিচারের সুযোগ পর্যন্ত না দিয়ে। ১৯৯৮ সালে তাদের মনে হলো আর আফগানিস্তানে ক্রুজ মিসাইল পাঠিয়ে দিল এবং তারা ঘোষণা করলো যে তারা ওসামা বিন লাদেনকে মারার চেষ্টা  করেছে। আমরা তখন ওসামা বিন লাদেনকে চিনতাম না। আমি তাকে চিনতাম না। তিনি ছিলেন একজন সাধারণ মানুষ। তাই আমরা সবাই হতভম্ব হয়েছিলাম। অনেকের মতো আমি রাতে বাসায় ছিলাম, আমাকে জরুরি কাউন্সিল সভায় ডেকে পাঠানো হলো এবং বলা হলো যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান আক্রমণ করেছে।

তিনি আরও বলেন, ৭৫টা ক্রুজ মিসাইল দিয়ে তারা একটা মাত্র লোককে মারার চেষ্টা করেছে এবং তারা লোকটাকে পায়নি; অন্যদিকে ১৯ জন ছাত্রকে মেরে ফেলেছে এবং এই হত্যাকাণ্ডের জন্য কখনোই অনুতাপ করেনি।  হাশেমী ক্যালির্ফোনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপস্থিত শ্রোতাদের কাছে প্রশ্ন রাখেন, আপনারা যদি আমাদের জায়গায় থাকতেন তাহলে কী করতেন? যদি আমরা গিয়ে ৭৫টা ক্রুজ মিসাইল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপরে ফেলতাম এবং বলতাম যে আমরা একটা লোককে মারতে গিয়েছিলাম, যাকে আমরা আমাদের দূতাবাস হামলার জন্য দায়ী মনে করেছি এবং আমরা সেই লোকটাকে পাইনি এবং আমরা ১৯ জন মার্কিনকে মেরে ফেলেছি। কী করতো তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র? তাৎক্ষণিকভাবেই যুদ্ধ ডাকতেন আপনারা। কিন্তু আমরা নম্র। আমরা যুদ্ধ ঘোষণা করিনি। বরং এ ব্যাপারে আমরা বরাবরই খোলা মনে ছিলাম। আমরা বলেছি, যদি এই লোকটা সত্যিই কেনিয়া বা তাঞ্জানিয়ার ঘটনাতে জড়িত থাকে, যদি এসব ভয়াবহ ঘটনায় তাঁর জড়িত থাকার দলিল-প্রমাণ কেউ আমাদের দেয়, আমরা তাকে শাস্তি দেব।

হাশেমী বলেন, কেউ আমাদের সামনে কোনো প্রমাণ দিল না। আমরা তাকে ৪৫ দিনের ট্রায়ালে রাখলাম এবং কেউই আমাদের কোনো ধরনের তথ্য-প্রমাণ দিল না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের বললো, আমাদের বিচার ব্যবস্থায় তাদের আস্থা নেই। আমরা হতবাক হয়েছি যে, তাদের বিচার ব্যবস্থাটা তাহলে কোন ধরনের? তারা একটা লোককে মারতে চেষ্টা করেছে কোনো রকমের বিচার পাবার সুযোগ তাকে না দিয়েই। এখানে আমাদের মধ্যে যদি কেউ অপরাধী হয়, পুলিশ গিয়ে তার বাড়িঘর ভাঙতে শুরু করবে না, নিশ্চয় প্রথমে তাকে আদালতে নেবে। তারপরেও আমরা বলে আসছি যে, আপনারা চাইলে, একটি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক দল আফগানিস্তানে এসে এই লোকটির কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করতে পারে; যাতে তিনি কোনো কিছু করতে না পারেন।

তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে বলেন, আফগানিস্তান কোনো সন্ত্রাসী রাষ্ট্র্র নয়, আমরা এমনকি একটা সূচও বানাতে পারি না। কীভাবে আমরা সন্ত্রাসী রাষ্ট্র্র হবো? কীভাবে আমরা দুনিয়ার প্রতি একটা হুমকিতে পরিণত হবো? যদি বিশ্ব সন্ত্রাসবাদ সত্যিই সন্ত্রাস শব্দ থেকে উৎসারিত হয়ে থাকে তাহলে মেলা দেশ আছে যারা ব্যাপক হত্যাযজ্ঞের জন্য অস্ত্র বানায়, যারা পারমাণবিক অস্ত্র বানায়, তারা সবাই সন্ত্রাসী।

রাষ্ট্রদূত হাশেমীর কথা শুনে কি মনে হয়, তালিবান সরকার চালাতো কতগুলি মূর্খ মানুষ, যারা ধর্ম ছাড়া আর কিছু বোঝে না? হাশেমীর বক্তব্য উপস্থাপন শুনে কি তাই মনে হবে কারো? তিনি তালিবান কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। মার্কিন বহু রাষ্ট্রপতির চেয়ে তার কথা অনেক যুক্তিসঙ্গত আর ধারালো। বলার ভঙ্গি ছিল চমৎকার। তিনি সেদিনের বক্তব্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। চলবে