তালেবানরা বিরাট সন্ত্রাসী, তাদের যেন আর কোনো পরিচয় নেই

পর্ব ১

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : আগস্ট ২৫, ২০২১

কিছুদিন হলো মাত্র, আফগানিস্তানে একটি রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে। সঙ্গে সঙ্গে বহু ফেসবুক পণ্ডিত এ নিয়ে নিজেদের মন্তব্য করা আরম্ভ করেছে। তালেবানরা কেমন ভয়াবহ আর তাদের শাসন কী ভয়াবহ হতে পারে, তা বলে দিয়েছে। সেটা নিয়েও আপত্তি করার কিছু নেই। নিশ্চয়ই তার মত তিনি প্রকাশ করবে। যদি কারো তাতে ভিন্ন মত থাকে, সেটাও যে-কেউ বলবে। কিন্তু ভিন্ন মত পোষণকারীদের তারা খারাপ ভাষায় আক্রমণ করছে, সেটা নিয়েই আপত্তি।

বাংলাদেশে অনেকেই বলার সময়ে গণতন্ত্রের কথা বলে, বাকস্বাধীনতার কথা বলে; কিন্তু তাদের বিশ্বাসের বিরুদ্ধে বললেই আর সেটা তাদের কাছে বাকস্বাধীনতা থাকে না, আক্রমণের বস্তু হয়ে দাঁড়ায়। বাকস্বাধীনতা তাদের কাছে এটুকুই যে, তাদের বিশ্বাসের সঙ্গে একমত হয়ে কথা বলতে হবে। বহুজনই আফগানিস্তান নিয়ে লিখছে বা মন্তব্য করছে, সেসব মন্তব্য পাঠ করে বোঝা যায়, আফগানিস্তান সম্পর্কে কিছুই জানে না, কিন্তু মনগড়া মন্তব্য করেই যাচ্ছে।

যারা ধর্মীয়ভাবে কট্টর বা অন্ধবিশ্বাস লালন করে আর যারা নিজের বিশ্বাস নিয়ে মনগড়া কথা বলে, দুয়ের মধ্যে মূলগত পার্থক্য নেই। দাগেস্তানের নাম করা সাহিত্যিক রাসুল গামজাতভ দাগেস্তানের প্রবাদ নিয়ে একটি চমৎকার বই লিখেছিলেন ‘আমার জন্মভূমি দাগেস্তান’ নামে। তিনি দাগেস্তানের প্রবাদকে ঘিরে সেখানে মন্তব্য করেন তার মূলকথা, মানুষের চোখ দুটা, কান দুটা আর মুখ একটি। ফলে কিছু বলার আগে দু কান দিয়ে ভালো করে সব শোনো, দুচোখ দিয়ে ভালো করে দেখো।

কিন্তু আমাদের এসব পণ্ডিতদের সে বালাই নেই। কোরআন আর আর মনুর বিধানের নাম করে অনেকে যেমন নিজের বিশ্বাসকে আঁকড়ে থাকে, এনারা তাই। পাশ্চাত্যের বা ভারতের ক্ষমতাবানদের প্রচার দ্বারা ওনারা সবসময় বিগলিত থাকে। সবসময় সেই ভাষায় কথা বলে। নিজের বিবেক, চিন্তাভাবনা বা বাস্তব তথ্য-উপাত্ত কাজে লাগাবার কথা ভাবতেই পারে না। কারণ, সে যা বিশ্বাস করে, তার চেয়ে বড় সত্য আর কী থাকতে পারে!

ইরানের একজন নামকরা চলচ্চিত্রকার আছেন, তার নাম মোহসেন মাখমালবাফ। তিনি বাংলাদেশে এসেছেন, তার নির্মিত চলচ্চিত্র বাংলাদেশের বহু মানুষ দেখেছে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র প্রেমিকদের কাছে তিনি একটি সম্মানিত নাম। মাখমালবাফ আফগানিস্তান নিয়ে দুটা ছবি বানিয়েছেন। ছবি দুটার নাম ‘সাইক্লিস্ট’ আর ‘কান্দাহার’। দুটাই মানবিক ছবি। ছবি দুটা বানাবার আগে তিনি তথ্য জোগার করবার জন্য দশহাজার পৃষ্ঠার মতো বিভিন্ন বই ও দলিলপত্র পড়েছেন। তিনি লিখেছেন, মানবিক একটি ছবি করার জন্য তার এত পড়াশুনা করা কী দরকার ছিল? তিনি নিজেই উত্তরে বলেন, নিজের চিন্তাকে স্পষ্ট আর স্বচ্ছ করার জন্য।

বাংলাদেশের ফেসবুক পণ্ডিতদের আফগানিস্তানের বর্তমান প্রেক্ষাপট নিয়ে ছোটখাটো প্রবন্ধ লেখার জন্য বা মন্তব্য করার জন্য কিছুই পাঠ করার প্রয়োজন হয় না। পাশ্চাত্যের বা ভারতের প্রচরণা মাধ্যমের কথাগুলি বিশ্বাস করলেই হয়। কিছু নিয়েই এরা গভীরভাবে পড়াশুনা করে না, কিন্তু ভাসা ভাসা মন্তব্য করা বা ছোটখাটো প্রবন্ধ লিখে নিজেকে পণ্ডিত জাহির করতে খুবই পারদর্শী। যারা তালেবান নিয়ে এত কথা বলছে, তারা বলতেই পারবে না তালেবান নামের উৎপত্তিটা কোথা থেকে। জানে না আফগানিস্তানে সামান্য ইতিহাস। বিশ-পঁচিশ বছরের আফগানিস্তানের নানা ঘটনা আর পরিবর্তন নিয়েও কিছু বলতে পারবে না। কিন্তু তালেবানরা বিরাট সন্ত্রাসী, এটা বিনাবিচারে বলে দিতে পারে, তালেবানদের যেন আর কোনো পরিচয় নেই। যদি দাবি করা হয় বক্তব্যের পক্ষে তথ্য, দিতে পারবে না।

বিশ্বের ইতিহাস নিয়েও তাদের যৎসামান্য পড়াশুনা আছে কিনা, আমার সন্দেহ। থাকলে তারা যেসব মন্তব্য করেছে একপেশেভাবে, তা করত না। ভারতবর্ষের ইতিহাসটা পাঠ করলে দেখতে পেতেন, সাম্রাজ্যশক্তি যখন একটা দেশকে দখল করে রাখে সেখানকার স্থানীয় মানুষের রাজনীতি আর বিদ্রোহের চেহারাটা কেমন হয়। ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে বাংলার কৃষকদের তাৎক্ষণিক বিদ্রোহের পাশাপাশি ভারতের প্রথম স্থানীয় বিদ্রোহ হলো ‘ফকির সন্ন্যাসীদের বিদ্রোহ’। ফকির আর সন্ন্যাসীরা যে ধর্মীয় গোষ্ঠী, বিজ্ঞানমনস্ক চেতনাসম্পন্ন কোনো গোষ্ঠী নয়, বিদ্রোহের নাম থেকেই সেটা বোঝা যায়। ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে ঘৃণা থেকেই ফকির সন্ন্যাসীরা বিদ্রোহটা করেছিল। সন্ন্যাসীদের সেই বিদ্রোকে পটভূমি করে বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন আনন্দমঠ, সেখানে হিন্দুধর্মের জয়গান গাওয়া হয়েছে।

ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতে সবচেয়ে আলোচিত কৃষক আর সেনাবাহিনীর মিলিত মহাবিদ্রোহ আরম্ভ হয়েছিল ১৮৫৭ সালে, সেটাও ছিল ধর্মের আলখেল্লা গায়ে দিয়ে। হিন্দু-মুসলমান মিলিতভাবে, ধর্মরক্ষার নামে সে বিদ্রোহ আরম্ভ করেছিল। সেটাই পরে স্বাধীনতার প্রথম আন্দোলন বলে স্বীকৃত হয়। বাংলার ইংরেজি শিক্ষিতবাবুরা কিন্তু এই বিদ্রোহের বিরুদ্ধে ছিলেন। ঠিক তার আগে বাংলার তিতুমীরের আর হাজী শরীয়তুল্লাহর বিদ্রোহ ছিল ধর্মের নামেই, কিন্তু বিদ্রোহটা ছিল ইংরেজ শাসন আর জমিদারদের বিরুদ্ধে। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ধর্ম কেন প্রাধান্য পায়, তা নিয়ে গৌতম ভদ্র লিখেছিলেন ‘ইমান ও নিশান’ নামের বিখ্যাত ইতিহাস গ্রন্থ।

মধ্যযুগের ইউরোপের বিরাট কৃষকবিদ্রোহগুলি আরম্ভ হয়েছিল ধর্মের নামেই, ধর্মকে সঙ্গে নিয়ে শাসকদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে। মার্কস-এঙ্গেলসের ‘ধর্ম প্রসঙ্গে’ বইয়ে তার উদাহরণের অভাব নেই। ভারতের জাতীয়তাবাদের শুরুটা তো ধর্মকে ঘিরেই, হিন্দুত্বকে বড় করে, সেই ধারা ভারতবর্ষে আজও প্রবাহমান ‘হিন্দুত্ববাদ’ নামে। ব্রিটিশ-ভারতের জাতীয়তাবাদকে সেজন্যই তো বলা হয় ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদ’। ইউরোপের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ভারতের জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ইউরোপের জাতীয়তাবাদের পার্থক্য কত বিশাল। ইউরোপ জাতীয়তাবাদের আন্দোলন আরম্ভ করেছিল চার্চের বিরুদ্ধে আর ভারতে তা আরম্ভ হয়েছিল বেদ আর হিন্দুত্বের মহিমা প্রচার করে। ভারতের মুসলমানদের পর্যন্ত সে জাতীয়তাবাদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল ‘হিন্দু মেলা’র আয়োজন করে।

রবীন্দ্রনাথের পরিবারের অনেকে এবং তার পিতা ছিলেন হিন্দু মেলার প্রধান পৃষ্ঠপোষক। কিছু হিন্দু ভদ্রলোকরা তখন মুসলমানদের বাদ দিয়ে এই হিন্দু মেলা আয়োজনের প্রতিবাদ করে নিজেরাই পরে হিন্দুত্ববাদের পক্ষে চলে গিয়েছিল। যাদের প্রতিবাদে হিন্দু মেলার নাম পাল্টে ‘চৈত্র সংক্রান্তি’ করা হয়েছিল, সেই তারা অনেকেই হিন্দু জাতীয়তাবাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিল। অমর দত্তের ছোট একটা বই ‘ঊনিশ শতকের শেষার্ধে বাঙলাদেশে হিন্দু জাতীয়তাবাদ’ বইটি পাঠ করলেই এ সম্পর্কে বহু সত্য জানা যাবে। ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অন্যতম নেতা কংগ্রেসের প্রধান গান্ধী কংগ্রেস সভায় সরাসরি বলতেন ‘রামরাজত্ব’ প্রতিষ্ঠার কথা। বলতেন গরুরক্ষা আন্দোলনের কথা। রামরাজত্ব কি ভারতের মুসলানদের কাছে গ্রহণযোগ্য বা বাসযোগ্য হতে পারে? ক্রমাগত রামরাজত্ব আর হিন্দুত্বের কথা বলে গান্ধী, হিন্দুমহাসভা আর কংগ্রেস মিলে মুসলমানদের হিন্দুদের থেকে দূরে সরে যেতে বাধ্য করেছিলেন। চলবে