ড. তানভীর রাতুলের দর্শনগদ্য ‘মূল্যায়িত ভালোবাসা’

শেষ পর্ব

প্রকাশিত : জুন ২১, ২০২২

মধ্যবর্তী অবস্থান
সম্ভবত ভালোবাসার সাথে মূল্য-বোধের সম্পর্ক বোঝার জন্য এমন ব্যাখ্যাও রয়েছে যা মূল্যাবান-মূল্যায়ন এবং মূল্যদান-মূল্যায়ন তত্ত্বদুটির মধ্যবর্তী কোন একটা অবস্থান বজায় রাখে। সর্বোপরি, যদি মূল্যায়নকে প্রত্যক্ষকরণ বা উপলব্ধির মতো কিছু মনে করা হয়, মানে পৃথিবীতে যাকিছু আছে তার প্রতি সাড়া দেওয়ার মত কোন একটা বিষয় বলে ধরা হয়, যদি মনে করা হয় মূল্য-প্রদান কর্ম বা সৃষ্টির মতো কিছু একটা, তাহলে স্বীকার করে নেওয়া উচিত যে, কোন কিছুর মূল্যায়নের কেন্দ্রীয় কারণই হচ্ছে প্রতিক্রিয়াশীলতা বা প্রভাবপ্রবণতা যা নিজেই একজন মানুষের সক্রিয়, সৃজনশীল পছন্দের উপর নির্ভর করতে পারে। সুতরাং, যেমন অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে মানুষের সাধারণ উপলব্ধিও সক্রিয়ভাবে মনোযোগের দিকনির্দেশ বা মনোনিবেশ করার উপর নির্ভর করে আর বিষয়গুলিকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করার জন্য ধারণা, ব্যাখ্যা এবং এমনকি যুক্তি স্থাপনও প্রয়োজনীয়; তেমনি এটাও ভাবা যেতে পারে যে, একজনের প্রিয় অন্যজনের মূল্যবান বৈশিষ্ট্যগুলি বা গুণাবলী তথা কর্মকান্ড থেকে ভালোবাসার জন্ম হওয়াটাও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ এবং ব্যাখ্যাসম্মত সুনজর বজায় রাখার নির্ভর করে।
 
কাউকে ভালোবাসার ক্ষেত্রে একজন মানুষ সক্রিয়ভাবে অন্যজনের মূল্যবান সম্পদ বা গুণাবলীর প্রতি এমন পরিচর্যা প্রদর্শন বা এমনভাবে অংশগ্রহণ করে থাকে যেন, একজন কেন অন্যজনকে অগ্রাধিকারমূলক আচরণ প্রদান করবে সেটার যুক্তিগত কারণও নিজেকেই সরবরাহ করতে পারে। যদিও একজন স্বীকার করতেই পারে যে বাকিদের কাছে প্রিয় অন্যজনের থেকেও অনেক বেশি পরিমাণে এই ধরনের গুণাবলী বা আত্মসম্পদ থাকতে পারে, তবে একজন মানুষ তার প্রিয় অন্যজনের সাথে যেভাবে করে সেভাবে অন্যদের মধ্যে প্রাপ্ত এই জাতীয় আত্মসম্মান বা অন্যকোন গুণাবলীর প্রতি মনোযোগ দেয় না বা প্রশংসাও করে না। প্রকৃতপক্ষে, মানুষ প্রিয়জনের মূল্যবান বৈশিষ্ট্যগুলির প্রতি নিজস্ব উপলব্ধি খুঁজে পায় বাকিদের প্রতি অনুরূপ প্রশংসাকে `নির্বাক` করার জন্য। একইভাবে, প্রিয়জনের কর্ম এবং চরিত্র উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে, মানুষ এমন একটি প্রশংসার আতসী কাচ দিয়ে দেখে, যার প্রবণতা হলো সেইসব প্রশংসার সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ ব্যাখ্যাকে `নীরব` করে দেয়া। এইভাবে, প্রেমে পড়া একজন প্রিয়জনকে মূল্যবান হিসাবে এমনভাবে খুঁজে পাওয়া যায় যাতে মূল্যায়নের উভয় উপাদানই জড়িত থাকে, যথা: মূল্যবানকে প্রশংসা অর্থাৎ একজনের অবশ্যই তার প্রিয় অন্যজনের মূল্যবান দিকের প্রতি প্রতিক্রিয়াশীল হতে হবে এবং মূল্যদান করা মানে একজনের মনোযোগ এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধ প্রশংসার মাধ্যমে অন্যজনের বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণবহ হতে হবে।
 
কেউ আপত্তি করতেই পারে যে প্রেমের এই মতবাদটি যা অন্যজনের বিশেষ মূল্যকে নীরব করে বা একজনের প্রিয় অন্যজনের জন্য ভালোবাসাকে এমন অযৌক্তিকভাবে নেতিবাচক ব্যাখ্যা করে যা প্রেম-ধারণার পরিপন্থী, মানে প্রেম ততটা যুক্তিহীন-বিচারশক্তিহীন আসলে নয়। কারণ, এটা মনে হতে পারে, এই ধরনের `নিস্তব্ধতা` নিছকই মানুষের `প্রেম জিনিসটা আসলে কেমন` এই প্রশ্নটা এড়ানোর জন্য নিজেদের চোখবন্ধ করে অন্ধ হয়ে যাওয়ার মত ঘটনা । তবুও এই অর্থে সেই প্রেমান্ধতা আপত্তিজনক নয়, কারণ (ক) মানুষ এখনও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সেই জিনিসগুলিকে চিনতে পারে যা প্রেমের-দৃষ্টি নীরব করে দেয়, এবং (খ) সত্যিই কোনও নিরপেক্ষ মানদন্ড নেই যা দিয়ে মানুষ মূল্যবোধ বা সমগোত্রীয় জিনিসগুলির মান নির্ণয় করতে পারে, এবং ভালবাসা হল একটি উপযুক্ত ধরণের আংশিক মানদন্ড যেটার সাহায্যে ব্যক্তিগত মূল্য প্রকাশ করা যেতে পারে। যাইহোক, কেউ এটাও ভাবতে পারে যে প্রেমের সেই দৃষ্টিগত পরিপ্রেক্ষিতটাই বিকৃত হতে পারে কি না এবং কোন নিয়মগুলির মাধ্যমে প্রেমের-সুনজর বা পরিপ্রেক্ষিতের এসব বিকৃতি বোধগম্য করা যায়। তদ্ব্যতীত, এটা মনে হতে পারে যে মূল্যবান মূল্যায়ন এবং মূল্যদান মূল্যায়নের সমন্বয় করার প্রচেষ্টা অন্তর্নিহিত আধিভৌতিক বা অধ্যাত্মিক প্রতিবন্ধকতাটা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়: `মূল্যবান মূল্যায়ন` হলো মূল্যের একটি প্রতিক্রিয়া যা পূর্ববর্তীভাবে আছে, যেখানে মূল্যদান মূল্যায়ন হলো সেই মূল্যের সৃষ্টি যা পূর্ববর্তীভাবে ছিল না। ফলস্বরূপ, এটি মনে হতে পারে, মূল্যবান-মূল্যায়ন এবং মূল্যদান-মূল্যায়ন পারস্পরিকভাবে স্বতন্ত্র এবং এদুটোর সমন্বয়সাধন অসম্ভব।
 
একটা একক তত্ত্বের ভেতরেই মূল্যবান-মূল্যায়ন এবং মূল্যদান-মূল্যায়নের পৃথক উপাদানগুলিকে একত্রিত করার চেষ্টা করে যেমন হয়েছে, তেমনি এমন মতবাদও আছে যা আধিভৌতিক পূর্বধারণা বা অনুমানকেই প্রত্যাখ্যান করে। মানে, প্রিয়জনের মান বা আত্মগৌরবের গুণাবলী মূল্যবান তত্ত্বের মতো প্রেমের আগে থেকেই বিদ্যমান বা মূল্যদান তত্ত্বের মতো প্রেমে পড়ার পরে সৃষ্ট, এদুটোর একটা অবশ্যই হতে হবে সেই ধারণাটা সঠিক নয়। পরিবর্তে প্রেম এবং মূল্যবোধগুলি একইসাথে যুগপত সৃষ্ট বা উত্থিত হওয়ার ধারণাটা বিবেচ্য হয়ে ওঠে। আর তাই উপরোক্ত দুইপ্রকার মূল্যায়নের বদলে আবেগ-মূল্যায়নের পরিপ্রেক্ষিতেও প্রেমের এক বিশদ বিবরণ উপস্থাপন করা যায়; যুক্তি দেয়া যায় যে, একজন মানুষ ব্যক্তিগত আবেগকেই `মূল্যায়ন` হিসেবে ধরে নিয়ে প্রিয় অন্যজন বা লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে ইতিমধ্যেই আগে থেকে উপস্থিত মূল্যবোধের প্রতি প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে, এই মান বা মূল্য একজনের আবেগের বিস্তৃত ও সামগ্রিক আদর্শানুসারেই লক্ষ্যবস্তু বা অন্যজনকে প্রদান করা হয়। (এটি কীভাবে প্রেমের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা হয়ে ওঠে তা পরবর্তী অধ্যায়ে আলোচনা করা হবে৷)
 
এর পরিবর্তে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াকে একটি রূপক ধারণায় অবতারণা করা যায়। যুক্তিটা অনেকটা এমন যে, জ্যাজ সঙ্গীতজ্ঞ বা নৃত্যশিল্পীরা যেমন যৌথভাবে তাদের অভিব্যক্তির চলমান প্রক্রিয়ায় প্রতিক্রিয়া প্রদানের মাধ্যমে তাদের সংগীত বা শিল্পকলার প্রকাশভঙ্গি বা বিষয়বস্তু নির্ধারণ করে, তেমনি প্রেমিকপ্রেমিকারাও যৌথভাবে `গভীর-নিবিড় তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া`য় জড়িত। যার ফলে তারা একসাথে জীবনযাপনের চলমান প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের যৌথ মূল্যবোধ ও পরিচয় তৈরি করে। এইভাবে এই মূল্যমানগুলি এমন কিছু যা প্রেমিকপ্রেমিকারা সম্মিলিতভাবে নিজেদের মূল্যবোধকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং প্রতিক্রিয়া জানানোর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তৈরি করে। কাউকে ভালোবাসার অর্থ হল এই ধরনের নিবিড়তার অংশীদার হিসাবে একজনের অন্যজনের সাথে জড়িত হওয়া। এই ব্যাখ্যাটি `বহুবচনের সংস্থা বা সঙ্ঘ` তত্ত্বের অনুরূপ, যেটি বন্ধুত্ব এবং অন্যান্য প্রেমময় সম্পর্কের ব্যাখ্যা প্রদান করতে ব্যবহার করা হয়।

লেখক: ড. এস. তানভীর রাতুল; এফআরএসএ, এফআরএসএল
অধ্যাপক, স্কুল অব হিস্টোরি, ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যান্ড কালচার (ইতিহাস, ভাষা ও সংস্কৃতি)
পরিচালক, সেন্টার ফর নিউ অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল রাইটিং
লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়