তারেক মাহমুদের ৯ কবিতা

শ্রদ্ধার্ঘ্য

প্রকাশিত : অক্টোবর ২৭, ২০২৩

কবি, অভিনেতা ও নির্মাতা তারেক মাহমুদ বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১২টায় রাজধানীর একটি হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে তার লেখা একগুচ্ছ কবিতা পুনর্মুদ্রণ করা হলো:

কোনো কথা না বলে

অনেক কিছুই বলতে ইচ্ছে করে
না, কোনো বেদনার কথা নয়
নয় কোনো আনন্দের কথাও
জাতীয় ইস্যু নিয়েও কোনো কথা নয়
জাতিসংঘ বা বিশ্বব্যাংক নিয়েও
আমার কোনো আগ্রহ নেই
শহরের যানযট নিয়েও কিছু বলবো না
এমন কী মূল্যবৃদ্ধি বা সমন্বয় নিয়েও
আমার কোনো কথা নেই
রাজনৈতিক সমাবেশ নিয়েও কথা নেই

এমনকি তোমাকে এত অনুভব করার পরও
তোমার সাথে কোনো কথা নেই আমার
যদি কথা বলতে গিয়ে
তোমার প্রতি সব আকর্ষণ নষ্ট হয়ে যায়

আমার নিজের কিছু কথা
বলতে খুব ইচ্ছে হয়
কিন্তু ভয় হয়!
সে কথামালা যদি নিজেরই প্রতিপক্ষ হয়ে যায়!

আর তাই কোনো কথা না বলে
আমি চুপচাপ শুধু চেয়ে থাকা
একজন হয়ে যাই

আগুন প্রেম ও মাটির ভাস্কর্য

মাছ থেকে ফ্রিজটা বের করে
পানিতে ডুবাতেই
দাও দাও করে জ্বলে উঠলো আগুন
পেট্রল ঢালতেই সে আগুন উধাও

কোথা থেকে এক প্রজাপতি এসে বলল,
বুঝলে, এর নাম প্রেম
প্রেমে মানুষ পুকুর হয়
সংসারে হয় ডোবা
আর প্রেমহীনতায় হয় মহাসাগর, বুঝলে?

তারপর
প্রজাপতিটি অ্যালবাট্রস হয়ে উড়ে গেল
নরম মাটির মধ্য দিয়ে

পরিবর্তনে কী লাভ হলো

চিত্রগ্রাহককে বলা হয় ডিওপি
সংগীত পরিচালক হয়ে গেছে কম্পোজার
নৃত্য পরিচালক হলো কোরিওগ্রাফার
ড্রেসম্যানকে বলা হয় কস্টিউম ডিজাইনার
কাহিনিকে বলা হয় কনটেন্ট

এমন অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে।

প্রেমিক হয়ে গেছে বাবু
প্রেমিকা হয়েছে জান

আমি কিন্তু প্রচলিত সর্বনামেই মুগ্ধতা অনুভব করি।

এভাবেই ভালোবেসো

যেভাবে আছি
যদি পারো এভাবেই ভালোবেসো
নিজেকে চেঞ্চটেঞ্চ করতে পারবো না
ভালোবেসে তো আর জীবন দিতে পারবো না
বরং জীবনকে বাঁচানোর জন্যই ভালোবাসা পেতে আগ্রহী
যেভাবে আছি এভাবেই থাকবো
ওই আরলি টু রাইজার আমি হতে পারবো না
শরীরটাকে ঠিক রাখার জন্য
ফুড হ্যাবিট চেঞ্চ করতে পারবো না
বারে না হয় না গেলাম আগের মতো
কিন্তু ওই কম্মটি ঘরে ফেরার জন্য বিশেষ সাড়া থাকতে হবে
ওই রকম ফরমাল হয়ে কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানের জন্য
চাপাচাপি করো না
সিগ্রেট না হয় কমিয়ে দেব দেখি
ঘুরতে টুরতেও আপত্তি নেই
শপিংয়েও যেতে পারি
যদি আমার পকেটে রাখা হাতের কনুইয়ের সমান্তরালে
তোমার হাত ঢুকিয়ে হাঁটতে পারো
ফুলটুল চেও টেও না
ওসব আমার কাছে অসহ্য
সন্ধ্যায় আদরে খোঁপায় জড়াবে যাকে
রাতেই যখন ফেলে দিতে হয়
তাকে এত মূল্য দেয়ার কি আছে
আমি যেভাবে আছি সেভাবেই থাকবো
যদি এভাবেই ভালোবেসে যেতে পারো, তবে এসো

পুরোনো বাসা ছেড়ে দেবার সময়

পুরোনো বাসা ছেড়ে দেবার সময়
এক ধরনের কষ্ট সামনে এসে দাঁড়ায়
স্বজনহীন এই শহরের ভাড়া বাসায় থাকতে থাকতে
অনেকের সঙ্গেই গড়ে ওঠে সম্পর্ক
সবজি বিক্রেতার সঙ্গে, লন্ড্রির দোকানি, মুদিঅলার সঙ্গে
গড়ে ওঠে এক নিবিড় সম্পর্ক
রাতে ঘরে ফিরবার সময় রাস্তার মোড়ের
একপাল কুকুরগুলোর সঙ্গেও গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব
মোড়ের সিগ্রেট বিক্রেতার সঙ্গের সম্পর্কটিও বাদ যায় না।
কোনো কোনো বিকেলে ছাদে উঠলে
পাশের বাসার ছাদে ওই কলেজ পড়ুয়া ছাত্রীটির সঙ্গেও  
নিবিড় বোঝাপোড়া হয়ে যায়
দেখা গেল, তার সঙ্গে কোনোদিন কথাই হলো না

গাড়িতে সব মালপত্র উঠানো হয়ে গেছে
এখনি এই বাসায় নতুন ভাড়াটে উঠবে
আমি চলে যাচ্ছি, এই বাসায় কোনোদিন আসা হবে না
গাড়ি প্রস্তুত, উঠে বসলাম
পাশের বাসার ছাদের ওই মেয়েটির সঙ্গে শেষপর্যন্ত দেখা হলো না
ও কী কোনোদিন খুঁজবে— আমার বিগত চেনা ছাদে— আমাকে?
গাড়ি এগিয়ে চললো, সবকিছু পেছনে পড়ে রইলো
হঠাৎ মনে হলো, আমার প্রিয় রেজারটি আনা হয়নি
ওটি বাথরুমে পড়ে আছে— থাক।

ওহ! জিন্স

অনেকের মতো জিন্স আমারও প্রিয় পোশাক
আমি ভয়ানক আসক্ত জিন্সের প্রেমে
এর নেপথ্য কারণ অবশ্য রয়েছে

জিন্সের সঙ্গে এলেবেলে জীবনের
    এক আশ্চর্য মিল খুঁজে পেয়েছি
জিন্স ছিঁড়ে যায়—
    ফেটে যায়
    রঙ চটে যায়
    তবুও পরা যায়
        সহসাই ফেলতে চায় না মন
জীবনও সেরকম—
    ছিঁড়ে যায়
    ভেঙে যায়
    রঙ বদলায়
        তবু জীবন চলে
            ফেলতে পারে না কেউ
ছেঁড়া জিন্স পড়লে আজকাল
তেমন কিছু বলে না কেউ
জীবন অসহায় হয়ে পড়লেও তেমন, এগিয়ে আসে না কেউ
তাই আমার জীবন যেমন প্রিয় আমার কাছে— জিন্সও

পৃথিবীর তামাম শহর উপড়ে ফেলি তোমাকে খুঁজতে গিয়ে

প্রিয়তমা
তোমাকে খুঁজতে পৃথিবীর তামাম শহর চষে বেড়াচ্ছি
এই কিছুক্ষণ আগে
ফ্রান্সের একটি গ্রামের শষ্যক্ষেতের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম
পশ্চিমে তাকিয়ে বিকেলের সূর্যের মধ্যে তোমাকে খুঁজছিলাম
যে শষ্যক্ষেতের পাশে দাঁড়িয়ে ভ্যানগগ নিজের মাথায় ট্রিগার টিপেছিলেন
আমি ঠিক সেখানেই দাঁড়িয়েছিলাম

গতকাল সন্ধ্যায় লন্ডনের এক কফিশপে বসে
মগের ঘন কফির মধ্যে চোখ ঢুকিয়ে তোমার মুখ খুঁজছিলাম
শরীরে ওভারকোট জড়িয়ে নায়াগ্রার জলপ্রপাতের ধারে দাঁড়িয়ে
আমি তোমার কথাই ভাবছিলাম

মিশরের পিরামিডের পাশ দিয়ে যেতে যেতে
আমি কান পেতে ছিলাম, যদি তোমার ডাক শুনতে পাই

কায়রোর রাতের রাজপথে একা হাঁটতে হাঁটতে
আমি কেবলি খুঁজছিলাম তোমার দুটি চোখ

ম্যানিলার এক পারফিউমের দোকানে
হঠাৎ পেয়ে গেলাম তোমার প্রিয় পারফিউম
সবটুকু পারফিউম স্প্রে করলাম বাতাসে
কী আশ্চর্য! ম্যানিলার ছোট্ট শহরজুড়ে কেবল তোমারই অস্তিত্ব পেলাম যেন

জার্মানের এক কবিতা সন্ধ্যায় কবিতা পড়তে গিয়ে
ভীষণ বাধাগ্রস্থ হয়েছিলাম
দর্শক সারিতে বসা এক জার্মান তরুণীর চোখ আটকে গিয়েছিল আমার চোখে
সে যেন তোমার চোখ চুরি করে এনে তার চোখে বসিয়ে নিয়েছে

তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে আমি যুদ্ধক্ষেত্রে চলে গেছি—
কখনো কিউবায়
কখনো ইরাকে
কখনো প্যালেস্টাইনে
কখনো হারিয়ে গেছি আফ্রিকার গহীন জঙ্গলে।

একদিন ডুব দিয়েছিলাম নীলনদে
একদিন হোয়াংহোতে খুঁজেছিলাম তোমাকে

তোমাকে খুঁজতে গিয়ে পৃথিবীর তামাম শহর উল্টেপাল্টে ফেলি

কখনো বোম্বে, কখনো এথেন্সে, কখনো ফিলিপাইনে
কখনো তুরস্কে, কখনো আজমিরে, কখনো আগ্রার তাজমহলে।

আমার প্রিয় গ্রাম বাংলাদেশ
তোমাকে খুঁজতে গিয়ে এই গ্রামের একটি দূর্বাঘাসও আমি বাদ রাখিনি

এভাবে পৃথিবীর তামাম শহর চষে বেড়াই
তোমাকে খুঁজতে, তোমার উপমা খুঁজতে

নর্তকি

মঞ্চে নৃত্যরতাকে দেখে কী মনে হয়?
ওই যে তার হাস্যমুখ
শরীরে কাঁপন
পলোর মতো ফুলে উঠছে তার লেহাঙ্গা
তার শরীরের ভাঁজে গেঁথে যাচ্ছে তোমাদের চোখ
মনে মনে ক’জন পারছো তাকে কামনা না করতে

নর্তকি তোমাদের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে উড়ন্ত চুমু
তোমরা হো হো করে উঠছো
ভাবছো, আনন্দদানরতা ওই মেয়েটি খুব আনন্দমুখর
একবারও ভেবেছো কী
তার প্রতিটি মুদ্রার আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে কতখানি বেদনা
ওর বেদনামুখর মুখখানি কত কসরতে হাসি ধরে রাখে
একবারও ভেবেছো কী একাকী নর্তকি কতটা নিঃসঙ্গ
নর্তকির একটিও নিজের মানুষ নেই
তোমরা ওর হাসিমুখ দেখো
আমি দেখি ওর লুকানো বেদনা
নর্তকি, তুমি বেদনা বিলাও
অথবা খুলে ফেলো তোমার আনন্দের মুখোশ

টেবিল

আমার ঘরে আজ একটি নতুন টেবিল এলো
ঘরের মধ্যে টেবিল না হলে নাকি চলে না

টেবিলের শরীরে কাঁচা গন্ধ, রঙ করা হয়নি, প্রয়োজনও নেই
যার যা রঙ তার তা থাকাই ভালো

এই টেবিলটি কোন কাঠের, জানি না
কোন কাঠের টেবিল ভালো হয়
সে সম্পর্কে আমার ধারণা নেই

যদি জানা যেত টেবিলটি কোন কাঠের
কোন এলাকায় তার জন্ম, কোন ভিটের মাটিতে
কোন ফলের বীজ থেকে সে জন্মেছিল
কতদিন দাঁড়িয়েছিল একই স্থানে
কত মানুষ সেই গাছটির বেড়ে ওঠা দেখেছে
হয়তো সেই গাছের ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছে কত পথচারী
কোরবানি-ঈদে সেই গাছের নিচে
কত নিরীহ পশুকে স্রষ্টার দরবারে উৎসর্গ করা হয়েছে
সেই গাছে কত কত পাখি কত কত গান গেয়েছে

আহা, গাছটি হয়তো ইচ্ছেমতো বেড়ে উঠতেও পারেনি
হয়তো গাছটি ছিল কোনও গরিব চাষির
মেয়ের বিয়েতে এত আদরের গাছটিকে
সস্তা দরে ব্যাপারির হাতে তুলে দিতে হয়েছে
সেই গাছটি কাটতে কত মানুষ লেগেছে

গাছটির বেদনা কি কেউ বুঝেছে
গাছটি কাটবার পর শেষ হয়েছে কিছুদিন
অভ্যাসবশত কত মানুষ গাছটির দিকে তাকিয়েছে
শূন্যস্থান দেখে কেউ হয়তো স্মৃতিকাতর হয়ে উঠেছে

গাছটি কাঠ চেরাইয়ের কল থেকে কাঠ হয়ে এসেছে এই শহরে
কাঠমিস্ত্রি কত শ্রমে বানিয়েছে এই টেবিল

আহা, গাছটি যখন কাঠ হয়, কাঠ যখন টেবিল হয়
তারও পরে কত কতদিন অনাদরে পড়েছিল সে
কত ঝড় কত বৃষ্টি কত রোদ কত ধুলাবালি
সে সয়েছে নীরবে
আমার ঘরে আসতে তাকে কতগুলো পথ অতিক্রম করতে হয়েছে

আমি টেবিলটির দিকে তাকিয়ে আর টেবিল দেখি না
টেবিলটি তার সমস্ত স্ক্রু ফেলে যেন কাঠ হয়ে যায়
কাঠগুলো যেন জড়ো হয়ে গাছ হয়ে যায়
গাছটি দাঁড়িয়ে থাকে, বাতাসে দোল খায়
তার ডালে পাখিরা গান গায়, পথিক বিশ্রাম নেয়
গাছটি তখন অনেকের আশ্রয় হয়ে ওঠে।