অলঙ্করণ: পাপিয়া জেরীন
তখন সবাই বিস্রস্ত ছিল
চঞ্চল আশরাফপ্রকাশিত : জানুয়ারি ২৮, ২০১৯
ওই তো, বৃষ্টির মধ্য দিয়ে হুডতোলা রিকশায় বসে মামুন আসছে। রাস্তার উপর তীব্র গতিতে উড়ে যাচ্ছে আর আছড়ে পড়ছে বৃষ্টির শাদাটে ছাট— রিকশাটাকে দেখাচ্ছে ঘোমটা-পরা কোনো দূরাগত কুঁজো ও নিঃসঙ্গ বুড়ির মতো, তার নীল আচ্ছাদান থেকে আংশিক উন্মুক্ত মামুনের মুখ একবার ঝাপসা হচ্ছে, একবার দেখা যাচ্ছে না। সম্ভবত ওই গতির বিপরীতে বাতাস তীব্র বলে, আসতে দেরি হয়ে যাচ্ছে তার; আর আমাদের নিশ্চিত হতে দেরি হচ্ছে ওই মুখখানা মামুনের কি-না; কিন্তু এই গল্পটা আগে থেকে যাদের জানা থাকবে, তারা বুঝতে পারবে— ওই তো মামুন; কেননা, গল্পের মধ্যে যখন বৃষ্টি শুরু হয় এবং ক্রমে বেড়ে যেতে থাকে বর্ষণ, তখন বেরিয়ে পড়ে সে ও রিকশায় ওঠে। কেননা মেঘ ঘন হওয়ার আগেও তার বুকটা থেকে থেকে মোচড় দিচ্ছিল।
চলেই তো যাচ্ছিল জীবনখানা, মামুনের। গতকালও বলা যেত সে চাইলে অভীষ্ট গর্তে গিয়ে পড়বে তার ছুঁড়ে দেয়া মার্বেল, যে-কোনো তবলাবাদকের আঙুল ও করতলে কাহারবা শুরু হলে শেষ না হওয়া পর্যন্ত এর মধ্যে যে ঢুকে পড়ে না অন্য কোনো তাল, গতকাল পর্যন্ত তো তাই ছিল। অন্তত কোনো ঘটনা ছিল না।
কিন্তু শুকচাঁদের সঙ্গে হঠাৎ বহুদিন পর, তার আজ দেখা হয়েছিল। যেন কার লেখা একটা গল্পের শুরুতে সে পড়েছিল, মানুষ নুয়ে পড়ে। তার মনে হলো, না, শুকচাঁদ নুয়ে পড়ে নি। অন্তত তার ঘাড় আগের মতোই সোজা, যা বহন করছে শরীরের তুলনায় বড় মাথাখানা আর গোলগাল-বাদামি মঙ্গোলীয় চেহারা। ‘তুই শুকচাঁদ না?’ জিজ্ঞাসা করতেই নির্মীয়মাণ কাঠের শোকেসে ব্যস্ত-নত মুখ তুলে সে যখন তাকায় মামুনের দিকে, অভিব্যক্তিরিক্ত সেই মুখ দেখে সে বুঝতে পারে, মানুষ নুয়ে পড়ে— কথাটা অংশত সত্য নয়। রঙে চুবিয়ে ন্যাকড়া কাঠে ঘষছিল সে। মামুন রিকশা থেকে তাকে দেখতে পেয়েছিল। ভেবেছিল, চৌদ্দ বছর পর এটা এক মহা আবিষ্কার, শুকচাঁদকে সে পেয়েছে; কিন্তু তাকে আদৌ কি খুঁজেছিল? দেখে সে আশ্চর্য হোক, এটা চেয়েছিল। বাল্য সহপাঠী কি-না! মাইক টাইসন যেমন দুর্বল প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করে প্রকৃত উল্লসিত হয় না এবং ‘এই জয়ে আমি আনন্দিত ও ঘর্মাক্ত’— বোঝাতে গিয়ে তোয়ালে দিয়ে এক হাতে গা মোছে ও অন্যটি দর্শকের উদ্দেশে নাড়ে এবং মঞ্চ থেকে নেমে যেতে থাকে, শুকচাঁদের সঙ্গে মামুনের দেখাটা হয়েছিল আজ সেরকম।
‘কতদিন হলো তোর, এখানে?’ তার হাতে তখন এক টুকরো ভেজা কাপড়, রঙিন— বা, মাইক টাইসনের সেই অবধারিত তোয়ালে। মামুন জানত সে বোবা বা বধির হয়ে যায় নি, আবার জিজ্ঞাসা করলো, ‘কতদিন রে তোর, এখানে?’ নাসিকাচূড়ায় বিনবিনে ও উজ্জ্বল ঘাম, তার কান ও মাথার মাঝখানে একটা পেন্সিল সে দেখতে পায়। শুকচাঁদ বোবা বা বধির হয়ে থাকে, তবু ‘আমাকে ভুলে গেলি তুই!’ মামুন বরে। দোকানের কোনো এক কোণ থেকে কে একজন বলে ওঠে, ‘সাব রে না-চিনলে খাড়াইয়া দেহস কী, হাত লাগা!’ নিজের হাত নিয়ে ব্যস্ত হয় সে; ‘মন খারাপ, না?’ মামুন বলে। ‘উঁ’, একটা শব্দ হলো; কিন্তু কোথা থেকে, বুঝতে পারে না সে। ‘আছিস তো, এখানে? আবার আসবো।’ মামুন বেরিয়ে পড়ে। শুকচাঁদ তার বাল্যবন্ধু ছিল।
এখন সে বিস্তির ঘরে, সেখানে ফ্লুরোসেন্টের আলো। এই দুপুরেও দরজা-জানালা বন্ধ। সে বুঝতে পারে, সঙ্গমের আর দেরি নেই। এখানে আসার দিন ঘুম থেকে উঠে দৌড়াদৌড়ি করে, ঘামটাম মুছে তাকে যে ছোলা খেতে হবে, সে টের পায়। কেননা, তৃতীয়বার ছাড়া বিস্তির কাঁপুনি আসে না। কোনো-কোনো দিন তার মনে হয়, কেবল অশ্বই পারে ওর চাহিদা পূরণ করতে, ওকে তৃপ্ত ও সুখী করতে। এও মনে হয় যে, মানুষ হয়ে জন্মানোটা তার ঠিক হয় নি। বিছানার এক প্রান্ত থেকে বিস্তি আমন্ত্রণ জানায়। না, ‘এসো’ বা ‘আস’ বলে না, বলে ‘শও।’ ‘শোও’-এর উচ্চারণ সম্ভবত সে জানে না, বা করতে পারে না। কিন্তু শয্যাকর্মী হিসেবে সে যথেষ্ট শিক্ষিত। স্টিরিওতে বিছানাদৃশ্যের আবহসঙ্গীত হিসেবে ডায়না রসের ‘কাম ইন ফ্রম দ্য রেইন ফ্রম দ্য রেইন’ বাজছে। মনে মনে বলে মামুন, ফ্রম নোহোয়্যার অ্যান্ড গোয়িং টু দ্য বেড। ঠিক তখনই পশমশূন্য বক্ষপটে চিমটি কেটে বিন্তি বলে, ‘চলো না একবার। কক্সবাজার। অ্যাই, যাবে না?’
আদরময় এই আবদারটুকু মামুন শুনছে কি-না বোঝা যায় না; তবে সিলিংয়ের কারুকার্যভরা পাখার দিকে তাকিয়ে সে দেখতে পায়, চৌদ্দ বছর আগেকার সেই ক্ষমাহীন দৃশ্য: একটা দোকানের সামনে বিক্ষিপ্ত ও সমবেত লোকজন। ভিড় ঠেলে এগিয়ে দেখে, ঠোঁট ফেটে রক্ত বেরোচ্ছে শুকচাঁদের, কপালের ডান দিক ফুলে আস্ত একটা ঢিবি হয়ে গেছে, অশ্রু-রক্ত-ধুলামাখা মুখ নিয়ে দু’হাত দু’দিকে ছড়িয়ে সে বসেছিল। মামুনকে দেখে সে উঠে দাঁড়ায়, ‘ওরা আমারেএ মালাউনের বাচ্চাআ কইছে ক্যান’— রোদন, ক্ষোভ ও চিৎকারে একাকার ও প্রলম্বিত স্বরান্তের ফাঁকে মামুন ওর রক্তমাখা দাঁত দেখে, উঠে এসে ধুলাময় দু’হাত সে প্রতিবাদের সরলতায় মামুনের কাঁধে রাখে ও তাকে আমর্ম ঝাঁকুনি দিয়ে বলে, ‘তুই আমারেএ কঅ, আমারেএ মালাউনের বাচ্চাআ কইছএ ক্যান’— কান্না ও চিৎকারের মধ্যে সে কোনো পার্থক্য রাখে না, ‘কইবি না?’ ভিড় থেকে তখন মামুনের কানে বিচিত্র স্বর একসঙ্গে এসে পড়ে: ‘ইছলামি ঠোঙা কইছে, জিব্বা ফালাইয়া দিলে কী অইতো।’ এবার একক কণ্ঠ, ‘মোছলমানের দ্যাশে থাকছ, ইশাব কতা কইবি না?’
বিন্তির বুকের দিকে মামুন আবেদনহীন তাকিয়ে, অভ্যাসবশত ব্লাউজের হুকের দিকে হাত বাড়ায়। ততক্ষণে গান থেমে যায়। উপরের একটা খুলে সে থামিয়ে ফেলে তার আঙুল ও বিছানার কোণে রাখা প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে এবং তা ঠোঁটে চেপে জানালার দিকে যায়। ‘অ্যাই, কী খুলতে কী খুলতেছ’ বলে বিছানা থেকে নেমে প্রায় দৌড়ে এসে মামুনের কাঁধে হাত রেখে বিন্তি এখন তার বুকোমুখি দাঁড়িয়ে; চৈত্রের লু-হাওয়ার মতো নিঃশ্বাস মামুনের বুকে আছড়ে পড়ছে, জোরালো ও এলোমেলো, ‘আমি যেভাবে তোমার কাছে আসি, তোমাকে চাই,’ সিগারেটের ধোঁয়া জানালার কাচে ঘষা খেয়ে ছড়িয়ে পড়ে; মামুন তার কানকে শুনতে দেয়, ‘এভাবে কেউ কাউকে চায়, বলো?’ তার শাড়ির আঁচল মামুনের কাঁধ-ধরা বাহুর উপর খসে পড়ে। স্বগতোক্তির স্বরে বলে, ‘আকমল চেয়েছিল আমাকে। জাফরও। আমি গেছি? ওদের কত টাকা।’ মামুন শোনে কি-না বলা যায় না, তবে বিন্তিকে সে বলে যেতে দেয়, ‘টাকা আমার দরকার, কিন্তু আমি টাকার কাঙাল না।’ মামুনের বুকে মাথা রাখে সে— ‘আচ্ছা আমার একটা কথা শুনবে তো! বলতে খুব সংকোচ হচ্ছে।’ রুদ্ধকক্ষে নায়িকার কী সংকোচ হতে পারে, হলেও তা কেন ও কী রকমের, সেটা বুঝতে মামুনের খুব দেরি হয়ে যায়। কেননা, ‘হ্যাঁ, বলো’ বলার আগেই মামুনকে জানালায় ঠেসে ধরে তার শরীর ঘষতে শুরু করে বিন্তি নামের সেই নারী ও বলে ফেলে, ‘আমাকে হাজার পঞ্চাশ টাকা দেবে?’ মামুনের ঠোঁটে, তর্জনি স্থাপন করে ‘উহুঁ, আজ না। কাল।’ ঢং ঢং ঢং। ঢং। বুকের মধ্যে এই ঘণ্টাধ্বনির কম্পন শেষ না-হতেই সে শুনতে পায়, ‘যেভাবেই হোক।’ ঢং ঢং। চর্মচক্ষে সে দেখে, ‘সিক্রেটস অব অ্যা ম্যারিড ম্যান’-এর বিবাহিত লোকটির মতো সে বিন্তির ফ্ল্যাটে উঠছে সিঁড়ি বেয়ে, তারপর খট। খট। খট খট। দরজা খোলার আগে ভাঁজ-করা টাকায় হাত বোলাচ্ছে সে। আ, কী দৃশ্য।
তখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ত মামুন। শুকচাঁদেরও একই শ্রেণিতে পড়ার কথা তখন, কিন্তু পঞ্চম থেকে সে শ্রেণিহারা হয়ে পড়ে। তখন খালকাটার কাল চলছে— মামুন জেনেছিল, খালটা শুকচাঁদের জমির উপর দিয়ে বয়ে যায়, একটু একটু করে সে এও জেনেছিল— চার বোনের বিয়ে দিতে গিয়ে শুকচাঁদরা জমিহারা হয়ে বর্গা চাষে বাধ্য হয় এবং তারপর বর্গাহারা হয়ে পড়ে। স্পষ্ট সে জেনেছিল, ওর বড় বোন বিধবা হয়ে ফিরে আসে। কলেরা তখনও গ্রামে দুরারোগ্য ব্যাধি ছিল। তারপর, আরো স্পষ্ট সংবাদ এসেছিল; সেই বোন, মাঘী পূর্ণিমার রাতে গায়ে আগুন দিয়েছিল। ‘দিদি তো মরে নাই। আত্মহত্যা করলে কি মরে?’ ফুলোগাল ও উপচানো চোখ নামিয়ে শুকচাঁদ বলেছিল।
‘উমম। উম উঁ। উঁ। কাল আসবে। আসবে প্লিজ। রাখবে তো কথাটা?’
‘হ্যাঁ। আসবো। না, আসবো। কোন কথা? ও, হ্যাঁ, আচ্ছা।’
‘উমম। ভীষণ ভালো তুমি। তোমার বউটাও। ভালো।’
‘আমার বউ?’
‘হ্যাঁ। চমকে যাচ্ছ যে! আমি কথা বললাম। ওর সাথে। গতকাল। ফোনে।’
‘কিন্তু নাম্বার পাইছ কোত্থেকে?’
‘ভয় পাইছ? আমরা তো একই কলেজে পড়াশুনা করছিলাম। সপ্তাখানেক আগে দ্যাখা হইল। শ্যাওড়াপাড়ায়।’
নীরবতা।
‘অ্যাই। খোলো তো! আমার হয়ে যাচ্ছে।’
‘না।’
‘আমাকে আনফিনিশড রেখে না-টা চলবে না।’
নীরবতা।
‘লেট মি ইউজ মাই মাউথ।’
খবর পেয়ে পরদিন শুকচাঁদের বাড়িতে গিয়েছিল মামুন। ইটের লাল ধুলিময় রাস্তা থেকে মাটির পথে তাকে সেই প্রথম টানা দেড় মাইল হাঁটতে হয়েছিল। তখনও শুকচাঁদের দিদিমা বেঁচে ছিল। ‘কী কমু বাপ, দেখি আগুনের মইদ্যে গীতা। দুখান আত বাড়াই দৌড়াই আইসতেছে আমার দিকে। ডরাইছিলাম। এক বালতি জল মারছিলাম। মাইনষে কয় খ্যাতা চাইপে দরলে...’
বিন্তির বিভিন্ন কর্তব্যে মামুন হঠাৎ খাঁটি বোকার মতো উত্থিত বোধ করে। এতক্ষণ তার হাত ছিল জড় ও নিশ্চল, শরীর ছিল অক্রিয় ও অসাড়, চোখ ছিল স্মৃতিদৃশ্যমগ্ন ও বর্তমানচ্যুত; তবু সে টের পায়— জীবনে এই-ই প্রথম নারীস্পর্শের মধ্যে থেকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও উদাসীনতা বোধ করছে। আরো গম্ভীর হয়ে যায় সে। ‘তোমার কি মন খারাপ?’ মুখ তুলে বিন্তি বলে। হঠাৎ একটা বাজের শব্দ শোনা যায় তখন। একটু কেঁপে উঠলেও ঢোঁক গিলে বিন্তি বলে, ‘যা গরম পড়তেছিল। এরই মধ্যে কখন মেঘ করলো টেরই পাইলাম না। আঃ, বৃষ্টি হবে।’ মামুনের শরীরে উপুড় সেই মুখ আবহাওয়াবিদের আশ্বস্ত স্বরের সঙ্গে দোলে— তারপর শোনা যায়, ‘তুমি কোনো কথা বলতেছ না, তুমি ডিসপ্লিজড, আমার ওপর?’
শব বহনের একটা দৃশ্য, বাস্তবিক, মামুনের মনে পড়ে; সে-বার খুব বন্যা হয়েছিল। রীতিমতো নাব্য হয়ে উঠেছিল ঢাকার রাস্তাগুলো। তাদের বাসার সামনের সেই জলমগ্ন পথে শাদা চাদরে ঢাকা একটা লাশ কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছে কিছু লোক। পানি থেকে লাশ ছিল বড়জোর বিঘৎখানেক উপরে। কোথাও গর্ত আছে কি-না, তা পরীক্ষা করে সতর্ক গমনের জন্য সামনের দুজনের হাতে ছিল একটা করে বাঁশ। ছাদের কার্নিশে বসে মামুন দেখেছিল, ছপ ছপ শব্দ তুলে, জল কেটে চলে যাচ্ছে শববাহকরা। চলে যাচ্ছে।
‘অ্যাই, চুপ করে আছো কেন, কী ভাবছো?’ বিন্তি বলে। এই ফ্ল্যাটে যেদিন প্রথম আসে মামুন ও উলঙ্গ হয়, সেদিন বিন্তি এ-প্রশ্নই করেছিল তাকে। ‘কেউ আইসা পড়লে?’ ‘ল্যাচ-কীর ওপর একটা নোটিশ লাগানো আছে। উইল বি ব্যাক অন স্যাটারডে নাইট।’ বিন্তির সঙ্গে তার জীবনের প্রথম শুক্রবারে, সে তাকে এভাবে আশ্বস্ত করেছিল। ‘তুমি খুব ভীতু’ বলে দু’আঙুলে নাক ধরে দুলিয়েছিল মামুনের মাথা, ‘কেউ এলে ভাববে উইক এন্ডে বেড়াতে গেছি কোথাও।’ ‘কিন্তু আলো জ্বলতে দেখলে?’ স্ফীত হয়েছিল বিন্তির ঠোঁট, ‘বাঃ শূন্য ঘরে তোমরা আলোটাও জ্বলতে দেবে না বুঝি?’ মামুন তাকিয়ে ছিল সিলিংয়ের দিকে। হঠাৎ পাখা ঘুরতে শুরু করলে তার কারুকার্য হারিয়ে যেতে থাকে, কিন্তু বাতাস বেশ প্রীতিকর মনে হলে সে বলে, ‘আলো আছে, কিন্তু কেউ নাই, ব্যাপারটা অদ্ভুত, না?’ অভিভাবিকার স্বর থেকে বিন্তি বলেছিল, ‘আলো থাকলে, এই ধরো পোকামাকড় আসতে পারে না।’ বিস্ময়কর যুক্তি। কেননা মামুন জানত, পতঙ্গরাই আলোয় ভিড় করে বেশি।
বাইরে বৃষ্টি ও বাতাসের মাতন, মাঝে-মধ্যে বাজের শব্দ। ‘এত কিছু করছি, তুমি কিছু ফিল করতেছ না? নিশ্চয়ই কিছু ভাবতেছ তুমি।’ হ্যাঁ, মামুন ভাবছে টানা একশো বছর শহরটায় বৃষ্টি হলে কেমন হয়! কেমন হয় বাজ পড়লে একটার পর একটা, সব কিছু ভেসে বা ডুবে গেলে— আর বাজের শব্দে সবাই বধির হয়ে গেলে!’
মামুনের অক্রিয় ও স্থির শরীর রেখে বিন্তি বসেছে আয়নার সামনে। বাইরে বৃষ্টি একটানা। এখন বেরিয়ে পড়া যাক মামুনের। সে উঠে শার্ট পরে। আয়নায়, বিন্তির পাশে সেই প্রতিফলন দেখা যায়। চুলে চিরুনি গেঁথে, ‘সে কী, যাচ্ছ’ আয়না থেকে মুখ ঘুরিয়ে বিন্তি বলে। ‘তোমার জন্য ভুনা খিচুড়ি আর চিকেন করলাম কেন তাহলে? আর বাইরে তো বৃষ্টি।’ তর্জনি জানালার দিকে তুলে সে বলে। মামুন এগিয়ে যেতেই বাংলা সিনেমায় প্রচলিত মুহূর্তের মতো, দ্রুত পদক্ষেপে তার কাছে সরে আসে ও প্রস্থানের গতি-প্রতিরোধী দু’বাহু তার শরীর বেষ্টন করে। ‘এমন করতেছ কেন তুমি? বসো না একটু।’ বলে সে তাকে বিছানায় বসায় ও তার চুল থেকে চিরুনি তুলে মামুনের চুল আঁচড়াতে থাকে। এ-মুহূর্তে তার বুক থেকে মামুনের মুখের দূরত্ব প্রায় নেই। ‘শ-রী-র খা-রাপ? কাল চলে এসো। আসতেছ কিন্তু। কাল। আর ওটা? মনে থাকবে তো! ওই, ব-ল-লা-ম-যে।’ দাঁড়ানো থেকে এবার সে মামুনের গা ঘেঁষে বসে। ‘তোমার জন্য অপেক্ষা করবো আমি।’ বাঁ হাতে গলা বেষ্টন করে তার গালে গাল ঘষে, ‘উমম।’ তারপর উঠে দাঁড়িয়ে, ‘বসো, তোমার জন্য নিয়ে আসছি’ বলতে পারার পর কিচেনের দিকে চলে যায়।
আর তখনই দরজা খুলে দ্রুত সে সিঁড়ি পেরিয়ে বাইরে চলে আসে। বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে ঢাকা। একটা রিকশা দেখামাত্র সে উঠে পড়ে তাতে। চলন্ত রিকশায় আরেকটা সিদ্ধান্ত সে নেয়; বাড়িতে গিয়ে ডলিকে, মানে তার স্ত্রীকে খোলাখুলি বিন্তির এই ব্যাপারটা বলবে। শুনে আবহমান বাঙালি নারীর মতো সে কি কেঁদে ভাসিয়ে দেবে তার শান্ত চোখ আর ফর্সা মুখখানা? বা, সাড়ে চার বছরের গড়ে তোলা দাম্পত্যঘর, বন্ধন ও এমব্রয়ডারি ছেড়ে সে চলে যাবে না-কি?
মামুনের প্রত্যাবর্তনের বিপরীতে বাতাস তীব্র— সেই নারীর কাছ থেকে ডলির কাছে পৌঁছতে তার যতটা সময়, বাতাসের তীব্রতায় তা আরও প্রলম্বিত হচ্ছে। এই ফাঁকে রিকশায়, প্লাস্টিকের আচ্ছাদনের নিচে আমাদের মামুন এটা তো ভাবতে পারছে যে, সংসার ছাড়া এখন তার হারানোর কিছু নেই। আপাতত পঞ্চাশ হাজার টাকার ধকল কাটিয়ে সেটা টিকিয়ে নেয়া যাবে। যাবে না? কিন্তু এরপরও বিন্তি যদি পুকুরপাড়ে বড়শি নিয়ে বসে থাকে? আহা। হুমম।...
আর শুকচাঁদের সঙ্গে কি তার দেখা হবে, আবার? আহ হাঃ, এখন তাকে নিয়ে ভাবার দরকার মামুনের নেই।