জাহীদ ইকবাল
ডালিম ফলের ঘ্রাণ ও তেজপাতার বিছানা
জাহীদ ইকবালপ্রকাশিত : মার্চ ২৯, ২০২২
শরীফার নদীর মতন ঢেউখেলানো সরু কোমরটা বড়শির মতো গেঁথে আছে আমার মুঠোর ভেতরে। খোঁপার মতো মুঠো আলগা করে দিলেও পালাবে না। কেননা সে আমার স্পর্শে মুগ্ধ, বিবশও। মুখ থেকে তার একটা কথাও সরে না। যেন কিছুকালের জন্য চুপকথার মতো আমাদের বেবাক কথা বুনো উষ্ণতায় চুপ হয়ে গেছে। সন্তর্পণে গুঁটি গুঁটি পা ফেলে আমরা হাঁটছি। সন্ধ্যার প্যাচপ্যাচে ভেঁজা অন্ধকার অনেকটা আমাদের গিলে ফেলেছে। তবুও যেন আমার মগজে শরীফার পার্বত্য নিতম্ব এক অদ্ভুত ছন্দের দ্যোতনায় আন্দোলিত হচ্ছে। শরীফার কাজলচোখে প্রাচীন বেদনার জল গড়াচ্ছে। আমি তার এই কাজলধোয়া কাজল চোখের আখ্যান ওয়াকিবহাল; পড়তে পড়তে অভ্যস্ত, মুখস্তও। আমরা আপাতত সেই বেদনাহত গল্পের ডিটেলসে যাব না। আমরা যাব দক্ষিণে।
আকাশে বেহিসাবি বেতাল মেঘ করেছে। এখনি বর্ষণ আরম্ভ হতে পারে। আমাদের চারপাশ জুড়ে দূর্বোধ্য অন্ধকারের কঙ্কাল খোলস। শরীফা এবং তার শরীরের ঘ্রাণ ক্রমশ আমার ভেতরে রক্তের মতো মিশে যেতে চাইছে; আমিও। এই মুহূর্তে পার্থিব কোনো অপশক্তিই আমাদেরকে পৃথক করার সক্ষমতা রাখে না। আমাদের পা চলতে চাইছে না। মটরশুটির লতার মতো জড়িয়ে যাচ্ছে। আমরা হাঁটছি ঘোর অন্ধকারের পেটের ভেতর দিয়ে। কিছু মুহূর্ত আগে শিশিরের মতো এক পশলা বর্ষণ হয়ে গেছে। সেই বর্ষণের অবগুণ্ঠনে কুয়াশা মুখ ঢেকে রেখেছে পথঘাট। আমরা আমাদের নিশানা খুঁজে পাচ্ছি না। আমরা আমাদের থেকে উষ্ণতা নিচ্ছি। আমাদের চারখানা পা কাদায় মাখামাখি। আমরাও। আমরা একটি রুগ্ন আর খর্বাকৃতি বন্ধ্যা নদীর ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি।
নদীটায় বর্ষামৌসুম ছাড়া কখনো পানি দাঁড়ায় না। এখন ভরা ফসলের মাঠ। মধ্যখানে সরীসৃপের মতন সরুগাঙ। কোথাও কোথাও কয়েক ফোঁটা জল ডাবের সরের মতন থির দাঁড়িয়ে আছে। মৃদু জ্যোৎস্নার আলোয় তার গতর চিকচিক করছে। আবার কোথাও কোথাও একচিলতে আলোর নিশানাও নাই। শুধুই থোক থোক ঘনঘোট জমাটবাঁধা অন্ধকার। এইমুহূর্তে আলোর চেয়ে অন্ধারই বেশি আরামদায়ক ঠেকছে। এইটুকু আড়াল আর অন্ধারের জন্য কত যে হাপিত্যেশ করেছি! অথচ এখন আমরা ভরা অন্ধকারে ডুবসাঁতারে গড়াগড়ি খাচ্ছি। শুধু যুতমতোন বিশ্রামের জায়গা মিলছে না।
শাপলা ডাঙ্গা গ্রামের পাশ ঘেঁষে নদীটা হাঁটতে হাঁটতে দুলতে দুলতে নাক বরাবর চলে গেছে দক্ষিণে। আমরা ওই দক্ষিণেই যাব। দক্ষিণের করমজল আমাদের স্বজনবাড়ি। ওখানে আমাদের বড় আদরের দুধবোন সফুরার বসতভিটা। সফুরার গতরের রঙ হলুদফর্সা। আমাদের কুসুমের মতো হলুদপরীটা আর সেই আগের মতো নাই। সে আমূল বদলে গেছে। সফুরা মক্তবের বেণিদোলানো সেই বালিকা, যে জীবনে কোনোদিন একটা মিথ্যা কথা বলে নাই। যদিও সফুরার প্রেমে নাকানিচুবানি খেয়েছিল মক্তবের পুঁচকে কাঠমোল্লা ক্ব্বারী মোহাম্মাদ হাফিজউল্যা। সফুরার জন্য সে তার মান-ইজ্জত এমন কি চাকরিটা পর্যন্ত খুইয়েছিল। তবুও সফুরা তার দিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ করে নাই। শেষে সফুরা ঠিকই হোঁচট খেয়েছিল, তবে সেটা অন্যখানে। অন্যকারো জন্য; সেখান থেকে সে আর মেরুদণ্ড সোজা করে উঠে আসতে পারে নাই।
সফুরার গর্ভধারিণী তহমিনা আমাদের গ্রাম্যখালা। সে সফুরাকে প্রসব করে এগারো দিনের মাথায় পৃথিবী খালি করেছে। সফুরার বাবা দিলু মাঝি সফুরাকে আমার মায়ের কোলে রেখে সেই যে কবে নিরুদ্দেশ হয়েছে আর কোনোদিন গাঁয়ে ফেরে নাই। আমার ছোটোবোন মুঞ্জিলার বয়স তখন তেরো মাস। সে-ও সফুরার মায়ের মতো জণ্ডিসে আক্রান্ত হয়ে মায়ের কোল খালি করে ওপারে তারাদের মিছিলে শামিল হয়েছে। মুঞ্জিলার শূন্যস্থান পূরণ করে সফুরা। সেই থেকে সফুরা আমাদের দুধবোন। আমরা ছ-ভাই, একবোন। সবাই দেড়দুই বছরের পিঠাপিঠি। কত সুন্দর ছিল আমাদের মিল আর বোঝাপড়া। কিন্তু সফুরা মায়ের কোলে আসার পরপর পর্যায়ক্রমে ঘটতে থাকে যতসব অলোক্ষুণে ঘটনা। যা অবিশ্বাস্য ঠাহর হবে আপনাদের কাছে। আমার পাঁচ ভাই একই রোগে আক্রান্ত হয়ে আমাদের ভাই সংখ্যা প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। আমাদের বাড়িটা রূপ নেয় ভুতুড়ে কবর স্থানে। সারিসারি কবর আর বাবা-মায়ের মাতম দেখতে দেখতে হাঁফিয়ে উঠি। ভাইদের মধ্যে আমি সর্বকনিষ্ঠ। আমাকে জড়িয়ে ধরে বাবা-মা শুধু কান্না করে। শোক সহ্য করতে না পেরে আমিও একদিন নির্বোধের মতো গ্রাম ছেড়ে শহরে গিয়ে গা-ঢাকা দিই। শোকে বাবা-মা আরও বেশি ভেঙে পড়ে। কিছুটা আমিও।
নাড়ির টানে নিরুপায় হয়ে পুনরায় গাঁয়ে পা রাখি। কিছুদিন যেতে না যেতে শরীফায় মজি। সুযোগ পেলে আমরা দুজন শুধুই গতরের তালাশে নামি। শরীরের গন্দ মাখামাখি ভাগাভাগি করে নিই, খুঁজিও। এই খোঁজাখুঁজির প্রাপ্তি আর অনিশ্চিত যোগফল নিয়ে আমাদের বাড়তি কোনো মাথাব্যথা নাই। আমাদের ভবিষ্যৎগন্তব্য অনিশ্চিত।
দুই.
সফুরা প্রাইমারির পাঠ চুকানোর আগেই উড়ে এসে জুড়ে বসা সুন্দরবনের অতিথিপাখি নুরুন্নবী তাকে থামিয়ে দেয়। কায়দামতো সে তাকে প্রণয় জালে কব্জা করে। সফুরাও মাখনের মতো গলে যায়। সিন্দুকের গহনার মতো ঢুকে পড়ে পর্দার আড়ালে।
তারপরের ঘটনাগুলো বেদনাদায়ক আর প্রলম্বিত। আমরা সেই ইতিহাস কপচাবো না। আমরা জানব একজন নুরুন্নবীর বখে যাওয়া আর নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার আখ্যান। যে গোপনে ডাকাত দলে নাম লিখিয়েছিল। মাঝেমধ্যে হুটহাট করে লাপাত্তা হয়ে যেত। কোথাও তার হদিস মিলতো না। লোকমুখে শোনা যেত____সে রাত্রিভর গলা ডুবিয়ে তাড়ি খায়; বাজারী মেয়েমানুষ নিয়ে আমোদফুর্তিতে ম`জে থাকে। এতকিছু জানার পরেও আমাদের বাবা-মা কোনো সুরাহায় যায় নাই। আর যাবেই বা কী করে! সফুরা সব নিপীড়ন সহ্য করেও নুরুন্নবীতে আকণ্ঠ ডুবে ছিল।
নুরুন্নবী গুম হয়েছে বা তাকে বাঘে ভক্ষণ করেছে, এই জাতীয় ম্যালা কথা গাঁওগেরামের মানুষের মুখে মুখে ভেসে বেড়ায়। সত্যমিথ্যার তালাশে কেউ নামে নাই। সে গত হয়েছে তা-ও বছর দেড়েক আগে। সফুরাও বাঘের জঠরে যেতে চায়। সে প্রহর গুনছে। বাঘ নুরুন্নবীকে খেয়েছে, তাকে কেন খাবে না! তাকেও তার বাধ্যতামূলক খেতে হবে। সফুরা অনেকটাই মানসিক ভার্সাম্যহীন হয়ে খানাপিনা ছেড়ে দিয়েছে। সে জিদ ধরেছে, বাঘের মাংস খাবে, তা নাহলে বাঘের জঠরে যাবে। সফুরা এখন বনেজঙ্গলে বাঘ খুঁজে বেড়ায়। গাঙের ওপারের জঙ্গলে বাঘেরা থাকে। তারা শিকারের আশায় মাঝেমধ্যে গাঁয়ে হুটহাট ঢুকে পড়ে। সফুরাও দিনরাত্রি বাঘ শিকারের জন্য কোঁচ হাতে প্রহরায় থাকে।
সফুরার শ্বশুর কাসেম শেখ একজন মৌয়াল। সে এই পেশার আড়ালে রাতবিরেত জঙ্গল চষে বেড়ায়। চুরি করে নিধন করে সুন্দরবনের বৃক্ষ। সে একটি দুর্ধর্ষ ডাকাত দলে যুক্ত। সেই দলে নুরুন্নবীও ছিল। ডাকাতির পাশাপাশি নুরুন্নবী গভীর নিশীথে প্রায়শই হরিণ শিকার করে বেড়াত। হরিণের মাংসের স্বাদ সফুরার জিহ্বায় এখনো লেগে আছে। তার এখন আর কোনোকিছুতে স্বাদ নাই। হতাশার দীর্ঘশ্বাসে দিনাতিপাত করছে। সে এখন বাঘের জঠরে গিয়ে নিজের মৃত্যু নিশ্চিত করতে চায়।
আমাদের বাবা-মা তাকে একাধিকবার বুঝিয়েসুঝিয়ে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। এবার যাচ্ছি আমি আর শরীফা। শরীফা আমার ছোট ফুপুর বড় মেয়ে। সে কাজল লতার মতো কুচকুচে কালো হলেও দেহখানা তার বেশ বাহারী লতা। কম বয়সে বছর পাঁচেক আগে তার বিয়ে হয়েছিল; তবে সংসার হয় নাই। যতটুকু জানি শরীফা নিজেই সংসার করতে অনিচ্ছুক ছিল। সফুরা তার বয়সে একটু না অনেকটাই ছোট। তার কথা সে ফেলতে পারবে না, এই বিশ্বাস পুঁজি করে আমরা যাচ্ছি সফুরাকে ফিরিয়ে আনতে।
আমাদের সঙ্গে শরীফার মায়েরও আসবার কথা ছিল। তার পায়ে ব্যথা। দূরের পথ বলে সে আসে নাই। ফুপু খুব একটা হাঁটতে পারে না। এমনিতে পৌষ মাস। এই সময়টাতে খালে তেমন একটা পানি থাকে না। কাদায় নৌকা মাটির সঙ্গে বেঁধে যায়। করমজলের যাতায়াত ব্যবস্থা চাঁদেরহাটের ভাঙাপুলের মতোই নড়বড়ে। পুলের নিচে দিয়ে যেতে হয়। হাঁটতে হয় মানুষের ফসলি জমির ভেতর দিয়ে। খালের পাশে দড়ির মতো কাঁচা রাস্তাটাও বেশি একটা সুবিধের না। দুনিয়ার খানাখন্দে ভরা। ঠিকঠাক মতো হাঁটা যায় না। একটু এদিকওদিক হলেই খালের মধ্যে পড়ে নাকানিচুবানি খেতে হয়।
আমরা হাঁটছি। হাঁটতে হাঁটতে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আমাদের পায়ের নীচে পিষে যাচ্ছে মৃত কঙ্কালসার নদী; ধান আর ঘাসের জঙ্গল...। আমাদের মাথার ওপর দিয়ে এইমাত্র ডানা ঝাপটে একটা বাঁদুড় গাঙ পার হয়ে একটা কাঠবাদাম গাছে গিয়ে বসল। আমরাও নির্জন কোথাও গিয়ে বসতে চাই। নির্জনতা এই মুহূর্তে আমাদের যারপরনাই প্রয়োজন।
আমাদের পথ যেন ফুরোচ্ছে না। আর দুটি গ্রাম বাদেই করমজল গ্রাম। আমাদের কিছুটা বিশ্রামের প্রয়োজন। আমরা পরিশ্রান্ত। ফুসরত পেলে সুবিধেমতো বসে পড়ব কোনো এক ঝরাপাতা অথবা সবুজ ঘাসের মাদুরে। শুয়েও পড়তে পারি। কেনো না আমাদের সমস্ত কথা ফুরিয়ে এসেছে। আমরা যেন আর নূতন কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছি না। আমাদের কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। আমরা জড়িয়ে যাচ্ছি। আমরা আর কতদূর যেতে পারব আমাদের জানা নাই। সামনেই পাগলা বদু শিকদারের বিশাল বিদেশি মাগুরের খামার। বদু লোকটা মোটেও সুবিধার না। তার চরিত্রে কালশিটে দাগ আছে। আর এতরাত্তিরে সে মেয়ে মানুষ দেখলে নিজে তো শেয়াল শকুনের মতো ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে, সেইসঙ্গে মাগুরমাছ দিয়েও খাওয়াবে।
তিন.
রাত্রি খুব একটা হয় নাই। তবে করমজল এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়ার কথা। সন্ধ্যার পরপরই গ্রামটি চোখ বন্ধ করে। আবার সকাল সকাল চোখ খোলে। আমরা কোথাও বিরাম নিইনি। শীতে জমে যাচ্ছি। কুমিরের ভয়ে আমরা আস্ত একটি গ্রাম চরকির মতো ঘুরে করমজল অভিমুখে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। সত্যিই কী আমরা করমজল খুঁজে পেয়েছি! না, রাত্রির অন্ধকারে চেনা গ্রামটি আমরা কোথাও হারিয়ে ফেলেছি! আমরা হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে তন্দ্রার মতো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। এখন শরীরটা বেশ ঝরঝরা আর ফুরফুরা লাগছে। কিন্তু অদৃশ্য মেরুদণ্ডহীন হাড়কাঁপানো শীত আমাদের পিছু ছাড়ছে না। আমরা দুজন দুজনকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেও আমাদের ভেতর থেকে শীত সরানো যাচ্ছে না। কালকেউটে সরীসৃপের মতো অপার্থিব শীত আমাদের কামড়ে ধরেছে।
গাছে গাছে পাখিরা যেভাবে জিকির আরম্ভ করেছে, তাতে করে একটুস ঘুমানোর কোনো জো নেই। দূরে কোথাও ক্ষুধার্ত শেয়াল আজান দিয়ে কান্না করছে। মশাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে কোনো ফায়দা হবে না। এদের মতো বেঁড়েবাঁদর দুনিয়ায় আর দ্বিতীয়টি নাই। সমস্ত শরীর কামড়ে রীতিমতো ঢোল বানিয়ে দিয়েছে। মশার কামড়ে এত যন্ত্রণা! উহ এমন কামড় আগে কখনো চেখে দেখা হয় নাই।
বেশ দূরে অকস্মাৎ আমরা জোনাকিপোকার মতো কিছু আলো ফুটতে দেখি। যতই সামনে বাড়তে থাকি ততই যেন তারার মতো আলোক রশ্মিকণা ক্রমশ দীঘল হতে থাকে। হঠাৎ ধাতস্ত হয়ে খরগোশের মতো কান খাড়া করে লক্ষ্য করি, কারা যেন মশাল জ্বালিয়ে লাঠিসোঁটা নিয়ে আমাদের দিকেই তেড়ে আসছে। ভয়ে-তৃষ্ণায় আমাদের গলাবুক শুকিয়ে আসছে...। আমারা বস্ত্রহীন। যেন আদিম কোনো মানব-মানবী। শরীরে একটি সুতাও নেই। আমাদের পোশাকাদি রয়ে গেছে তেজপাতার বিছানায়। আমরা একটি বিশাল তেজপাতাবৃক্ষের নিচে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সেখানে আমরা ভীষণ আনন্দে শরীরের সমস্ত বস্ত্রাদি অবমুক্ত করেছিলাম। ওখানেও আমাদের কতিপয় গ্রামবাসী তাড়া করেছিল। আমরা ম্যালা দেরিতে হলেও টেরপাই, কেন লোকগুলো লাঠিসোঁটা নিয়ে আমাদের তাড়া করছিল বা তাড়া করছে...।
রিপুর তাড়না আমাদের উন্মাদ করে দিয়েছে। এই মাহেন্দ্রক্ষণ আমাদের জীবনে আর কোনোদিন আসবে কিনা আমাদের জানা নাই। আমরা দিকভ্রষ্ট। একচিলতে নির্জনতা আর একটুস আড়াল খুঁজতে খুঁজতে আমরা আমাদের করমজলের মেঠোপথ হারিয়ে একটা গহীন রাক্ষুসে জঙ্গলের ভেতরে ঢুকে পড়েছি। এখানে কোথাও কোনো জনবসতির চিহ্নমাত্র নেই। শুধু স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার আর অগণন সবুজ বৃক্ষের সমাবেশ। দু-একটি চালতা গাছ আর বেশকয়েকটি কাঁঠালবৃক্ষ চোখে পড়ল; কিন্তু ঐ দেখা পর্যন্তই শেষ, একটিও ফল জুটল না। ঝিঁঝিঁপোকার বিকট চিৎকার আর নীরবতা চিরেফুঁড়ে আমরা হাঁটছি। কোথায় যাচ্ছি জানি না।
ক্ষুধায় পেটের ভেতরে চিতা জ্বলছে। আমাদের সমস্ত হাঁটার শক্তি লোপ পেয়েছে। আমরা আর কোনোক্রমে হাঁটতে পারছি না। আমাদের শরীরও চলছে না। তবু কারা যেন পেছন থেকে আমাদের তাড়া করছে। সুতার মতো সরু চাঁদ উঠেছে। চাঁদের সেই নিভু আলোয় আমরা হাঁটছি। ভোর হতে এখনও ম্যালা দেরি। ভীষণ কুয়াশা পড়েছে। আমরা আন্দাজ করে দেখি, এখনো তিন তিনটা গ্রাম ঠ্যাঙাতে হবে তারপর করমজল গ্রাম। আমরা করমজলের বিপরীতমুখী রাস্তা দিয়ে হাঁটছি। আমরা যে নদীটার ভেতর দিয়ে হাঁটছিলাম, সেই নদীটা কোথায় যেন গা-ঢাকা দিয়েছে। নদীটার হদিস পেলে সফুরার গ্রামটি খুঁজে পাব। তার আগে আমরা তেজপাতা বৃক্ষের তালাশে ঝাঁপিয়ে পড়ব। উদ্ধার করব আমাদের পরনের বস্ত্রাদি। তা নাহলে সমস্তরাত্রি মশার কামড় খেয়ে জঙ্গলের ভেতরেই আমাদের প্রাণ রেখে যেতে হবে।
এখনও আমাদের সমস্ত শরীরজুড়ে শিশির, তেজপাতা আর মাটির ঘ্রাণ লেগে আছে। আমরা ইচ্ছে করেই মোমের আলোর মতন দিনের সমস্ত আলো পথে পথে খরচ করে নিজেদের সর্বনাশ নিজেরাই ডেকে এনেছি। শরীফা বায়না ধরেছিল কাঞ্চনপুরের মেলায় যাবে। আমি তার আবদার ফেলতে পারি নাই। মূলত আমাদের সমস্ত সর্বনাশের সূত্রপাত হয়েছিল ঐ কাঞ্চনপুরের মেলা থেকে। ওখানেই আমরা জীবনের প্রথম নাগর দোলায় উঠেছিলাম; না দুজন দুজনের কোলে উঠেছিলাম, বলতে পারব না। তবে শরীফার শাড়ির আঁচলভরা ডালিমফলের ঘ্রাণ আমাকে মুগ্ধতায় ডুবিয়ে রেখেছিল।
প্রচণ্ড শীতের ভেতরে আবারও শিশিরের মতন বর্ষণ আরম্ভ হয়েছে। শরীফা শীতে কাঁপছে আর অনবরত কান্না করে চলেছে। সে একপা হাঁটবে না। তাকে কাঁধে নিয়ে হাঁটতে হবে। হেঁটেছিও ম্যালা পথ আর পারছি না। এসব আদিখ্যেতাপনা আমার ভালো লাগছে না। হাঁটতে হাঁটতে সমস্ত শরীর বিষকাঁটা হয়ে গেছে। শরীফাকে সহ্য হচ্ছে না। শরীফা কাঁদছে। আমারও ভীষণ কান্না পাচ্ছে। আমি আর পারছি না...। আমার দুচোখ জুড়ে হতাশার কুয়াশা, অনিশ্চয়তা আর অন্ধকারের কালো চশমা। চশমাটা ছুড়েও ফেলতে পারছি না। প্রকৃতির সঙ্গে জোর চলে না। সে তার অমোঘ প্রতিশোধ সময়সুযোগ মতো যেভাবেই হোক নেবে। অসহ্য রকম শীতে আমরা দুজন ভূমিকম্পের মতো কাঁপছি আর গুঁটিসুটি পা ফেলে ক্রমশ অন্ধকার ছিঁড়ে ছিঁড়ে আগাচ্ছি। খুঁজছি সেই তেজপাতা বৃক্ষটি; যেখানে আমাদের সমস্ত পাপচিহ্ন আর স্বস্তির আবরণটুকু পড়ে আছে...।