জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার আজ জন্মদিন

ছাড়পত্র ডেস্ক

প্রকাশিত : অক্টোবর ০৬, ২০২৪

জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার আজ জন্মদিন। ১৮৯৩ সালের ৬ অক্টোবর গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর উপজেলার শেওড়াতলী গ্রামে তার জন্ম। ১৯৫৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি তিনি কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

তার পিতার নাম জগন্নাথ সাহা ও মায়ের নাম ভুবনেশ্বরী দেবী। মেঘনাদ তাদের পঞ্চম সন্তান ছিল। জগন্নাথ সাহা ছিলেন একজন মুদি। ছোটবেলা থেকেই তাই টানাটানির সংসারে তাকে মানুষ হতে হয়। গ্রামের টোলে মেঘনাদের পড়ালেখার সূচনা হয়।

গ্রামটিতে তৃতীয় শ্রেণির উপরে পড়ালেখার কোনো স্কুল ছিল না। কিন্তু মেঘনাদের ইতিহাস আর গণিতের সাফল্যে তার শিক্ষকেরা তাকে একটি ইংরেজি স্কুলে পাঠানোর সুপারিশ করেন। তাদের গ্রাম থেকে কাছের মিডল স্কুল (ব্রিটিশ আমলে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণি পড়ার স্কুল) ১০ মাইল দূরে শিমুলিয়া গ্রামে অবস্থিত ছিল। এত দূরে প্রতিদিন যাওয়া আসা করে মেঘনাদের পক্ষে পড়াশোনা করা দুরূহ হওয়ার পাশাপাশি মেঘনাদের বাবার পক্ষেও আর্থিক সামর্থ্য ছিল না শিমুলিয়া গ্রামে মেঘনাদকে রেখে পড়ানোর।

তখন মেঘনাদের বড় ভাই এবং পাটকল কর্মী জয়নাথ শিমুলিয়া গ্রামের চিকিৎসক অনন্ত কুমার দাসকে মেঘনাদের ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করায় তিনি রাজি হন। তবে শর্ত হিসেবে মেঘনাদকে তার থালাবাসন নিজেই ধৌত করতে বলেন, পাশাপাশি বাড়ির গরুর দেখভালের দায়িত্ব মেঘনাদের উপর চাপিয়ে দেন। সে সময় প্রতি রবিবার তিনি হেঁটে হেঁটে শিমুলিয়া গ্রাম থেকে শেওড়াতলী গ্রামে সকালে গিয়ে সন্ধ্যায় ফিরে আসতেন।

তিনি প্রাথমিক পরীক্ষায় তৎকালীন ঢাকা জেলার মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন। সে সময় মাসিক চার টাকার সরকারি বৃত্তি পান, বৃত্তির টাকা ও জয়নাথের পাঠানো পাঁচ টাকা নিয়ে তিনি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তির উদ্দেশ্যে ঢাকায় আসেন এবং ভর্তি হন। এরপর বৈশ্য সমিতির মাসিক দুই টাকা বৃত্তিও তিনি লাভ করেন।

সে সময়টিতে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন চলছিল। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে পূর্ব বাংলার গভর্নর স্যার বামফিল্ড ফুলার আসবেন শুনে বিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী তার সম্মুখে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী মিছিল করবে নির্ধারণ করে। সে মিছিলে মেঘনাদও ছিলেন। ফলে পরদিন তাকে স্বদেশি আন্দোলনে জড়িত থাকার জন্য ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে ছাড়তে বাধ্য করা হয়।

পাশাপাশি তার সরকারি বৃত্তিও বাতিল করা হয়। পার্শ্ববর্তী কিশোরীলাল জুবিলি হাই স্কুলের একজন শিক্ষক স্বঃপ্রণোদিত হয়ে মেঘনাদকে তাদের স্কুলে ভর্তি বিনাবেতনে অধ্যয়নের ব্যবস্থা করেন। পরবর্তীতে তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজে অধ্যয়ন করেন। সহপাঠি হিসেবে সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও উপরের শ্রেণির প্রশান্ত চন্দ্র মহালনবিশ, আচার্য হিসেবে জগদীশ চন্দ্র বসু ও আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের সান্নিধ্য লাভ করেন। ১৯১৩ সালে গণিতে সম্মানসহ বিএসসি করেন এবং ১৯১৫ সালে ফলিত গণিতে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। উভয় পরীক্ষায় তিনি দ্বিতীয় এবং সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রথম হন।

মেঘনাদ তার সমস্ত গবেষণা ফলাফলগুলো একত্র করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টর অব সায়েন্স ডিগ্রির জন্য আবেদন করেন। তার সব গবেষণা বিবেচনা করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে ১৯১৯ সালে ডক্টর অব সায়েন্স ডিগ্রি প্রদান করে। একইবছর মেঘনাদ প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি লাভ করেন। যার ফলে তিনি ইংল্যান্ড ও জার্মানীতে গবেষণার সুযোগ পান।

১৯১৬ সালে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বিজ্ঞান কলেজ চালু করার পর সত্যেন্দ্রনাথ ও মেঘনাদ উভয়েই গণিত বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। পরবর্তীতে দুজনেই পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে চলে যান। সেখানে চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন পালিত অধ্যাপক হিসেবে পরবর্তীতে যোগ দেন। এরপর ১৯১৯ সালে তিনি প্রথম পাঁচ মাস লণ্ডনে বিজ্ঞানী আলফ্রেড ফাউলারের পরীক্ষাগারে এবং পরবর্তীতে বার্লিনে ওয়াস্টার নার্নস্টের সাথে কাজ করেন। দুইবছর ধরে দেশের বাইরে গবেষণা করার পর মেঘমাদ সাহা ১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে খয়রা অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। কিন্তু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য কোনো বরাদ্দ সেসময় না থাকায় তিনি ১৯২৩ সালে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন।

তিনি ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি গণিতবিদ অমিয়চরণ ব্যানার্জির সান্নিধ্য লাভ করেন। ১৫ বছর ধরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত থাকা অবস্থায় তিনি বিভাগটিকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করেন। এরপর তিনি মারা যাবার আগে অব্দি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের ডীন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

মেঘনাদ এবং সত্যেন বোস যুগ্মভাবে সর্বপ্রথম আলবার্ট আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্বসহ তার বিভিন্ন নিবন্ধ ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করেন। আইনস্টাইনের ১৯০৫ থেকে ১৯১৬ সাল পর্যন্ত মোট যতগুলি নিবন্ধ জার্মান ভাষায় প্রকাশিত হয়েছিল তার সবগুলো ইংরেজিতে অনুবাদ শুরু করেন মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু। তাদের এই অনুবাদ ১৯১৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রিন্সিপাল্‌স অব রিলেটিভিটি নামে প্রকাশিত হয়। অনূদিত বইটির ভূমিকা লেখেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ। ১৯৭৯ সালে আইনস্টাইনের জন্মশতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে বলা হয় আইনস্টাইনের নিবন্ধগুলির প্রথম অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল জাপানে। এই ভুল সংশোধন করে অনুষ্ঠানে উপস্থিত নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখরের চেষ্টায় আইনস্টাইনের রচনার প্রথম অনুবাদের স্বীকৃতি পান সাহা ও বসু।

তাদের এই অনূদিত প্রিন্সিপাল্‌স অব রিলেটিভিটির একটি প্রতিলিপি প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনস্টাইন আর্কাইভে সংরক্ষিত আছে। সাহা ও বসুর এই অনুবাদ সর্বপ্রথম ইংরেজিতে অনুবাদ শুধু নয়, সারাবিশ্বে এটিই আইনস্টাইনের রচনার প্রথম অনুবাদ। ১৯২৭ সালে তিনি রয়্যাল সোসাইটির ফেলো হন। ১৯৩১ সালে এলাহাবাদে উত্তর প্রদেশ একাডেমি অব সায়েন্স প্রতিষ্ঠা করেন, পরের বছর থেকে এ সংগঠনের নামকরণ করা হয় ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্স, ইন্ডিয়া। তিনি হন এর প্রতিষ্ঠাতাকালীন সভাপতি।

১৯৩৩ সালে সূচনা করেন ভারতীয় পদার্থবিজ্ঞানীদের সংগঠন ইন্ডিয়ান ফিজিক্যাল সোসাইটি। এখান থেকে প্রকাশিত হতে থাকে ইন্ডিয়ান জার্নাল অব ফিজিক্স সাময়িকী। ১৯৩৪ সালে ২১তম অধিবেশনে ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেস সংস্থার সভাপতি হন। তার উদ্যোগে যাত্রা শুরু করে ইন্ডিয়ান ইন্সটিউট অব সায়েন্স যা ইন্ডিয়ান ইন্সটিউট অব টেকনোলজি নামে বর্তমানে পরিচিত। ১৯৫০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স যা বর্তমানে সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স নামে পরিচিত।

১৯৫২ সালে ভারতীয় লোকসভার নির্বাচনে উত্তর পশ্চিম কলকাতা থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত সাংসদ হন। মেঘনাদ সাহার অন্য একটি উল্লেকযোগ্য অবদান ছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরুর কথামতো ভারতীয় বর্ষপঞ্জির সংস্কার। মেঘনাদ সাহা পরমাণু বিজ্ঞান, জ্যোতির্পদার্থবিদ্যা, নিউক্লিয় পদার্থবিদ্যা, আয়ন মণ্ডল, বায়ুমণ্ডল ও মহাকাশবিজ্ঞান, পঞ্জিকা সংস্কার, বন্যা প্রতিরোধ ও নদী পরিকল্পনা বিষয়ে গবেষণা করেন। তিনি তাপীয় আয়নবাদ (Thermal Ionaisation) সংক্রান্ত তত্ত্ব উদ্ভাবন করে জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন।

১৯৩০ সালে ভারতীয় পদার্থবিজ্ঞানী দেবেন্দ্র মোহন বসু এবং শিশির কুমার মিত্র মেঘনাদ সাহাকে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেন। নোবেল কমিটি মেঘনাদ সাহার কাজকে পদার্থবিজ্ঞানের একটি উল্ল্যেখযোগ্য প্রয়োগ হিসেবে বিবেচনা করলেও এটি "আবিষ্কার" নয় বলে তিনি নোবেল পুরস্কার পাননি। মেঘনাদ সাহাকে ১৯৩৭ সালে এবং ১৯৪০ সালে আর্থার কম্পটন এবং ১৯৩৯, ১৯৫১ ও ১৯৫৫ সালে শিশির কুমার মিত্র আবারো মনোনীত করলেও নোবেল কমিটি তাদের সিদ্ধান্তে অনড় থাকে।