তালেবানরা বিরাট সন্ত্রাসী, তাদের যেন আর কোনো পরিচয় নেই
পর্ব ৪
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : আগস্ট ২৮, ২০২১
সবাইকে দমন করতে পারলেও কাশ্মীরকে দমন করা যায়নি। ফলে তাদের ললাটে লিখে দেয়া হলো, কাশ্মীরের লোক সন্ত্রাসী। সেই সঙ্গে বলা হলো, পাকিস্তানের উস্কানিতে তারা সন্ত্রাস করে বেড়াচ্ছে। ভারতের সাধারণ মানুষরা তা বিশ্বাস করছে সরকারি প্রচারের ফলে। যখন স্বাধীনচেতা হিসেবে কেউ মাথা চাড়া দেবে, দমন করো তাদের সামরিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে। যদি মুসলমান হয়, জানিয়ে দাও তারা মুসলিম জঙ্গি। ভারত সরকার কেন আফগানিস্তান আর মুসলিম জগতকে যখন তখন ইঙ্গ-মাকিন শক্তির সঙ্গে সুর মিলিয়ে জঙ্গি, সন্ত্রাসী আর মৌলবাদী বলে? খুব সহজ অঙ্ক। নিজ দেশের মুসলমানদের আর কাশ্মীরকে দমন করার জন্য এর চেয়ে বড় অস্ত্র নেই। ফলে নির্বাচনের আগে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ লাগিয়ে দেয় বা পাকিস্তান বিরোধী জিগির তোলে, শুধুমাত্র ভোটে জেতার জন্য। পাকিস্তানকে আক্রমণকারী সাজিয়ে হঠাৎ একটা ভারত রক্ষার আবেগ জাগিয়ে তোলে ভারতবাসীর মধ্যে।
ভারতের সাধারণ মানুষ সাম্প্রদায়িক নয়। বাবরি মসজিদ ভাঙার বিরুদ্ধে ভারতের হিন্দুরা বারবার প্রতিবাদ করেছে। যখন গোহত্যার কারণে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, যারা হত্যা করেছে তারা যেমন হিন্দু, ঠিক তার চেয়ে বহুগুণ হিন্দুরা তার প্রতিবাদ করেছে। ভারতে মুসলমানকে হত্যা করা হলে, দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়া হলে; সকল হিন্দুরা খুশি হবে এমন ভুল ধারণা করার কারণ নেই। ভারতের মুসলমানদের স্বার্থরক্ষায় সাম্প্রতিককালেও দেখা গেছে হিন্দুরাই বেশি সোচ্চার। ভারতে মুসলমানদের প্রতি যখন অত্যাচার হয়, সবচেয়ে বেশি কলম ধরে যারা হিন্দু পরিবারে জন্মেছে, তারাই। ভারতের বিতর্কিত ইতিহাসকে নতুন করে যারা স্বচ্ছতা দিয়েছে তাদের মধ্যে বহু বর্ণহিন্দু রয়েছে। যদি তারা কলম না ধরতো, ভুল বুঝাবুঝি এতদিনে আরো বাড়তো।
হিন্দু পরিবারে জন্মেছে তেমন ভারতের সাংবাদিক, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, সাহিত্যিক, শিল্পী আর রাজনীতিকরা মুসলমানদের স্বার্থরক্ষায় সদাব্যস্ত। বাস্তবতা এটাই, একটা দেশের জনগণ আর সরকারের চরিত্র এক নয়। জনগণ সবসময় জনগণের পক্ষে। কিন্তু শাসকগোষ্ঠী আর সরকারের চালাকিটা এখানেই যে, কখনো কখনো প্রগতিশীল মানুষকেও তারা বিভ্রান্ত করতে পারে। বিভ্রান্ত করে যখন তারা বলে, মুসলমান মাত্রই সন্ত্রাসী। খুব লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ভারতের মানুষ ভারতের সাধারণ মুসলমানদের উপর আক্রমণ হলে প্রতিবাদ করে; কিন্তু কাশ্মীরের মুসলমানদের উপরে আক্রমণ হলে আর প্রতিবাদ করে না। সেখানে প্রতিবাদের সংখ্যা খুবই কম। কারণ সরকার ভারতের মানুষের মনে এটা গেথে দিয়েছে যে, কাশ্মীরের মুসলামনরা জঙ্গি আর তারা পাকিস্তানের উস্কানি আর অস্ত্র সাহায্য নিয়ে এসব করে থাকে।
ভারতের নাগরিকরা তখন আর কাশ্মীরের মুসলমানদের পক্ষ নিতে পারে না। কারণ তখন তারা মিলিয়ে ফেলে সারাবিশ্বের সকল তথাকথিত জঙ্গি মুসলমানদের সঙ্গে কাশ্মীরের জনগণকে। কাশ্মীরের জনগণের স্বাধীনতার লড়াই তখন হয়ে দাঁড়ায় বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বা মৌলবাদী আন্দোলন। প্রগতিশীল মানুষরা তখন কাশ্মীরের মানুষের স্বাধীকার আন্দোলনের পক্ষে বা তাদের প্রতি অত্যাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় না। বরং সবরকম অত্যাচার করে কাশ্মীরের মানুষকে দমন করা হোক সেটাই আশা করে। তখন তারা বিচার করে না, কাশ্মীরের মানুষ তো ভারতের কোনো ভূখণ্ডে এসে অপ্রীতিকর কিছু করেনি, বরং সরকারই বারবার তাদের ভূখণ্ডে গিয়ে তাদের উপর নিপীড়ন চাপিয়ে দিয়েছে।
মনে রাখতে হবে, তারপরেও ভারতের এবং খোদ কাশ্মীরের কিছু মানুষ মুসলমানদের উপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে সরব। বহু বইপত্র লিখেছে তারা, সেগুলি সব সাধারণত ভারতে পাওয়া যাবে না। যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্য থেকে আনাতে হবে। সেসব গ্রন্থ পাঠ করলে স্পষ্ট হয়ে যায়, কেমন করে বহুদিন ধরে নির্যাতিত কাশ্মীরের মানুষরা স্বাধীনতার জন্য লড়ে যাচ্ছে। কীভাবে তাদের প্রতি সরকারি বাহিনীর ভয়াবহ অত্যাচার চলেছে আর আন্দোলনকারীদের নিয়ে চলছে মিথ্যাচার। পাকিস্তানের সঙ্গে কাশ্মীরের সংগ্রামী বিরাট অংশের কোনোই সম্পর্ক নেই, না তারা মৌলবাদী। কাশ্মীরের জনগণের পক্ষে লেখা কিছু বইয়ের নাম এখানে বলা যেতে পারে। বইগুলি হলো: প্রেমনাথ বাজাজের ‘ইনসাইড কাশ্মীর’, সুমন্ত্রা বোসের ‘দি চ্যালেঞ্জ ইন কাশ্মীর’, বলরাজ পুরীর ‘কাশ্মীর টুয়ার্ডস ইনসারজেন্সি’, অলস্টার ল্যাম্বের ‘কাশ্মীর- এ ডিসপুটেড লেগাসি’, প্রবীর ঘোষের ‘কাশ্মীরে আজাদির লড়াই: একটি ঐতিহাসিক দলিল’, সিদ্ধার্থ গুহ রায়ের ‘কাশ্মীর’ ইত্যাদি।
সংগ্রামীদের পক্ষে কিছু আছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের ইংরেজি প্রতিবেদন। সেগুলিও এখন বিদেশ থেকে সংগ্রহ করতে হবে। যেমন কমিটি ফর ইনিসিয়েটিভ অন কাশ্মীর এর ‘ইন্ডিয়া’স কাশ্মীর ওয়ার’, ‘ব্লাড ইন দ্য ভেলি’ ইত্যাদি। যদি এসব পাঠ করা যায় দেখা যাবে, পাকিবাহিনী বাংলাদেশে একাত্তর সালে যে নির্যাতন করেছে, কাশ্মীরে ভারতীয় বাহিনীর নির্যাতন তার চেয়ে কম ভয়াবহ ছিল না। বলরাজ পুরী কাশ্মীরের একজন রাজনীতিক, তিনি সহ সকলেই দেখিয়েছেন, কাশ্মীরের জনগণের সংগ্রাম সম্পর্কে সব মিথ্যাচার করছে সরকার। পাকিস্তান যেমন মিথ্যাচার করেছিল স্বাধীনতাকামী বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। সন্ত্রাসী নাম দিয়ে স্বাধীনতাকামী মানুষের উপর চলছে দিনের পর দিন অত্যাচার। কিছু মুসলমানরা আবার সুবিধা লাভের জন্য দালালি করছে সরকারের, বারবার তারাই সরকারের কার্য হাসিল করে দিচ্ছে। বরং যারা কলম ধরেছেন কাশ্মীরের সংগ্রামী মানুষের পক্ষে, তাদের প্রায় সকলের জন্ম হিন্দু পরিবারে।
ভারতের মানুষ সাম্প্রদায়িক নয়। বরং বেশিরভাগ মানুষই ন্যায়ের পক্ষে। কিন্তু কাশ্মীর প্রসঙ্গে বা আফগানিস্তান প্রসঙ্গে সরকারি প্রচার যন্ত্র আর পশ্চিমাদের প্রচারণা তাদের মনে মিথ্যা কিছু ধারণার জন্ম দিয়ে যায়। যা কাশ্মীর নিয়ে ঘটেছে ভারতে, ঠিক তাই ঘটেছে আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে। পশ্চিমা মিথ্যাচার দিয়ে সকল সত্য ঢেকে দেয়া হয়েছে। প্রথম আসা যাক আফগানিস্তানের তালেবান নামটি প্রসঙ্গে। রাশিয়ান দখলদারিত্বের কালে মার্কিন সরকার, ব্রিটিশ সরকার, ফরাসি সরকার, চীনা সরকার এবং আরো অন্য সকলে সমর্থন যুগিয়ে এসেছে মুজাহিদীন নামের প্রতিবিপ্লবীদের। পাকিস্তানে এরকম সাতটি দল আর ইরানে আটটি দল রাশিয়ার দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়েছে। রাশিয়ানদের চলে যাওয়ার পর তারা সকলে আফগানিস্তানে এসে ঢুকলো। তাদের প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শ আর গাদা গাদা বন্দুক। তারা আফগানিস্তানের যে ক্ষতি করেছে তা রাশিয়ানদের থেকেও ভয়ঙ্কর। কেবল রাজধানী কাবুল শহরেই তাদের হাতে তেষট্টি হাজার মানুষ মারা পড়েছে।
এই নৈরাজ্য্যের কারণে আরো দশলাখ মানুষ দেশ ছেড়েছে। এই নৈরাজ্য আর ধ্বংস দেখে একদল ছাত্র বা তালেবান এর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুললো। এটা প্রথম শুরু হয়েছিল আফগানিস্তানের দক্ষিণের একটি প্রদেশ কান্দাহারে। এটা ঘটেছে যখন একজন যুদ্ধপ্রভু বা কমান্ডার দুজন কিশোরী মেয়েকে অপহরণ করে তাদের শ্লীলতাহানি ঘটালো। সেই মেয়ে দুটোর বাবা-মা একটা বিদ্যালয়ের সামনে এসে শিক্ষকদের কাছে সাহায্য চাইলেন তার সন্তানদের উদ্ধার করার জন্য। সেই বিদ্যালয়ের শিক্ষক তখন তার তিপ্পান্ন জন ছাত্রসমেত কেবল একটি বন্দুক জোগার করে কমান্ডারের ঘাঁটি আক্রমণ করলেন। মেয়ে দুটিকে উদ্ধার করার পর ওই কমান্ডারকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন, সঙ্গে তার দলের আরো অনেককে। এই কাহিনী সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এই কাহিনী শুনে আরো বহু শিক্ষার্থী এই আন্দোলনে শামিল হয়েছিল এবং অপরাপর যুদ্ধ প্রভুদের নিরস্ত্র করতে শুরু করেছিল। এই শিক্ষার্থীদের আন্দোলনই তখন রাজধানীসহ দেশের পঁচানব্বই শতাংশ নিয়য়ন্ত্রণ করে।
সেই যুদ্ধপ্রভুদের একাংশ থেকে যায় কেবল আফগানিস্তানের উত্তর ভাগে। ফলে মুজাহিদের স্রষ্টা মর্কিন যুক্তরাষ্ট্র হলেও, তালেবানদের স্রষ্টা তারা নয়। প্রথমে এটা ছিল আফগানিস্তানের স্বতঃস্ফূর্ত একটা আন্দোলন ইরানি আর পাকিস্তানি দখলদারদের বিরুদ্ধে। চলবে