প্রতীকী ছবি
তারা ব্লগ লোপাটে ইন্ধন যোগায়
চয়ন খায়রুল হাবিবপ্রকাশিত : জুন ০৩, ২০১৯
লেখকের বানানরীতি অনুসরণ করা হয়েছে
মোহাম্মদ রফিক, গৌতম মিত্ররা ব্লগার হত্যা করে না, ব্লগ লোপাটে ইন্ধন যোগায়। কয়েক বছর আগের একটা নোট। তখন ব্লগার হত্যা প্রায় মাসিক রিচুয়ালে পরিনত হয়েছিলো। ব্লগার হত্যাকারিদের পেছনে এবং সাথের সরব দল ও ব্যক্তিদের আরেকটা প্রবনতা হচ্ছে নারিবিদ্বেষ ছড়ানো। ধরা পড়া এবং না ধরা পড়া ব্লগার হত্যাকারি এবং তাদের মদদদাতাদের আমরা বলি জঙ্গি, সন্ত্রাসি। কিন্তু যারা জোটবেধে রিপোর্ট করে কারো ব্লগ লিং এর শেয়ার বন্ধ করিয়ে দেয় তাদেরকে আমরা কি নামে ডাকবো?কোলকাতার তথাকথিত জীবনানন্দ গবেষক গৌতম মিত্র এ কাজটি করেছে আমার ব্লগের বেলাতে।গত জানুয়ারি থেকে আমার ব্লগের লিং শেয়ার ফেসবুকে দেয়া যাচ্ছে না। আমি ছাড়া অন্যরাও চেষ্টা করে পারে নাই। ফেসবুকের অটো রিপোর্টিং প্রক্রিয়াতে গৌতম মিত্র আমার ব্লগটিতে এবিউসিভ তকমা সেটে দিয়েছে। এটা কিভাবে বুঝলাম?
গৌতম মিত্রের কিছু অতি পাকা জীবনানন্দ সংশ্লিষ্ট বক্তব্যে আমি কিছু কমেন্ট করেছিলাম। তারপর একদিন ওনার প্রোফাইলে অস্কার ওয়াইল্ডের একটা কোটেশান পেলাম, যেটা দিয়ে ওয়াইল্ডকে নারি বিদ্বেষি হিসেবে দেখাতে চায়। এর নিচে মোহাম্মদ রফিকের মন্তব্যে পড়লাম, উনি লিখেছেন,`That`s why he opted to be a gay.` সেখানেই উত্তরে লিখেছিলাম, `গে বা সমকামিতা কোনো অপসন না, এটা একটা নির্ধারিত সেক্সুয়ালিটি, যেরকম স্ট্রেইট বা হেটেরোসেক্সুয়ালিটিও কোনো অপসন না...।` এটা লিখেছিলাম ইংরেজিতে। তারপর একটা কবিতা লিখি `বিছানাটা কার` শিরোনামে আমার ব্লগে। সে কবিতাটির লিঙ্ক গৌতম মিত্রের একই অস্কার ওয়াইল্ড/মোহাম্মদ রফিকের বক্তব্যের নিচে সেটে দেই। কবিতাটিতে আমি নাম ধরে বলেছিলাম, কপিলার লেখক কবি মোহাম্মদ রফিকের অস্কার ওয়াইল্ড তথা লিংগ ও লিংগবাচক যৌনতা বুঝের ঘাটতি আছে। কবিতার লিঙ্কটা লোপাট করে দেয়া গৌতমের অধিকারের ভেতর পড়ে। কিন্তু আমার যে ব্লগটি ফেসবুকের শুরু থেকে শেয়ার করে আসছি, তাকে অটো রিপোর্টিং এ ফেলাটা অধিকারের এবিউসে কি পড়ে না?
আমার ব্লগে আমি ১০ বছর যাবত নিজের বিভিন্ন কবিতা ছাড়াও, মৌলবাদ বিরোধিতা, আদিবাসি নিপিড়নের বিরোধিতা, বিচিত্র অনুবাদ ও নন্দনকলার বিভিন্ন শাখা নিয়ে অনেক লেখা প্রকাশ করেছি। মৌলবাদিদের হাতে নির্মমভাবে নিহত বিজ্ঞান লেখক ডক্টর অভিজিৎ রায় প্রতিষ্ঠিত `মুক্তমনা` ব্লগে আমার ব্লগের ভাষা ও বানানরিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছিল সে ব্লগের প্রশাষক ফরিদ। অভিজিত বা ফরিদ আমার ব্লগকে রিপোর্ট করে নাই, বরং গঠনমুলক আলোচনা করেছে। আবার সম্প্রতি বিনয় মজুমদারকে নিয়ে অরবিন্দ চক্রবর্তি যে ঢাউস গ্রন্থ সম্পাদনা করেছে, সেখানেও আমার ব্লগে লেখা বিনয় কেন্দ্রিক রচনাটা স্থান পেয়েছে। এটা বলার কারন, ফরিদ, অভিজিৎ, অরবিন্দ সহ আরো অনেকে আমার ব্লগের খোজ পেয়েছে লিং শেয়ার থেকে, যাতে ফেসবুক ভালো ভুমিকা রেখেছিল। এটা না লিখলেই নয়, বাংলাদেশে মৌলবাদিদের সমর্থক বুদ্ধিজিবিদের সাথে মিলে কথিত মার্ক্সবাদি সাইবার বিচরনকারিদের একটা বড় অংশ অনেক বছর যাবত আমার ব্লগ, আমার লেখালেখি নিয়ে নিরবতার আয়রন কার্টেন তৈরি করেছে। কিন্তু রিপোর্ট করে ব্লগ লিঙ্ক শেয়ার বন্ধ করিয়ে দেবার ঘটনা এত বছরে ঘটে নাই, যা ঘটেছে `বিছানাটা কার` কবিতাটি গৌতম মিত্রের অস্কার ওয়াইল্ড/মোহাম্মদ রফিক বানির নিচে সাটার পর।
পশ্চিম বঙ্গের প্রচুর অধ্যাপক বিভিন্ন ভাবে বাংলাদেশের প্রচুর অধ্যাপকের সাথে যোগাযোগ রাখে। পশ্চিম বঙ্গের বহুল প্রচারিত লেখকদের পাশাপাশি সবচেয়ে অপ্রচারিত লেখকও বাংলাদেশের বই বাজারে মোটামোটি একটা অবস্থান পেয়ে যায়। দুই বঙ্গের মান্ধাতিয় লিটল ম্যাগ কেন্দ্রিক বুড়ো ভাম, আমলাচাটা গেয়ো সাহিত্য সম্পাদক, তাদের বেকার আত্মিয়স্বজনদের ইউনিয়ন, রিইউনিইয়নতো আকছার আছেই লাল ঝান্ডা, নিল ঝান্ডার ঈকার, ঊকার সমেত। শুনেছি পশ্চিম বঙ্গের প্রকাশনার বিপুল অংশ বাংলাদেশের বাজারকে বিবেচনায় রেখে কাটছাট করা হয়। এসব কিছু আমলে নিয়ে একজন গৌতম মিত্র যে একজন মোহাম্মদ রফিকের সুনজরে থাকতে চাইবে, আর সে নজর কাড়তে অন্যের চোখ যে উপড়ে ফেলতে চাইবে তা লেখা বাহুল্য। বিজেপি ভারতে একদিনে আসে না, বাংলাদেশেও ব্লগার হত্যাকারিরা এক রাতে আকাশ থেকে পড়ে নাই। পরতে, পরতে বিচিত্র ডান, বাম রক্ষনশিলতার সিধ গলেই মৌলবাদের সুই উপমহাদেশে ফাল হয়ে বিভাজনের বিষবৃক্ষকে পত্র, পুস্পে মঞ্জরিত করেছে।
না লিখলেই নয়, বরাবর প্রাগ্রসর কবি বলে পরিচিত, বিপুল জাতিয় পুরস্কারে সম্মানিত জাহাঙ্গির নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির সাবেক প্রভাষক মোহাম্মদ রফিক আশির দশকে তরুনদের ভেতর প্রিয় হ্যাপি আখন্দের অকাল মৃত্যু পরবর্তি অনুষ্ঠানটি আটকে দিতে চেয়েছিলেন। সামরিক স্বৈরাচারের বিরোধিতা করে সরব হওয়ার কারনে মোহাম্মদ রফিক তখন তরুন মহলে জনপ্রিয়া এবং জাতিয় কবিতা পরিষদের একজন গুরুত্বপুর্ন কর্তা। শামসুর রাহমানের নেতৃত্বে সে কবিতা পরিষদের প্রথম সারিতে নির্মলেন্দু গুন, সৈয়দ হক, রুদ্র মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ, মোহন রায়হান প্রমুখেরা। স্বৈরাচার বিরোধি ছাত্র আন্দোলন তখন তুঙ্গে। এর ভেতর হ্যাপি মারা যায় ড্রাগ ওভারডোসে। চারুকলা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হ্যাপির বন্ধুরা মৃত্যু সংবাদের সাথে সাথে টিএসসি সংলগ্ন ডাস চত্বরে অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্তটি জানানো হয় কবিতা পরিষদের টিএসসি দফতরে। তখন ওখানে হুমায়ুন আজাদ ও মোহাম্মদ রফিক এ অনুষ্ঠানের প্রবল বিরোধিতা করে বলে যে, ড্রাগ ওভারডোসে কারো মৃত্যুর অনুষ্ঠানে গেলে স্বৈরাচার বিরোধি আন্দোলনের ইমেজ ক্ষুন্ন হবে। এ নিয়ে ওখানে তুমুল বিতন্ডা হয়। নির্মলেন্দু গুন বলেন যে, উনি অনুষ্ঠানে যাবেন এবং পরে সময়মত যান। রুদ্র মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ ও ওনার সাবেক স্ত্রি তসলিমা নাসরিনও তখন কবিতা পরিষদের দফতরে ছিলেন, কিন্তু হ্যাপির অনুষ্ঠানে যোগ দেয়া থেকে বিরত থাকেন। আবৃতিকার শিমুল মুস্তাফা ও আমি অনুষ্ঠানটিতে অংশ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা হ্যাপির স্মৃতিমুলক অনুষ্ঠানে আসতে আপত্তি জানানোর কথা বড় ভাই লাকি আখন্দের কানেও পৌছে যায়, উনিও আর সে অনুষ্ঠানে আসেন নাই। এটা নিয়ে লাকি ভাইর প্রতি আমার বিরুপতা থেকেই গিয়েছিল এবং ওনাকে তা সরাসরি জানিয়েছিলাম।
দুই বঙ্গের হিন্দু, মুসলিম আদপ, বেয়াদপ, সিগারেট লুকালুকি, আশরাফ আতরাফ, ইত্যকার সামন্তিয় প্রবনতা কথিত প্রাগ্রসরেরা ধারন ও লালন করেই বাংলাদেশে জামাতি-মার্ক্সিস্ট প্রবর্তনা বিকশিত হয়েছে। তার ওপর বাবু স্নবারি বজায় রেখে পশ্চিমের বিশোদ্গার, মানবিক উন্মোচনের প্রত্যেক ধাপে অবদমনের পিছুটান। যৌনতা নিয়ে বললেই তাকে পর্নোগ্রাফি মনে করা, সমকামিদের অধিকার নিয়ে বললে তাকে নারিবিদ্বেষের সাথে তুলনিয় করা। যে ছাড়্গুলো দিলে গাদাগাদির ভিড়ে নিশ্বাসের অবকাশ বা স্পেস তৈরি হয় তা আমাদের দিতে রাজি নয় গৌতম মিত্র এবং মোহাম্মদ রফিক গং। ওনারা চাইছেন পুজা। আবার চারু মজুমদার, শিরাজ শিকদারও মাও সেতুং পুজার কাল্টে বলি দিতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ও বংগবন্ধুকে। আমার পুজার আচার অনুষ্ঠান, তোমার পুজার চেয়ে ভালো এসব প্রনোদনাতেই কি নৃশংসতার বিজ উপ্ত থাকে না? গৌতম মিত্র যে জীবনানন্দের গবেষনা করেন, মোহাম্মদ রফিক যে গ্রামিন লোকায়ত আবহ তার কবিতায় আনেন, সে জীবনানন্দ এবং সে গ্রামিনতা একের অনুষ্ঠানের জন্য, আরেকের অনুষ্ঠানকে সেন্সর করে নাই। এগুলোকে বলে প্রিটেনশান। এই প্রিটেনশানগুলোর অর্গল খোলার পথ না পেয়েই মাদক ও ধর্শনের সংক্রামক প্রসার হয়েছে। আমরা ব্যাপক পরিসরে পরিবেশ দুশন, বৈশম্য, সাম্রাজ্যবাদ, ধর্মের বড় বড় কথা বলবো আর কাছের অনান্তরিক অবদমনকারিদের ঘর জামাইর আদর জানাবো, তাতে হিতে বিপরিত হবে এবং হচ্ছেও। এই লেখার সুত্রে আবারো প্রত্যেক ব্লগার হত্যার বিচার চাই এবং ব্লগ লোপাটকারিদের ব্যাপারে সচেতন হবার আহ্বান জানাই।
৩১/০৫/১৯
ব্রিটানি, ফ্রান্স