তালেবানরা বিরাট সন্ত্রাসী, তাদের যেন আর কোনো পরিচয় নেই

পর্ব ৭

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০১, ২০২১

যখন এসব ঘটছে, তখনই মাখমালবাফ আফগান শরণার্থীদের মরতে দেখেছে ভেড়ার পালের মতো। পাকিস্তান যা তখন কিছুটা আশ্রয় দিয়েছে। মাফমালবাফ কিছু মানুষের মৃত্যু নিয়ে লিখেছেন, যখন ওদের হাসপাতালে নিয়ে গেলাম, ভেবেছিলাম কলেরায় মরছে, পরে বুঝলাম ক্ষুধায়। সেই দিনগুলিতে অত মানুষকে অনাহারে মরতে দেখে নিজেকে যেকোনো খাদ্য গ্রহণের জন্য ক্ষমা করতে পারি না।

সামনে আরো দশলাখ লোক না খেয়ে মরবার কারণ তৈরি হচ্ছিল। বাংলাদেশের ড. কামাল হোসেন জাতিসংঘের আফগানিস্তান বিষয়ক মানবাধিকার উপদেষ্টা ছিলেন। দুই হাজার সালের গ্রীষ্মে মাখমালবাফের কার্যালয়ে গিয়ে তিনি জানিয়েছিলেন, দশ বছর ধরে জাতিসংঘের কাছে তিনি স্রেফ নিষ্ফল অভিযোগ করে যাচ্ছেন। মাখমালবাফকে কামাল হোসেন তখন এমন একটা ছবি বানাতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন, যা সারা দুনিয়াতে সাড়া জাগাবে। মাখমালবাফ তাকে বলেছিলেন, আমিও এমন একটা বিষয় খুঁজছি যা মানুষের মর্মস্পর্শ করবে।

যখন মাখমালবাফ এসব দেখছেন, তখন আফগানিস্তানের মানুষ স্বাধীনতার আগে চাইছে রুটি। কতটা দুঃখেকষ্টে তারা ছিলেন এর থেকে বোঝা যায়। তখন আর একটা আকাঙক্ষা ছিল প্রত্যেক আফগানের তা হলো জীবনের নিরাপত্তা, স্বাধীনতা নয়। দুর্নীতিতে তখন ছেয়ে গেছে পুরো আফগানিস্তান, মানে কোটি কোটি মানুষ যখন না খেয়ে আছে কিছু মানুষের হাতে টাকা জমেছে। চারদিকে অস্ত্রের ঝনঝনানি, প্রত্যেক আফগানের হাতে বলতে গেলে একটা করে কালাশনিকভের মতো অস্ত্র।

তালেবানদের কাছে তখন মানুষের প্রত্যাশা অনেক। তালেবানরাও ভালো জানে না সমাধান কোথায়। বিধ্বস্ত একটা দেশ, নিয়ম-কানুনের বালাই নেই, সেখানে কেমন করে একটা নিয়ন্ত্রণ তৈরি করা যায়। মৌলবাদী হিসেবেই তালেবানরা সব সময় সমালোচিত হয়ে আসছে বাইরের জগতে, কিন্তু তাদের সংকট আর ইতিবাচক দিকগুলি নিয়ে কথা বলছে না কেউ। বহুদিন ধরে আফগান সমাজের যে-সকল পশ্চাদপদ ঐতিহ্য, সেগুলির দায় চাপিয়ে দেয়া হলো তালেবানদের উপরে। যখন তালেবানরা ক্ষমতায় আসে, তখন মাত্র পাঁচ শতাংশ নারীরা শিক্ষার সুযোগ লাভ করেছিল, তালেবানদের সময়ে সেটাও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মানে পঁচানব্বই শতাংশ নারী আগে থেকেই শিক্ষালাভের সুযোগ পায়নি, তালেবানরা বাকি পাঁচ শতাংশকে শিক্ষালাভ থেকে বঞ্চিত করলো।

তালিবান আসার পরপর মেয়েদের বিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল এবং অনেক দিন মেয়েদের রাস্তায় বের হওয়া নিষেধ ছিল। মাখমালবাফ প্রশ্ন তুলেছিলেন, বাস্তবানুগ ধারণা নিয়ে কেন জিজ্ঞেস করা যাবে না, তালিবান কর্তৃক আফগান সংস্কৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নাকি এই সংস্কৃতিই তালিবানদের উত্থানের কারণ? যখন আমানুল্লাহ ক্ষমতায় এসেছিলেন, তার প্রধান একটি লক্ষ্য ছিল বহুগামী পুরুষ শাসিত আফগানিস্তানে একগামিতা চালু করা। বহু বছর ধরে আফগান নারীদের কাছে বহুগামিতা গ্রহণীয় ব্যাপার। সংস্কৃতি বা ঐতিহ্যের নামে মানুষ কীভাবে দাসত্বের কাছে বন্দী থাকে এটাই হচ্ছে তার উদাহরণ। ফলে এই ঐতিহ্য বা কুসংস্কারগুলি ভাঙাটা খুব সহজ কাজ নয়।

ভারতের সভ্যসমাজ আজও তার বর্ণপ্রথা ভাঙতে পারেনি। ভারতের দক্ষিণ সবচেয়ে শিক্ষিত অথচ বর্ণপ্রথা সেখানেই প্রবল। মানুষ দিনে দিনে তার দাসত্বকেও ঐতিহ্য হিসেবে দেখতে শেখে। প্লেখানভ তাই দেখিয়েছিলেন, সেইরকম দাসও আছে যে তার শেকলকে ভালোবাসে, মনিবের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকাটাকেই সে মনে করে তার মহত্ত্ব। পুত্র যখন মনিবের প্রতি বিদ্রোহ করে, পিতা তখন পুত্রকে বলেছিলেন এ চরম বিশ্বাসঘাতকতা মনিবের প্রতি; যে মনিব বছরের পর বছর তাদের খাইয়ে পরিয়ে চাকুরি দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে। মানুষের মনোজগত সম্পূর্ণ আত্মস্থ না করে সমাজবিপ্লব সাধন করা যায় না। ফলে বহুদিনের অভ্যাসে আফগান নারীরা মেনে নেয় নিজের স্বামীর বহুগামিতাকে।

পশতুন এবং হাজেরাদের দুটি বিয়ের অনুষ্ঠানে মাখমালবাফ হাজির ছিলেন, সেখানে তিনি বলতে শুনেন বরের যেন আরো ভালো বিয়ে হয়। কনে পক্ষের আত্মীয়স্বজনরা বলেছিলেন তাঁকে, যদি বরের সামর্থে কুলায় তো চারটা পর্যন্ত স্ত্রী সত্যি খুব ভালো। এটা ধর্মীয় ঐতিহ্য এবং পাশাপাশি একজন ক্ষুধার্ত মানুষকে একমুঠো সাহায্য করাও হলো। কী রকম অর্থনীতিতে একটা সমাজ কী রকম ঐতিহ্য লালন করে দূর থেকে সেটা ধারণা করা সহজ নয়। সমালোচনা করাটাই সহজ। সবসময় তালিবানরা মৌলবাদী হিসেবে সমালোচিত হয়ে আসছে, কিন্তু তাদের এ হেন আচরণের কারণ সম্পর্কে বলা হচ্ছে সামান্যই।

দুই বছরের মেয়ের সঙ্গে সাত বছরের ছেলের বিয়ে হয় আফগানিস্তানে। বিশ্বের আরো বহু সমাজে এসব ঐতিহ্য ছিল, যা এখন আর নেই সেভাবে। বাংলাদেশ ভারতে দেড়শো বছর আগে এমন ঐতিহ্য্য অহরহ ছিল, যা আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আইন করে নিষিদ্ধ করা মানে, জনগণের সেসব ঐতিহ্য পালনে আপত্তি ছিল না। মাখমালবাফ লিখেছেন, যা আমাকে আকৃষ্ট করেছিল, আফগান মহিলারা বোরকার ভিতর থেকে হাত বের করে ফেরিওয়ালা বালকের দিকে মেলে ধরেছে নখ রাঙানোর জন্য। শুভ লক্ষণ যে বোরকার ভিতরেও মেয়েরা বাঁচতে চাচ্ছে এবং অভাবের ভেতরেও তারা যতদূর পারে নিজেদের সৌন্দর্যের দিকে খেয়াল রাখছে। সতীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় সে যেন পিছিয়ে না পড়ে সেজন্যও নিজেকে যত্নে রাখতে হয় আফগান মহিলাদের। নিশ্চয় এটা একটা সমাজের নারীর করুণ চিত্র। আবার অনেক ক্ষেত্রে পুরুষেরও।

বিয়ে করাও সেখানে পুরুষের জন্য একটা খরচার ব্যাপার। নারীকে কিনতে হয় তাকে বহু টাকা খরচ করে। দূর থেকে শুনলে অবাক লাগে কিন্তু এটাই তো চলে এসেছে বহু যুগ ধরে। তালিবানরা এটা নতুন করে চালু করেনি। মাখমালবাফ প্রশ্ন তুলেছেন,তালিবানরা বোরকা আনলো, নাকি বোরকা আনলো তালিবানদের? চলবে