
ডায়রি লেখার কারণে উত্তম পুরুষে লিখতে স্বাচ্ছন্দ্য
পর্ব ৩
প্রকাশিত : মার্চ ২৪, ২০১৮
মেহেদী উল্লাহ বর্তমান প্রজন্মের একজন মেধাবী গল্পকার। তার ভাষা যেমন কারুকাজময়, তেমনই চিন্তায় রয়েছে প্রথা ভেঙে নতুন কিছু তৈরির আয়োজন। গেল মেলায় প্রকাশিত হয়েছে প্রথম উপন্যাস গোসলের পুকুরসমূহ। প্রকাশিত গল্পের বই চারটি। স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন জেমকন তরুণ কথাসাহিত্য পুরস্কার ২০১৩। কবি ও কথাসাহিত্যিক আবু তাহের সরফরাজ তার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গপসপ করেছেন। প্রতি শনিবার ধারাবাহিকভাবে সেসব কথামালা প্রকাশ করা হবে:
সরফরাজ: লেখালেখি শুরুর দিককার সময়গুলোর কথা বলুন। প্রস্তুতিটা কীরকম ছিল। সেই সময়ের উত্তেজনা... পড়াশোনা...
মেহেদী: আব্বা চাইতেন, আমি যেন ডায়রি মেনটেন করি। খুব ছোট থাকতে একবার ডায়রি ধরায়ে দিছিলেন, কিন্তু লিখতাম না। পরে ক্লাস সিক্সে থাকতে তিনি আবার এটেম্প নিলেন। এবার লিখতে শুরু করলাম। প্রতিদিন কী করি, না-করি, তার বিস্তারিত বিবরণী। লিখতে লিখতে একসময় ব্যাপারটারে হুদাই মনে ঠেকল। নতুন কিছু তো করি না। ঘুম থেকে উঠি। স্কুলে যাই-আসি। বিকালে খেলতে যাই। রাতে পড়তে বসি। আবার ঘুমাতে যাই। আব্বাকে জানালাম, লিখতে ইচ্ছা করছে না। ঘুরেফিরে একই ব্যাপার ঘটে চলেছে প্রতিদিন। আব্বা কোনো সিদ্ধান্ত দিলেন না। এরপর চেষ্টা করতাম, একই ঘটনা হলেও সেগুলোকে ভিন্নভাবে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে লেখার। যেমন, কোনো স্যারের হাতে মাইর খাইলে, মাইর তো একই ব্যাপার, কিন্তু আগের দিন কয় বাড়ি, পরের দিন কয় বাড়ি, কী বলতে বলতে স্যার মারতেছিলেন, তার হবহু উদ্ধৃতি। স্কুলে যাওয়ার পথে কার সাথে দেখা, ঘুরেফিরে নির্দিষ্ট কয়েকজনের সাথেই। কিন্তু ভিন্নতা আনার জন্য লিখতে শুরু করলাম কয়টা পাখি, কয়টা পশুর সাথে দেখা, সেসবও।
সরফরাজ: ডায়রি লেখার অভ্যেসটাই আপনাকে লেখালেখিতে প্রলুব্ধ জুগিয়েছে, এই তো?
মেহেদী: তা বলতে পারেন। এখন মনে হয়, সেই ডায়রি লেখার কারণে উত্তম পুরুষে লিখতে এত স্বাচ্ছন্দ্য! বেশিরভাগ লেখাই উত্তমপুরুষে বর্ণিত। একসময় ডায়রি লেখা থামিয়ে দিয়ে ডায়রির পাতায় কবিতা লিখতে শুরু করলাম। আলাদা আলাদা অন্ত-অনুপ্রাস থাকবে প্রতি দুই লাইনে, বা চার লাইন হলে দ্বিতীয় লাইনের সাথে চতুর্থ লাইনের। স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় আবৃত্তি বিভাগে নিজের কবিতা নিজে আবৃত্তি করতাম। তখন পড়তাম চাঁদপুরের কচুয়ার পালাখাল উচ্চ বিদ্যালয়ে। হেড স্যারসহ কয়েকজন শিক্ষক খুব বিরক্ত হতেন। এবং বলেও বেড়াতেন, তুই ভালো ছাত্র, তুই পড়বি কবি নজরুল, রবীন্দ্রনাথের কবিতা। তুই ক্যান নিজের খারাপ খারাপ কবিতাগুলো পড়ে আমাদের সময় নষ্ট করিস। আর কেউ তো সাহস পায় না। তবে বুলবুলি ম্যাডাম সাপোর্ট দিতেন। তার বাবা স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা। তাই ম্যাডামের সাপোর্ট মানে বিশাল কিছু ভাবতাম। ম্যাডাম হেড স্যারকে বুঝাতেন, এভাবেই তো মানুষ কবি হয় বড় হয়ে। নিজে লিখতে লিখতে। আর ছোটকাল থেকে না লিখলে বড় হয়ে হুট করে লিখবে কেমন করে! ম্যাডামের আস্কারায় আরো অনেকেই লিখতে শুরু করেছিল কবিতা। দেখা যেত, প্রতিযোগিতায় তিনটি পুরস্কারের মধ্যে দুটিই পেত স্বরচিতঅলারা। এভাবেই আমরা আমাদের প্রতিভার সর্বোচ্চটা প্রয়োগ করতাম।
সরফরাজ: এরমানে, আপনার লেখালেখির শুরুটা ছিল কবিতা দিয়ে, এই তো? অবশ্যি সব কথাসাহিত্যিকের শুরুই কবিতা দিয়ে।
মেহেদী: তা-যা বলেছেন ভাইজান। তবে এর পরপরই গল্প লিখতে শুরু করি। এদিকে আরো ভালো পড়াশোনার জন্য আব্বা কচুয়া উপজেলার কচুয়া সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে ক্লাস নাইনে ভর্তি করিয়ে দিলেন। অবশ্য ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হইছিলাম। নতুন স্কুলে অনেক কিছু পেলেও বুলবুলি ম্যাডামের মতো কাউকে পেলাম না। তবে স্কুলের পাশেই একটা পত্রিকার দোকান পেলাম। সেখানে জাতীয় দৈনিকসহ লোকাল সব পত্রিকা পাওয়া যেত। ঠিকানা সংগ্রহ করে পত্রিকায় গল্প-কবিতা পাঠাতে শুরু করলাম। দুই একটি জাতীয় দৈনিকে ছাপাও হয়েছিল লেখা, শিশুদের পাতায়। চাঁদপুর কণ্ঠ নামের একটা পত্রিকা আছে, শিশুকণ্ঠ পাতায় ছোট ছোট লেখা পাঠাতাম। ওখানে বিষয় বলা থাকত। প্রতি সপ্তাহেই আমার লেখা ছাপা হতো। কিন্তু বিপত্তি বাঁধালেন কবির স্যার। এসএসসি পরীক্ষার তিন মাস আগে একদিন কোচিং ক্লাসে তিনি বললেন, `সাহিত্য বন্ধ। এসএসসি পরীক্ষার আগে আর যেন এসব না দেখি। জীবনে বহুত লিখতে পারবা। একমাস বইয়ের পড়া পড়।` আমার ধারণা ছিল, কেউ পড়ে না। কিন্তু ধারণা ভুল। স্যাররা ঠিকই ছাপা হওয়া লেখা পড়তেন। খোঁজ রাখতেন।
স্যারের তীব্র আপত্তির মুখে লেখা বন্ধ রাখলাম। সায়েন্সে পড়ি। অনেক পড়া। কলেজের দুই বছরেও আর লিখলাম না। না গদ্য, না পদ্য। পড়ার চাপে ভুলেই গেলাম। কচুয়া বঙ্গবন্ধু ডিগ্রি কলেজের শিক্ষকরা আমাদের নিয়ে প্রভূত আশা করেছিলেন। এইচএসসিতে আমরা বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ভালো ফল করব। তাই প্রচুর পড়তে হয়েছিল। লেখালেখি টোটালি বন্ধ। সেই বন্ধ খুলল বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে লেখা নয়, লেখার প্রস্তুতির জন্য পড়া। যা সামনে পেলাম, পড়তে থাকলাম। সাহিত্য, রাজনীতি, দর্শন, ইতিহাস, নৃবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ক বই।
সরফরাজ: বলা চলে, এ সময়টা আপনার মনের জানালা-দরজা খুলে দিয়েছিলেন। যাতে বাইরের সবকিছু মনের অন্দরমহলে হু হু করে ঢুকে পড়তে পারে।
মেহেদী: হ্যাঁ। এসময়েই হঠাৎ ঠিক করলাম, গল্প লিখব। ততদিনে রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে শহীদুল জহির পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য গল্পকারের গল্প পড়া শেষ। ভিনদেশি গল্পও পড়েছি বিস্তর।
চলবে...