ড. তানভীর রাতুলের দর্শনগদ্য ‘ইরোস’

প্রকাশিত : এপ্রিল ২৬, ২০২২

ইরোস (গ্রীক ইরাস্থাই) বলতে মূলত কোনো একটি লক্ষ্যের প্রতি এক ধরনের আবেগপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা, সাধারণত যৌন আবেগের অর্থে ভালোবাসা বোঝায়, তাই আধুনিক ধারণা ইরোটিক (গ্রীক এরোটিকোস)। যদিও প্লেটোর লেখায়, ইরোসকে একটি সাধারণ আকাঙ্ক্ষা হিসাবে ধরা হয় যা অতীন্দ্রিয় সৌন্দর্যের সন্ধান করে— একজন ব্যক্তির বিশেষ সৌন্দর্য অন্যকে মনে করিয়ে দেয় যে, সত্যিকারের সৌন্দর্য যা আকার বা রূপ ও ধারণার জগতে বিদ্যমান। যে সুন্দরকে ভালবাসে তাকে প্রেমিক বলে। কারণ সে এতে অংশীদার হয়।

ইরোসকে আকাঙ্ক্ষার ভালবাসা বা অর্জনমূলক প্রেম হিসাবে বর্ণনা করা হয়। তাই এটাকে ধরা হয় অহংকেন্দ্রিক। এটাকে স্বার্থপর হিসাবেও বর্ণনা করা যায়। আর তাই প্রিয়জনের গুণাবলির, প্রিয়জনের ভালত্ব বা সৌন্দর্যের প্রতিক্রিয়া-বিশেষ হিসেবেও এটাকে ভাবা যেতে পারে। ইরোসের এই বর্ণনায় যা স্পষ্ট হয় তা হলো, যৌনতা থেকে দূরে সরে যাওয়া। ইরোসিক অর্থ হলো কোনো কিছুকে ভালোবাসা। এমনভাবে ভালোবাসা যা লক্ষ্যবস্তুর যোগ্যতার ওপর বা ব্যক্তিগত পছন্দের ওপর নির্ভরশীল।

প্লেটোর সিম্পোজিয়ামে ইরোস সম্পর্কে এই ধরনের বোঝাপড়াকে উৎসাহিত করে আলোচনা করা হয়েছে। প্লেটোর মতে, সক্রেটিস যৌন আকাঙ্ক্ষাকে শারীরিক সৌন্দর্যের ঘাটতিপূর্ণ-অযথার্থ-প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখেন। ভালোবাসা আসলে এমন একটি প্রতিক্রিয়া যা একজন ব্যক্তির আত্মার সৌন্দর্যের কারণে সৃষ্টি হয়ে, শেষ পর্যন্ত দৈহিক গঠন বা সৌন্দর্যে এসে থামে।

প্লেটোনিক-সক্রেটিক অবস্থান দৃঢ়ভাবে বজায় রাখে যে, মানুষ এই পৃথিবীতে সৌন্দর্যের জন্য যে ভালোবাসা অনুভব বা উৎপন্ন করে তা মানুষের মৃত্যুর আগপর্যন্ত প্রকৃতঅর্থে সন্তুষ্ট হয় না। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালে মানুষের সামনে লক্ষ্যবস্তু হয়ে থাকা বিশেষ উদ্দীপক প্রতিমূর্তি বা উপমা ছাড়িয়ে লক্ষ্যবস্তুটির অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যের চিন্তাভাবনা করা উচিত।

ইরোসের প্লেটোনিক তত্ত্বের অন্তর্নিহিত অর্থ হলো, সেই আদর্শ সৌন্দর্য যা মানুষ দেখতে পায় সৌন্দর্যের বিশেষ চিত্রগুলিতে প্রতিফলিত হতে। মানুষ ও বস্তু, ধারণা এবং শিল্পের মধ্যে বিনিময়যোগ্য হয়ে ওঠে বা মিলেমিশে যায়। প্রেম করা হলো সৌন্দর্যের প্লেটোনিক রূপকে ভালোবাসা— একটি বিশেষ কোনো ব্যক্তি নয়, বরং সেই ব্যক্তি যেসব প্রকৃত বা আদর্শ সৌন্দর্য-উপাদানগুলোর অধিকারী, সেগুলোকে ভালোবাসা। প্রেম সম্পর্কে প্লেটোর দৃষ্টিভঙ্গির জন্য পারস্পরিকতা বা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া প্রয়োজনীয় নয়, যদি আকাঙ্ক্ষাটা হয় শুধুমাত্র বস্তুর সৌন্দর্যের প্রতি, লক্ষ্যবস্তু বা অন্যের সঙ্গ-সম্পর্ক এবং মূল্যবোধ ও কার্য-সাধনায় অংশগ্রহণ না করেই।

দর্শনের প্লেটোনিক শাখার অনেকেই মনে করেন যে, ক্ষুধা বা শারীরিক আকাঙ্ক্ষার চেয়ে প্রেম অন্তর্নিহিতভাবে উচ্চ মূল্য। তাদের মতে, শারীরিক আকাঙ্ক্ষার সাথে প্রাণিজগতের মিল রয়েছে। অতএব, তা প্রতিক্রিয়া ও উদ্দীপনার ক্রমতালিকায় একটি যুক্তিযুক্তভাবে প্ররোচিত প্রেমের তুলনায় নিম্নস্তরের। অর্থাৎ, প্রেম হলো যুক্তিবাদী প্রকরণ বা আলোচনা এবং ধারণাগুলির অন্বেষণ থেকে উৎপন্ন হওয়া ভাবাবেগ, যা আদর্শ সৌন্দর্যের অন্বেষণকে সংজ্ঞায়িত বা অর্থনিরুপণ করে। তদনুসারে, একটি বস্তু, একটি ধারণা, বা একজন ব্যক্তির নিজের জন্য শারীরিক প্রেম ভালবাসার সঠিক রূপ নয়। ভালবাসা হলো বস্তু, ধারণা বা ব্যক্তির সেই অংশের প্রতিফলন যা আদর্শ সৌন্দর্যে অংশ নেয়।

লেখক: ড. এস. তানভীর রাতুল; এফআরএসএ, এফআরএসএল
অধ্যাপক, স্কুল অব হিস্টোরি, ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যান্ড কালচার (ইতিহাস, ভাষা ও সংস্কৃতি)
পরিচালক, সেন্টার ফর নিউ অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল রাইটিং
লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়