ডা. অপূর্ব চৌধুরীর কলাম ‘সেলেব্রিটি সাইকোলজি’
প্রকাশিত : এপ্রিল ১৮, ২০২১
সেলেব্রিটি কাদের বলে? যারা পাবলিকের বড় একটি অংশের কাছে কোনোভাবে পরিচিত, পাবলিকের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। কী কাজে পরিচিত, সেটির চেয়ে সাধারণ জনগণের কতটা দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছেন, তার ওপরই নির্ভর করে সেলেব্রিটি তকমা পাওয়া।
অন্যরকম করে বললে, আগের রাজ পরিবারের সদস্য, যুদ্ধজয়ী সেনাপতি বা সৈনিক অথবা সামাজিক সাধু সন্ন্যাসীরা যে ধরনের সামাজিক মনোযোগ পেত, তারই আধুনিক সংস্করণ হলো সেলেব্রিটি কালচার। তবে দেশকালপাত্র ভেদে কিছু পার্থক্য আছে। পশ্চিমা সভ্যতায় মুভি স্টার, মিডিয়া স্টার, স্পোর্টস প্লেয়ার কিংবা মিউজিক স্টার, এদেরকে সেলেব্রিটি ধরা হয়। আবার পূর্বের সভ্যতা সংস্কৃতিতে দেখা যায়, রাজনৈতিক নেতা, ধর্মীয় গুরু, সরকারি ক্ষমতার উচ্চ আসনের লোকেরাও মিডিয়ার পারসোনালিটিদের মতো সেলেব্রিটি তকমা পায়।
মানুষের স্বভাব হলো, যেখানে যত সহজে মনোযোগ দেয়, পছন্দ করে, সেখানে ততটাই বিপরীত অপছন্দ কিংবা মুখ ফিরিয়ে নেয়া কাজ করে। লাইকের আড়ালে ডিজলাইকের একটি বৃত্তও তৈরি হতে থাকে। এক্ষেত্রে সাধারণ জনগণের একটি বড় অংশের মজার অনুভূতি কাজ করে। সেটি হলো, সেলেব্রিটিদের একদিকে গসিপের জন্যে বিনোদনমূলক এবং মুখরোচক যেমনভাবে, তেমনি নৈতিকভাবে তাদের নৈতিকতার মানদণ্ডকে বেশ নিচু ভাবে।
সমাজে সফল বিফলের মাপকাঠি মাপতে লোকে মোরাল স্ট্যান্ডার্ডটিকে মনে মনে উঁচু আসনে বসায়। একসাথে সেলেব্রিটিদের ভালো কাজগুলো প্রশংসা এবং মনোযোগ যেমন পায়, তেমনি তাদের মন্দ কাজের প্রচারটাও সহজে প্রচার পায়। সেলেব্রিটি একটি আইডেন্টিটি। একটু বললে ফলস আইডেন্টিটি। পরিচয়ের খোলস মাত্র, কখনোই আসল ব্যক্তিত্ব নয়। সেলেব্রিটি একটি পণ্য। মিডিয়া তার মাধ্যম, পাবলিক হলো ভোক্তা, আকর্ষণ তার ফুয়েল।
মিডিয়া সেলেব্রিটি তৈরি করে, মানুষ সেই তৈরি খোলসের পিছনে ছুটে অথবা ছুটতে প্ররোচিত হয়। ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউবের মতো সোশ্যাল মিডিয়া এখন সেলেব্রিটিদের স্বর্গ, ভোক্তা ধরার বাজার। খেলোয়াড়, মিডিয়া তারকা, রাজনৈতিক কিংবা অর্থবানরা সেলেব্রিটির আড়ালে নিজেদের ব্র্যান্ড প্রচার এবং বিপণনে এখন সোশ্যাল মিডিয়া টুলস সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে। কিন্তু মানুষ কেন সেলেব্রিটিদের পেছনে ঘোরে, সেলেব্রিটিদের খবরগুলোকে কতটুকু বিশ্বাস করে, সেলেব্রিটিদের কি চোখে দেখে, সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের সত্যিকার প্রভাব কতটুকু, কিংবা কেন তাদের খবরগুলো ভাইরাল হয়, এ নিয়ে YouGov নামের ব্রিটিশ একটি পাবলিক ওপিনিয়ন ডাটা কোম্পানি সম্প্রতি একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে পার্লামেন্টের সোশ্যাল মিডিয়া রিলেটেড এক সেমিনারে।
YouGov ২০০০ সাল থেকে অনলাইন জরিপের মাধ্যমে পাবলিক ইস্যুগুলো নিয়ে কাজ করে। পাবলিক ওপিনিয়ন পোল এবং সার্ভে নিয়ে কাজ করা বিশ্বের সেরা Ipsos, ICM, Morris, Gallup এর পাশে YouGov অন্যতম। পশ্চিমে তাদের সার্ভেগুলো নির্বাচন, জনমত এবং পলিসি মেকিং এ যথেষ্ট প্রভাব ফেলে। জরিপে তারা দেখেছে, ব্যবহারকারী সাধারণ মানুষরা সোশ্যাল মিডিয়ায় সবচেয়ে বেশি Dishonest ভাবে সেলেব্রিটিদের। প্রায় ৩৩% লোক ভাবে সেলেব্রিটিরা তাদের নিউজ-ফিডে যা কিছু লেখে, নিজেদের প্রচার করতে যা ছবি দেখায়, তার বেশিভাগই তাদের রিয়েলিটি না।
সেলেব্রিটিরা নিজেদের প্রোপাগান্ডা বাড়াতেই মিথ্যা বলে সবচেয়ে বেশি। মাত্র ১২% ভাবে সেলেব্রিটিরা যা বলে, দাবি করে, কিংবা দেখায়, তা সত্যিকার বিশ্বাসযোগ্য। মজার হলো, সেলেব্রিটিদের চেয়ে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাসযোগ্য ভাবে নিজেদের পরিবারের লোকদের, এটি প্রায় ৬৬%। তিনভাগের একভাগ লোক সেলেব্রিটিদের তুলে ধরা গ্লামারাইজড জীবনকে তাদের আসল জীবন ভাবে না। তাদের লেখা, কথা, আচরণ, খবরকে মিথ্যার রঙ ঢঙ ভাবলেও কেন তারা তাদের ফলোয়ার হয়, খবরগুলো উৎসুক হয়ে পড়ে, এক কলসি থেকে আরেক কলসিতে একই নর্দমার জল ঢালার মতো শেয়ার করে, ভাইরাল করে, তার উত্তর জানতে গিয়ে দেখল যে, প্রায় ১০% লোক তাদের ফলো করে একটি প্রধান কারণে escapism।
মানুষগুলো নিজের কাছ থেকে নিজেই পালতে আশ্রয় নেয় আরেকটি মিথ্যার খোলসে। মিথ্যাকে মিথ্যা জেনেও তারা বাস্তবের কষাঘাত থেকে পালাতে তথাকথিত পপুলার মানুষগুলোর পিছে ছুটে। অন্য জরিপে দেখা গেছে, অনলাইনে সবচেয়ে বেশি মিথ্যা বলে ধনী এবং জনপ্রিয় সেলেব্রিটিরা। কারণ তারা নিজেদের যে ব্র্যান্ড তৈরি করে, তা অফলাইনের মতো নয় বলে তাকে প্রতিনিয়ত এডিট করে প্রচার করতে হয় ব্র্যান্ড ধরে রাখতে। মধ্যম সারির সেলেব্রিটিরা প্রথম সারির সেলেব্রিটি হতে পয়সা খরচ করে ফেইক ফলোয়ার কিনে।
মজার কিছু পর্যবেক্ষণ এবং টুইস্ট আছে জরিপে। যেমন: পাবলিক ভাবে যে অনলাইনে সেলেব্রিটিরা সবচেয়ে বেশি মিথ্যা বলে, আর ভাবে যে অনলাইনে সবচেয়ে কম মিথ্যা বলে পরিবারের লোকেরা। কিন্তু কম সত্য আশা করে সবচেয়ে বেশি পরিবারের লোকদের কাছে, যা ৩৪%। ২৮% লোক চেনা বন্ধুদের কাছ থেকে আশা করে সত্য। মাত্র ২২% কম সত্য আশা করে সেলেব্রিটিদের কাছে।
মজার টুইস্টটির কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখল, পরিবারের লোকেরা যেহেতু সবচেয়ে কাছের, সবসময় দেখছে, বাস্তবে তাদের সবচেয়ে বেশি সত্য বলতে হয় পরস্পরকে বা বলে, তখন পরিবার বা বন্ধুদের কাছে কম স্বচ্ছতার আশা করে কিংবা তারা সত্য-মিথ্যা মিশিয়ে কিছু একটা বললেও সেটা ক্ষমার চোখে দেখে। কিন্তু সেলেব্রিটিদের কাছে একদিকে স্বচ্ছতা আশা করে বেশি, আবার বুঝে যে তারা মোটা দাগে অস্বচ্ছ, তাই ভাবে যে সেলেব্রিটিরা অস্বচ্ছ হলেও তেমন কোন আপত্তি নেই তাদের, ক্ষমাও করে না, আবার অসত্য আপত্তিও করে না। গা ছেড়ে গা বাঁচিয়ে চলা। তখন গল্পকে গল্প ভেবেই আরও গল্পের মোহে ফলোয়ার হয়, কিছু বিনোদন কুড়ায়, খবরগুলোতে মাথা খুঁড়ে।
মূল কথা হলো, প্রতিনিয়ত নিজেরা বাস্তবের সাক্ষী হয়ে মিডিয়ার পপুলার সেলেব্রিটিগুলোর অবাস্তব অতিরঞ্জনকে অনুসরণ করলেও মনে মনে ঠিকই তাদের অসত্য ভাবে।