ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জীবনের শেষ মামলা
তুহিন খানপ্রকাশিত : এপ্রিল ১২, ২০২৩
কয়েক বছরে এই সরকার ও তার পোষ্যরা অনেকগুলা মামলা দিছে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বিরুদ্ধে। সেসব মামলা যে নিছকই রাজনৈতিক বিদ্বেষপ্রসূত ছিল, বলাই বাহুল্য। এমনকি পরের জলের মাছ চুরি, গাছের ফল চুরির মামলাও খাইছেন উনি। এসব মামলার ভিড়ে ওনার সর্বশেষ খাওয়া মামলাটা নিয়া কোনো আলাপ দেখলাম না। ইতিহাসের পরিহাসগুলা মার্ক কইরা রাখতে আগ্রহী আমি; তাই `ইতিহাস বিকৃতি`র দায়ে ২০২২ সালে খাওয়া ওনার লাস্ট মামলা নিয়া আলাপ করি আসেন।
ষাটের দশকে ঢাকা মেডিকেলের ছাত্র থাকাকালীন জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। এইটা নিয়া ছাত্র ইউনিয়নের অনেকরে প্রাইডও নিতে দেখি। দুঃখজনক ব্যাপার এই যে, `ইতিহাস বিকৃতি`র দায়ে ওনার নামে লাস্ট মামলাটা দিছিল এই ছাত্র ইউনিয়নেরই এক নেতা।
`১৯৭১ সালে কাদের মোল্লা ছাত্র ইউনিয়ন করতেন`— ২০২২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি এমন একটা বক্তব্য দ্যান জাফরুল্লাহ চৌধুরী (সেখানে তিনি কাদের মোল্লা ও সাইদীর বিচারপ্রক্রিয়া নিয়াও প্রশ্ন তোলেন এবং বলেন যে, তারা সঠিক বিচার পায় নাই)। এই বক্তব্যের পর ছাত্র ইউনিয়নের লিডারশিপ যে ভাষায় ওনার বক্তব্যের প্রতিবাদ করে, তা `ফল চুরি মাছ চুরি`র চাইতে কম অপমানজনক না। সাধারণ সম্পাদক দীপক শীল স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, `জাফরুল্লাহর মানসিক চিকিৎসা দরকার।`
এতেই থামে নাই উনারা। ছাত্র ইউনিয়নের শরিয়তপুর জেলা সংসদের তৎকালীন সভাপতি সাইফ রুদাদ জাফরুল্লাহ সাহেবের নামে মামলা করেন, এবং আদালত তার বিরুদ্ধে সমন জারি করে। রুদাদের বক্তব্য হইল, উনার এই কথা ছাত্র ইউনিয়নের `ইতিহাস, ঐতিহ্যের প্রতি আঘাত ও মানহানিকর`।
সে মামলার পরে কী হইছে, জানি না। কিন্তু কাদের মোল্লা ছাত্র ইউনিয়ন করত, এই মর্মে নিউজ প্রকাশ করছে বাংলানিউজ২৪.কমও। ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ওই পোর্টালে `ছাত্র ইউনিয়ন ছেড়ে আলবদর কমান্ডার!` শীর্ষক এক প্রতিবেদনে লেখা হয়: `কাদের মোল্লা ১৯৬১ সালে সদরপুর উপজেলার আমিরাবাদ ফজলুল হক ইনিস্টিটিউশনে ৮ম শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালে ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেন। ১৯৬৬ সালে ফরিদপুরের সরকারি রাজেন্দ্র কলেজে বিএসসি প্রথম বর্ষে পড়ার সময় ছাত্র ইউনিয়ন ছেড়ে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘে যোগদান করেন।`
যদিও জাফরুল্লাহর বলা সাল আর পত্রিকার দেওয়া সাল এক না। কিন্তু ছাত্র ইউনিয়নের ওইসময়ের বক্তব্য শুনলে মনে হবে যে, কাদের মোল্লা কখনোই, কস্মিনকালেও, ছাত্র ইউনিয়ন করতেই পারেন না। করলে সেটা ছাত্র ইউনিয়নের ইতিহাস, ঐতিহ্যের প্রতি বিরাট অপমান। তাইলে বাংলানিউজের এই প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে মামলা করে নাই কেন তারা? এই প্রতিবেদন ছাপা হয় ২০১৩ সালে। নিশ্চয়ই আদালতে এ সংক্রান্ত আলাপ হইছে। জাফরুল্লাহ নিজে যেহেতু ছাত্র ইউনিয়ন করতেন, আবার মুক্তিযোদ্ধাও, ফলে এ ব্যাপারে আলাপে উনি একজন অথরিটিও বটে।
উনি ভুল ইতিহাস কইলে, বিস্তারিত দলিলাদিসহ ইউনিয়ন তারে ভুল প্রমাণ কইরা লেখালেখি করতে পারত। ভুল ইতিহাসরে চ্যালেঞ্জ করতে পারত। কিন্তু ওনার নামে `ইতিহাস বিকৃতি`র মামলা দিল ইউনিয়ন, কেন? কারণ কাদের মোল্লা আ. লীগের জন্য সেন্সিটিভ ইস্যু; ফলে সে ইউনিয়ন করত কিনা তা আলাপ না কইরা, বল আওয়ামী কোর্টেই ঠেইলা দেওয়া ভাল মনে করছেন উনারা।
জাফরুল্লাহ মারা গেলেন। এ ব্যাপারে উনার পরবর্তী বা বিস্তারিত বক্তব্য কী ছিল, আমি জানি না। মামলাটার নিষ্পত্তি হইছিল কিনা, বা আদৌ এই মামলাটা লড়ার জন্যই দিছিল কিনা ইউনিয়ন, তাও জানি না। শুধু বুড়া বয়সে, মৃত্যুর মাত্র এক বছর আগে, নিজের যৌবনের সংগঠনের নেতাদের তরফে `ইতিহাস বিকৃতি`র মামলা খাইতে হইছিল জাফরুল্লাহর, তাও এমন বক্তব্যের জন্য, যার পক্ষে পত্রিকার প্রতিবেদনও আছে— এইটুকুই কেবল আফসোস।