জ্ঞানার্থীদের প্রতি, অভিজ্ঞতার অধিকারে বলা

জগলুল আসাদ

প্রকাশিত : জুলাই ১৮, ২০১৯

বলা হয়, বুদ্ধিমানেরা দেখে শেখে আর বোকারা শেখে ঠেকে। তো, দেখতে দেখতে ও ঠকতে ঠকতে জীবনের এই প্রান্তে লোকজনরে দু’চারটে হক উপদেশ দেয়ার পর্যায়ে পৌঁছেছি বলে মনে হয়। অপরের ভুল থেকে শিখতে হয়, অন্যের অভিজ্ঞতা থেকেও নিজের জীবনের রসদ জোগাতে হয়।

তো, আমি আমার সন্তানদের, শিক্ষার্থীদের ও আগ্রহীদেরকে পরামর্শ দেব পড়াশোনার ক্ষেত্রে ‘ফোকাসড’ হতে, নিজের প্রয়োজনের বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পড়তে। যারা জ্ঞানপিপাসু তারা প্রায়শই বাছবিচারহীন লেখাপড়া করেন। এটা, আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, ক্ষতিকর। সর্ববিদ্যাবিশারদ না হয়ে বিশেষ কোনো বিষয়ে অথোরিটেটিভ নলেজ অর্জন করার চেষ্টা করলে সেটা কাজের হয়।

ভালো ফলাফল করার জন্য নিরবিচ্ছন্ন পরিশ্রম করেও কেউ যদি গড়পরতা রেজাল্ট করে, তবুও ওই পরিশ্রমের বিপুল মূল্য আছে। পরিশ্রম অনুযায়ী প্রাপ্তি সব সময়ে না হলেও অই পরিশ্রম বৃথা যায় না। পরিশ্রমের অভ্যাস গড়ে উঠলো সেটা জীবনের অনাগত সব ক্ষেত্রেই সাফল্যের সম্ভাবনা তৈরি করে। যে পড়াশোনায় নিবেদিত ও আন্তরিক, জীবনের অন্যন্য ক্ষেত্রেও সে শ্রম ও নিষ্ঠার পরিচয় দেবে বলে আশা করা যায়। ব্যতিক্রম নাই এমন নয়। তবে নিষ্ঠা ও শ্রমশীলতাকেও অভ্যাসে স্থায়ী করতে হয়। আমি এমনটি দেখেছিও বহু।

পাঠ্যবইয়েও জ্ঞান আছে, এটা বোঝা জরুরি। পাঠ্যবস্তুকে বিশদ জানার ইচ্ছে ও চেষ্টা, জাগতিক সাফল্যের `সহজ` উপায়। ধরা যাক, পরীক্ষার জন্য পড়তে হবে সেকুলারিজম নিয়ে প্রশ্ন। তো, পাঠ্য বইয়ের বাইরেও পড়ে নেয়া যেতে পারে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ৭-৮টি আর্টিকেল। জানার তৃষ্ণাও মিটলো কিছুটা, পরীক্ষার কাজেও লাগলো। ‘বাংলা বা ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস’ পাঠ্য থাকলে পড়ে নেয়া যেতে পারে যুগবিভাগগুলোর সামাজিক, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাস। কোনো এক নভেলকে ব্যখ্যা করার প্রয়োজনে জানা হয়ে যেতে পারে বিনির্মাণবাদ, মনোবিশ্লেষণী শাস্ত্র বা উত্তর-উপনিবেশবাদ, উত্তরাধুনিকতাবাদের পর্যালোচনা। এভাবে, পাঠ্যবস্তুকে কেন্দ্র করে আরো বহুবিধ বিষয়ের সাথে নিজেকে পরিচিত করার উদ্যোগ নিলে দ্বিগুণ লাভ। এ লেখায় জাগতিক সাফল্য বলতে ভালো ফল ও ভালো চাকরিই বুঝাচ্ছি আপাতত, কারণ এগুলো সম্মান আনে ও সুযোগের অনেক দুয়ার খুলে দেয়।

জীবনে পড়বার বিষয় সীমাহীন। তাই কিছু বিষয় এক্ষুণি না পড়ে ভবিষ্যতের জন্য রেখে দেয়া ভালো। খুব জরুরি Now and Here এর বোধ। এখনকার যে-পড়া সেটা পরে পড়ার সুযোগ পাওয়া আর যাবে না। যেটা পরে করলেও হবে, সেটা এখন করে `এখন`-এর গুরুত্ব ও দাবিকে অগ্রাহ্য করা সমূহ ক্ষতির কারণ হয়। নিজের জীবনেই এটা দেখেছি অনেকবার, দেখছিও। ইন্টারে যখন পড়ি, কেমিস্ট্রি পরীক্ষার আগে খুব ভালো লাগতো ফিজিক্সের কোনো বিষয় জানতে। বোটানি পরীক্ষার আগে পড়েছি দীপ্তি ত্রিপাঠীর ‘আধুনিক বাংলা কাব্যপরিচয়’। নটরডেম কলেজের সাপ্তাহিক ‘কুইজ পরীক্ষা’র আগে ভালো লাগতো মাসুদ রানা পড়তে। এভাবে Urgency of Now বুঝতে না পারা বা অবজ্ঞার ফল ভালো না হওয়ারই কথা। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে পাঠ্যবিষয় পড়েও জ্ঞান হাসিল করা সম্ভব ছিল, বুঝিনি। তখন আমি হাতিঘোড়া মেরে বেড়াতাম। আমাদের অনেকের হাতে হাতে ঘুরে বেড়াত গৌতম ভদ্রের ‘ইমান ও নিশান’, জোসেফ ক্যাম্পবেলের ‘মিথের শক্তি’, দেবেশ রায়ের ‘উপন্যাস নিয়ে’, সুশোভন সরকারের ‘বাংলার রেনেসাঁ’ বা বদরুদ্দীন উমরের বইগুলো। এখন বুঝি, কিছু বই পরে পড়লেও চলতো, যেমনটি বন্ধু ও পরিচিতদের মধ্যে অনেকেই করেছেন, যারা পরবর্তীতে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পেয়েছেন উজ্জ্বল সফলতা। কিছু জিনিস পরে জানাই ভালো, যদি সত্যি আগ্রহ থাকে। ধৈর্য দরকার। আগেভাগেই জেনে ফেলব জগতের সব, এই প্রলোভন থেকে মুক্ত থাকা বড্ড দরকার। প্রয়োজন আগে মিটিয়ে, পরে যেন আপাত অপ্রয়োজনের দিকে হাত বাড়াই। মনে রাখি যেন, অনেক সময় তিন মাসের নিবিষ্ট শ্রম, মানুষকে আগামী ৩০ বছর সুখ ও সাফল্য দিতে এবং জীবনের বহু সাধ ও স্বপ্ন পূরণে সহায়ক হতে পারে।

প্রয়োজনীয় ও পাঠ্যবস্তুতে আনন্দ পাওয়া কঠিন হলেও এটা যে পায় তার সফলতা ঠেকিয়ে রাখা কঠিন। জীবনানন্দ দাশের কথাটিকে একটু ঘুরিয়ে বলা যায়, আনন্দ হলো সুন্দরীর কটাক্ষের পেছনের শিরা-উপশিরার মতো। মজার প্রহেলিকা এই যে, কষ্ট করেই আনন্দ পেতে হয়। এন্ড্রু মার্ভেল  লিখলেন, Tear out pleasure with rough strife. কীটস বলেন, strenuous tongue Can burst Joy`s grape. সুতরাং, আনন্দ পেতে কষ্ট করুন। যে কাজ কঠিন সেই কাজে সোয়াব বেশি!

সত্যিকার পড়াশুনা নিঃসঙ্গ-একাকীর গান। অপরের সাহায্য পথ দেখালেও সে পথে চলতে হয় একাকীই, নিজে নিজে। তবে অপরের সাথে নিজের বুঝ ভাগাভাগি করলে বুঝের শক্তি ও ধার বাড়ে বইকি। জ্ঞান এক অগ্নিশলাকা যেখান থেকে আরো দ্বীপ প্রজ্জ্বলিত করলেও আগুনের ঘাটতি হয় না কারোরই।