ড. তানভীর রাতুলের প্রবন্ধ ‘মিলন বা ঐক্যবদ্ধ ভালোবাসা’
প্রকাশিত : মে ২৯, ২০২২
কেউ কেউ মনে করে, ভালোবাসা বিদ্যমান হওয়া শুরু হয় ঠিক তখনই যখন পারস্পরিক সম্পর্ক সম্প্রদায়ে বা ঐক্যবদ্ধতায় পরিণত হয়। ঠিক তখনই, যখন একজনের স্বার্থ ও অন্যের স্বার্থের মধ্যে সমস্ত পার্থক্য একত্রীকৃত হয় বা দূর হয়ে যায়। ধারণাটি হলো, প্রেমের একতাবদ্ধতা একটি উদ্বেগের মিলন বা সংশ্লিষ্টতা যাতে কেউ যখন সেই উদ্বেগ বা সংস্রবের বাইরে কাজ করে তখন সেটা একা নিজের বা অন্যের জন্যই শুধু নয় বরং উভয়ের স্বার্থেই করে। অন্যরা প্রায় একই রকম, তবে কিছুটা বেশি মধ্যপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে দাবি জানায় যে, প্রেম প্রেমীদের যত্ন, উদ্বেগ, মানসিক প্রতিক্রিয়া ও কর্মের আংশিক সংমিশ্রণ। উভয় ধারণার ক্ষেত্রে যা লক্ষ্যণীয় তা হলো, প্রেমের জন্য প্রেমীদের উদ্বেগের প্রকৃত মিলন বা একীভূতকরণ প্রয়োজন। আর তাতে এটি স্পষ্ট হয়ে যায় যে, উভয় বিশ্লেষণই প্রেমের ধারণাটিকে দুজন প্রেমিক-প্রেমিকার একে অপরের প্রতি যে মনোভাব গ্রহণ করে তা না বুঝিয়ে এটাকে একটা সম্পর্ক হিসাবে ভাবে। একজনের স্বার্থ ও অন্যের মধ্যে পার্থক্য কেবল তখনই অদৃশ্য হয়ে যায় যখন তারা একসাথে নিজেদের যত্ন, আগ্রহ, উদ্বেগ ইত্যাদির মনোভাবের যোগসূত্র ঘটিয়ে মিলেমিশে যায় এবং একজনের অন্যের প্রতি বা উভেয়েই একে অপরের প্রতি এসবের কেবলমাত্র একটি নির্দিষ্ট মনোভাব থাকাটা ভালোবাসা হিসাবে গণ্য হয়ে ওঠার জন্য যথেষ্ট নয়। দুজন প্রেমিক-প্রেমিকার নিজেদের ভেতর নিয়োজিত হয়ে এই ভাগাভাগি করা যত্ন ও উদ্বেগের সাম্যবস্থ্যার রূপকায়িত আমরা ধারণার বিষয়ে প্রেক্ষাপট সরবরাহ করে।
ভালোবাসার মিলনাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে, ভালোবাসার মানে খুঁজে পাওয়া যায় দুটি আত্মার একীকরণ বা একীভবনের রূপক অর্থের পরিবর্তে আক্ষরিক অর্থের মাধ্যমে। যাই হোক, এটা স্পষ্ট নয় যে, আত্মা শব্দটা দিয়ে আসলে কি বোঝায় এবং ভালোবাসা বা প্রেম কিভাবে দুটি আত্মার আক্ষরিক সংমিশ্রণ হতে পারে। এসব তাত্ত্বিকদের মনে যা আছে তা হলো, প্রকৃতঅর্থে যেভাবে, প্রেমের মাধ্যমে, প্রেমিক-প্রেমিকারা সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্তি হিসাবে তাদের পরিচয়কে পুনরায় সংজ্ঞায়িত করে। প্রেম হলো কার্যত প্রতিটি ব্যক্তিগত অনুষঙ্গকে বিষয় করে একক ব্যক্তির ওপর পারস্পরিক সংজ্ঞার ঘনত্ব ও নিবিড়তার কেন্দ্রবিন্দু। এই প্রক্রিয়ায় প্রেমিক প্রেমিকারা আগ্রহ, ভূমিকা, গুণাবলী ও অন্যান্য অনুষঙ্গ ভাগ করে নেয় বা একই রকমের মনে হয়। ফলাফল হলো যে, আগে দুজন যে দুটি পৃথক পরিচয় ছিল তা এখন একটি সম্মিলিত পরিচয়ে পরিণত হয়েছে। এবং আংশিকভাবে তা করা হয় একে অপরকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার অনুমতি দিয়ে। নিজেরই আত্মপরিচয়টা নতুনকরে সংজ্ঞায়িত করতে।
অন্য একটি ধারণা অনুসারে, প্রেমের জন্য যা প্রয়োজন তা হলো, শুধুমাত্র একটি আমরা গঠন করার আকাঙ্ক্ষা এবং সেইসাথে আমরায় যারা অন্তর্ভুক্ত তাদের বাদবাকি আকাঙ্ক্ষা যেগুলোর প্রতিদান অপরজন দেয়। তবুও এটি দাবি করে যে, এই আমরা হলো একটি নতুন সত্তা... প্রেমিক প্রেমিকাদের মধ্যে সম্পর্কের একটি নতুন জাল বা বাঁধন দিয়ে তৈরি যা থেকে তাদের আর আলাদা করা যায় না। সম্পর্কের এই জালটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রেমিক প্রেমিকাদের যৌথ উদ্যোগ নেয়ার কথা উল্লেখ করা যায়। যা কেবল তাদের মঙ্গলের জন্যই নয়, এই অর্থে যে, প্রত্যেকের মঙ্গল অন্যের সাথে আবদ্ধ বা অন্যজনের ওপর নির্ভর করে। তাদের স্বায়ত্তশাসন বা ব্যক্তিস্বাধীনতার স্বার্থেও। যেখানে আমরার প্রত্যেকেই কোনো কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার বা কিছু কিছু অধিকার যা আগে একজনের ছিল তা একতরফাভাবে অপরজনের কাছে হস্তান্তর করার যৌথ উদ্যোগ নেয়। এছাড়া এটা দাবি করে, প্রেমিক প্রেমিকারা প্রত্যেকে আমরার একটি অংশ হিসাবে একটি নতুন পরিচয় অর্জন করে। এমন একটি নতুন পরিচয় যা তাদের (ক) জনসমক্ষে দম্পতি হিসাবে পরিচিতি, (খ) যৌথ-মঙ্গল-উদ্যোগে অংশগ্রহণ, এবং (গ) একটি নির্দিষ্ট ধরনের শ্রম বিভাজন বা দায়িত্বের সীমান্ত রেখা নিয়ে গঠিত।
আমরার অন্তর্গত একজন ব্যক্তির নিজের হয়তো কোনো একটা কার্যক্রম পছন্দ হলো সেই আমরার অন্য ব্যক্তিটির জন্য। এই কারণে নয় যে, তিনি নিজে এতে আগ্রহী নন। বরং এইকারণে যে, অন্যজন আরও বেশি আগ্রহী হবে বিষয়টাতে, এবং তাদের একজনের অংশগ্রহণই যথেষ্ট। এটাই অংশীদারিত্ব, সেই বৃহত্তর পরিচয় আমরাতে নিবন্ধিত হওয়ার।
ঐক্যবদ্ধতার বিরোধীরা এই ধরনের দাবিগুলিকে অত্যধিক অধিকার চর্চা বা ব্যক্তিস্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ হিসেবে ধরে নেয়। তাদের মতে, ঐক্যর পক্ষের তাত্ত্বিকরা আমরা প্রতীতী বা ধারণার সত্তাতাত্ত্বিক প্রতিশ্রুতি বা অঙ্গিকারকে তথা গৃহীত দায়িত্বকে অতিরিক্তমাত্রায় আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করেন। এ থেকে ঐক্যতত্ত্বের দুটি নির্দিষ্ট সমালোচনা করা যায়। প্রথমটি হলো, যে ঐক্যবদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি মতে, ব্যক্তির স্বায়ত্তশাসন বা স্বশাসনের অধিকারের অবসান ঘটায়। স্বায়ত্তশানের মানে হলো, আমরা প্রতীতীতে অন্তর্গত প্রত্যেক স্বায়ত্তশাসিত বা সয়ংক্রিয় প্রতিনিধিরই ব্যক্তিস্বাধীনতা আছে। মানে, কেউ একজন কেবল যেসব ক্রিয়া করে শুধু তা-ই নয়, বরং তিনি কে বা কী হিসেবে নিজেকে অনুধাবন করেন, তাও নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার। কারণ বিষয়টা প্রত্যেকেরই নিজস্ব স্বার্থ, মূল্যবোধ, উদ্বেগ ইত্যাদি দ্বারা গঠিত। যাই হোক, ঐক্যবদ্ধতাতত্ত্ব একজনের স্বার্থ ও অন্যজনের স্বার্থের মধ্যকার স্পষ্ট পার্থক্য দূর করার ফলে এই ধরনের ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার লঙ্ঘন করে আর তাই প্রেমিক প্রেমিকাদের নিজস্ব স্বায়ত্তশাসনকেও ক্ষুণ্ন করে। আর যদি স্বায়ত্তশাসনই একজন ব্যক্তির ভালো গুণাবলির একটি অংশ হয়, তবে মিলন বা ঐক্যতত্ত্বানুসারে প্রেম জিনিসটাই খারাপ। এতটাই খারাপ যে, একতাবদ্ধ হওয়ারই দরকার নেই। তদুপরি, একজনের প্রিয়জনকে সেই একজনের ভালবাসার লক্ষ্যবস্তু হওয়ার জন্য একটি প্রয়োজনীয় অংশই হলো একজনের প্রিয়জন ব্যক্তি হিসেবে যেমন, সেটাকেই শ্রদ্ধা করা, আর তা করার জন্য সেই প্রিয় অন্যেরজনের স্বায়ত্তশাসনকে সম্মান করা প্রয়োজন।
ঐক্যতত্ত্ববিদরা বিভিন্ন উপায়ে এই আপত্তির জবাব দিয়েছেন। কেউ কেউ প্রেমে স্বায়ত্তশাসন হারানোকে প্রেমিক প্রেমিকার মিলন অর্জন করতে পারার জন্য পছন্দনীয় একটি বৈশিষ্ট্য হিসাবে দেখে। অন্যরা কিছুটা অনিচ্ছায় বলে যে, প্রেমে স্বায়ত্তশাসন হারানোটা আসলে ভালোবাসার একটি গ্রহণযোগ্য পরিণতি। তবুও আর কোনো যুক্তি ছাড়াই বলা যায় যে, এই দাবিগুলিকে বন্দুকের গুলিবর্ষণে কামড় দেয়ার মতো মনে হয়। একতাবদ্ধতা আর ব্যক্তির স্বাধীন স্বায়ত্তশাসনের মধ্যে এই টানাপোড়েন বা চাপা উত্তেজনাকে ভালোবাসার প্যারাডক্স বা প্রেমের আপার্তবৈপরীতা হিসাবে বর্ণনা করা যেতে পারে। যাই হোক, এটি এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি যা কেউ কেউ উপহাস করতে পারে। এটিকে কেবল একটি আপাত বিপরীতধর্মী বিকল্প সংকট বলাটা আসলে প্রকৃত সমস্যার থেকে পালানোর মতো।
দ্বিতীয় সমালোচনাটায় প্রেমের বিষয়ে একপ্রকার সারগর্ভ বা বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি জড়িত। এমতে, কাউকে ভালবাসার একটি অংশই হলো একজনের নিজের খাতিরে বা নিমিত্তেই একজনের নিজরে জন্য উদ্বেগ থাকা। যাই হোক, ঐক্যবদ্ধ বা একতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিগুলি এই ধরনের উদ্বেগকে অবোধগম্য করে তোলে এবং স্বার্থপরতা ও স্বার্থহীনতা বা আত্মত্যাগ উভয় সম্ভাবনাইকে পরিহার করে। কারণ একজনের স্বার্থ ও অন্যজনের স্বার্থের মধ্যে পার্থক্য দূর করার মাধ্যমে এটা একজনের স্বার্থকে অন্যের এবং তদ্বিপরীত অন্যের স্বার্থকে একজনের স্বার্থে পরিণত করে। মিলনাত্মক দৃষ্টিভঙ্গির কিছু প্রবক্তা এটিকে তাদের আনুকূল্য একদফা জোরদার যুক্তি হিসাবে দেখেন। কীভাবে একজনের নিজের ব্যতীত অন্য কারো জন্য উদ্বেগ রাখতে পারে, সেটা বোঝানো জন্য একতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি দৃশ্যত একজনের স্বার্থকে তার নিজের সত্ত্বার অংশ হিসেবে ব্যাখ্যা করে। অন্যথায় শোষিত হওয়ার ভয়ে মানুষের নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা এবং তাদের প্রেমিক বা প্রেমিকার কাছে সম্ভাব্য আকর্ষণীয় গুণাবলির কারণে মানুষের ভালোবাসা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষার মধ্যে একটি আপাত উত্তেজনা বিরাজ করে। আর তাই এক ধরণের স্বার্থপরতার ভিত্তির ওপরে সেটা প্রতিষ্ঠিত। আবেগপ্রবণ আদর্শ বা ভাবোদ্রেককারী মানসিক নীতি একটি আমরা গঠনের মাধ্যমে চাহিদা এবং স্বার্থের গভীর একীকরণ অর্জনের আকাঙ্ক্ষা দ্বারা প্রাথমিকভাবেই চিহ্নিত করা যায়। অনেকেই মনে করে, এখানে বর্ণিত এ ধরনের সামান্য স্বার্থপরতা উভয়পক্ষের কারো জন্যই কোনো দুশ্চিন্তা সৃষ্টি করার কথা নয়।
আপত্তিটা অবশ্য অন্যজনের জন্য একজনের উদ্বেগকে অহংকারপূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করার এই প্রচেষ্টার মধ্যেই রয়েছে। এই ধরনের প্রচেষ্টা অন্যজন বা ভালোবাসার লক্ষ্যবিন্দুটাকে অপ্রয়োজনীয় এবং সম্ভাব্য আপত্তিজনক উপনিবেশ বা অধীনস্থ হিসাবে বিবেচনা করে। প্রেমে পড়া একজনের উচিত অন্যজনের বা লক্ষ্যবস্তুর স্বার্থেই লক্ষ্যবস্তুর জন্য উদ্বিগ্ন হওয়া। এবং এ কারণে নয় যে, একজন কোনোভাবে প্রতিদানস্বরূপ কিছু পাওয়ার সম্ভাবনা রাখে। একজনের এই উদ্বেগ অন্যজনের জন্য থাকাটা, তা একজনের পূর্ব থেকে বিদ্যমান গুণাবলির ফলাফল বা নবঅর্জিত গুণাবলির অংশবিশেষ যেটাই হোক না কেন, উভয়ক্ষেত্রেই সত্য-সম্ভব হতে পারে। ইউনিয়ন বা ঐক্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গির উগ্রভাবে ওকালতি যারা করে এই সমালোচনাগুলি তাদের বিরুদ্ধে সফল হয়। তবে তা একতাবদ্ধতার ধারণা থেকে সত্যের উঁচ্ছবৃত্তি মানে অতিরিক্ততার ভেতর হতে কেন্দ্রবিন্দু বা শাঁস সংগ্রহ বা স্বীকার করতে আংশিকভাবে ব্যর্থ। অপ্রয়োজনীয় অহংবোধের পরিপ্রেক্ষিতে দ্বিতীয় আপত্তির প্রণয়ন করাটাই আংশিকভাবে উদ্ধারের পথ বা উপায় নির্দেশ করে। মানুষ বা ব্যক্তিরা আংশিকভাবে সামাজিক প্রাণী, এবং প্রেম সেই সামাজিকতার একটি গভীর বা প্রগাঢ় প্রণালি। প্রকৃতপক্ষে, একতাবদ্ধতা-তত্ত্বের নির্দিষ্ট বিষয়বস্তুর একটা অংশই হলো এই সামাজিক মাত্রা বা বিস্তারটা বোঝানো। এমন একটি উপায় বা পন্থা বোঝানো যেটাতে একজন মানুষ কখনো কখনো নিজেকে অন্যজনদের সাথে চিহ্নিত করে বা অংশ হয়ে যায়। আন্তঃর্নির্ভরতাকে এক ধরনের পারস্পরিক কল্যাণ ও সম্মান হিসেবে ভাবলে, এটা শুধুমাত্র পরস্পর নির্ভরশীল বা আন্তঃনির্ভরশীলই নয়, বরং একজন মানুষ যাকে বা যাদেরকে ভালোবাসে তারাই সেই একজনের সার্বিক সত্তার বা সামগ্রিকতার ভগ্নাংশ।
এই কথাগুলি থেকে এমন অনুপ্রেরণা পাওয়া যেতেই পারে যে, প্রেম একাধিক মানুষ নিয়ে সংগঠিত। একপ্রকার স্বয়ংদের সঙ্ঘ তৈরির প্রয়াসে মিলিত হওয়ার অনুধাবনা। সঙ্ঘবদ্ধ বা যুক্তস্বয়ং কাঠামো মোতাবেক, প্রেমিক প্রেমিকাদের মিথস্ক্রিয়া দ্বারা একটি তৃতীয় একীভূত সত্তা গঠিত হয়, যেটাতে প্রেমিক প্রেমিকারা একাধিক বিভিন্ন শর্তে এবং বিভিন্ন উদ্দেশ্যে এক সমবেত অনুষ্ঠানে অভিনয় বা অংশগ্রহণ করে। যাই হোক, এই সমন্বিত পদক্ষেপ পৃথক প্রতিনিধি হিসাবে প্রেমিকপ্রেমিকার আলাদা নিজস্ব অস্তিত্ব বা সত্তা ও পৃথক সংস্থা বা সঙ্ঘবদ্ধতার অনুশীলন অব্যাহত রাখার সম্ভাবনা, কোনোটাকেই মুছে দেয় না।
যদি ধরে নেওয়া হয়, প্রেমিক প্রেমিকারা তাদের নিজস্ব স্বতন্ত্র পরিচয় ত্যাগ করে না, তাহলে মিলনাত্মক বা ঐক্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই প্রেমিক প্রেমিকাদের নিজস্ব স্বার্থে অন্যজনের উদ্বেগটা বুঝতে পারা বা ব্যাখ্যা করার জন্য এমন আর কোনো নীতিগত প্রতিবদ্ধতা থাকে না। একতাবাদী বা মিলনাত্মক ও যুক্তস্বয়ং সঙ্ঘের ধারণাটা সমান্তরালে বিবেচনা করলে দেখা যাবে যে, স্বায়ত্তশাসন কোনো শূন্য-সমষ্টির খেলা বা লাভক্ষতির যোগফল নয়। বরং প্রেম সরাসরি প্রত্যেকের নিজস্ব স্বায়ত্তশাসন বা ব্যক্তিস্বাধীনতাকে উন্নত করতে পারে এবং বাস্তবসম্মত এবং সমালোচনামূলক স্ব-মূল্যায়নের মতো বিভিন্ন দক্ষতা, যা কিনা নিজের ব্যক্তিস্বাধীনতাকেই লালন করে, সেটাও বৃদ্ধি করতে পারে।
এই যুক্তস্বয়ং বা সঙ্ঘবাদী দৃষ্টিভঙ্গিটার কিছু সমস্যা যে নেই তা কিন্তু নয়— আর এই সমস্যাগুলি মিলনাত্মক বা একতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির অন্যান্য সংস্করণগুলিকেও প্রভাবিত করে। কারণ যদি সঙ্ঘ বা একাধিক আমি সম্বলিত আমরাকে তৃতীয় সত্তা হিসাবে বোঝা যায়, তাহলে এর সত্তাতাত্ত্বিক বা অস্তিত্ব বিষয়ক অবস্থান বা পদমর্যাদা এবং সেটা কীভাবে আবির্ভূত বা নির্ধারিত হয় সে সম্পর্কে আরো পরিষ্কার ব্যাখ্যা প্রয়োজন। এখানে প্রাসঙ্গিক হলো একাধিক মানুষের একই স্বার্থ বা উদ্দেশ্য এবং বহুবচন বিষয়ক দর্শনের। মানুষের একটি বহুবচন বা একাধিক সংখ্যক সদস্য গিয়ে গঠিত অস্তিত্বকে এর উপাদান সদস্যদের চেয়েও অধিক গুরুত্বপূর্ণ গণ্য করা উচিত। মানে, সঙ্ঘের অবস্থান ব্যক্তির ওপরে ও আগে। তবে আরো সতর্ক হতে হলে উচিত, আমরা সংক্রান্ত এই ধরনের আলোচনাকে রূপক হিসাবে বিবেচনা করা।
লেখক: ড. এস. তানভীর রাতুল; এফআরএসএ, এফআরএসএল
অধ্যাপক, স্কুল অব হিস্টোরি, ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যান্ড কালচার (ইতিহাস, ভাষা ও সংস্কৃতি)
পরিচালক, সেন্টার ফর নিউ অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল রাইটিং
লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়