‘জেলা সরকার’ হতে পারে সকল ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু

মোশাররফ হোসেন মুসা

প্রকাশিত : জুলাই ০৫, ২০১৮

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত জাতীয় সংসদে ২০১৮-২০১৯ অর্থ বছরের বাজেট বক্তৃতায় বলেন, ‘আমি দৃঢ়ভাব বিশ্বাস করি, বাংলাদেশে নিয়মতান্ত্রিক বার্ষিক হার দশ শতাংশে নেয়া যায়। কিন্তু সেজন্য প্রয়োজন ক্ষমতা ও দায়িত্বের বিকেন্দ্রীকরণ। সেজন্য স্থানীয় সরকারকে ঢালাও ভাবে সংস্কার করতে হবে। সে প্রয়োজনটি সংবিধানের ৫৯ ও ৬০ অনুচ্ছেদে বলা আছে। সংবিধানের উল্লিখিত অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, শাসনতান্ত্রিক সংস্কার করতে হলে আমাদের ৬৪টি জেলা ও ৯টি মহানগরে স্বশাসিত ও স্বয়ম্ভর সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ সরকারগুলোর জন্য তাদের নিজস্ব আমলাতন্ত্র বহাল করতে হবে। তাদের দায়িত্ব ও কাজের তালিকা প্রস্তুত করতে হবে। কিছু বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকার ও জেলা সরকারের যৌথ দায়িত্ব ও এর সমন্বয়ের প্রক্রিয়া নির্ধারণ করতে হবে। এ কাজটি করতে পারলে সহজেই জেলা সরকারের গঠন প্রক্রিয়া স্থির করা যাবে’। (আজকালের খবর, ৮ জুন ১৮)।

তিনি এর আগে (২০০২ সালে) ‘জেলায় জেলায় সরকার’ নামক একটি বই লিখেছেন। যদিও বইটিতে বিভিন্ন দেশের স্থানীয় সরকারের ইতিহাস স্থান পেয়েছে। জেলা সরকার কি, এটি কীভাবে গঠিত হবে, এর রূপরেখাই বা কি ইত্যাদি বিষয়ে কোনো কথা নেই। তিনি তার বক্তব্যে একটি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন অথচ সরকারের প্রকারভেদ নিয়ে কিছু বলেননি। তার ছোটভাই জাতিসংঘের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি (বর্তমানে চট্টগ্রামের স্টক একচেঞ্জের চেয়ারম্যান) ড. একে আব্দুল মোমেনও অনুরূপ আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। তিনি ‘স্বপ্ন পূরণের বাজেট ২০১৮-২০১৯ রূপরেখা ও প্রস্তাবনা’ শীর্ষক এক কলামে বলেছেন, ‘জনগণের বহুমুখী প্রতিভা ও সৃষ্টিশীল স্পিরিটের পরিস্ফুটনের মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার জন্য প্রয়োজন সরকারের বিকেন্দ্রীকরণ এবং জেলায় জেলায় জেলা সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন। (বণিক বার্তা, ৩০ মে, ১৮)।

এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও একাধিকবার বলেছেন, ‘এদেশে প্রাদেশিক ব্যবস্থার কোনো বাস্তবতা নেই। স্থানীয় সরকার কার্যকর হলেই প্রদেশের প্রয়োজনীয়তা থাকবে না।’ কিন্তু বাস্তবে স্থানীয় সরকার কার্যকর হওয়া তো দূরের কথা, অতীতে স্থানীয় সরকারের হাতে যতটুকু ক্ষমতা ছিল ততটুকুও কেড়ে নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। ফলে যারা স্থানীয় সরকার নিয়ে কাজ করেন, তথা যারা ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও জনগণের ক্ষমতায়ন চান, তারা ভাবতে শুরু করেছেন, এ সরকারের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের মাথা থেকে যে তত্ত্ব আসেনি, সে তত্ত্ব যতই চমকপ্রদ হোক না কেন, সেটা তারা গ্রহণ করতে সম্পূর্ণভাবে অনিচ্ছুক।

অন্যদিকে ১৯৭৫ সালে বাকশাল সরকারের সময় গৃহীত ডিস্ট্রিক্ট গভার্নমেন্ট পদ্ধতিও গ্রহণ করা যাচ্ছে না। যেহেতু সে ব্যবস্থা ছিল একনায়কতান্ত্রিক সরকারের ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। সে কারণে অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবিত জেলা সরকার ব্যবস্থা নিয়ে সকলের মনোযোগী হওয়া উচিত।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের সংবিধানে ৩য় পরিচ্ছেদে ‘স্থানীয় শাসন’ বাক্যটি সংযুক্ত আছে। অথচ আমাদের রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী ও এনজিও সমাজ ‘স্থানীয় সরকার’ বাক্যটি বহুলভাবে ব্যবহার করেন। সরকারও ‘স্থানীয় সরকার’ শব্দটি দিয়ে বিভিন্ন বিভাগ সৃষ্টি করেছেন। যেমন- স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ ইত্যাদি। অর্থাৎ বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতার কারণেই সকলেই ‘স্থানীয় সরকার’ শব্দটি ত্যাগ করতে পারছেন না। এমতাবস্থায় স্থানীয় ইউনিটগুলোর সঙ্গে ‘সরকার’ শব্দটি যুক্ত করে দিলেই সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। যেমন- জেলা সরকার, উপজেলা সরকার, নগর সরকার, ইউনিয়ন সরকার ইত্যাদি।

তার আগে দুই প্রকারের ‘সরকার পদ্ধতি’ বাস্তবায়ন করতে হবে। সেসঙ্গে স্তরবিন্যাস করে স্থানীয় কাজগুলো বিভাজন করে দিতে হবে। এখানে উল্লেখ্য, নিউইয়র্ক প্রবাসী গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ে গবেষক আবু তালেব ১৯৯৬ সালে ঢাকায় একটি সেমিনারে স্থানীয় সরকারের স্তরবিন্যাসের বিষয়টি সুন্দরভাবে তুলে ধরেন। এখন সময় এসেছে, এ জাতীয় গবেষণাগুলোকে সমন্বয় করে একটি সময়োপযোগী সর্বজনগ্রাহ্য একটি ডিজাইন প্রণয়ন করা। এখানে সংক্ষেপে জেলা সরকারের রূপরেখা তুলে ধরা যেতে পারে।

জেলা প্রশাসন, জেলা সংসদ ও জেলা আদালত মিলে ‘জেলা সরকার’ গঠিত হবে। জেলা চেয়ারম্যান (অন্য নামও হতে পারে) জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন। তিনি জেলা প্রশাসনের প্রধান হবেন। তার নেতৃত্বে জেলার সকল উন্নয়ন কার্যকাণ্ড পরিচালিত হবে। জেলার আয়তন ও জনসংখ্যার ভিত্তিতে জেলা সংসদের সদস্য সংখ্যা নির্ধারিত হবে। প্রতিটি আসনে একজন নারী ও একজন পুরুষ নির্বাচিত হবেন। তারা একজন সংসদ সভাপতি (স্পীকার) নির্বাচিত করবেন। জেলা সংসদ জেলা কেন্দ্রিক সকল উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করবে এবং প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করবে। জেলা আদালত জেলার আয়তনের মধ্যে দেওয়ানি ও ফৌজদারী অভিযোগসমূহ নিষ্পত্তি করবে। জেলা সরকারের বাইরে একজন ন্যায়পাল ও একটি নির্বাচনিক বোর্ড থাকবে। একজন নির্দলীয় সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি হবেন ‘জেলা ন্যায়পাল’। গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ‘জেলা নির্বাচনী বোর্ড’ গঠিত হবে।

জেলা নির্বাচনী বোর্ড জেলা সরকারের মেয়াদ শেষে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে। একইভাবে সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভাগুলোতে একরূপ ‘নগর সরকার’, উপজেলায় ‘উপজেলা সরকার’ (যদি প্রয়োজনীয়তা থাকে) এবং ইউনিয়নে ‘ইউনিয়ন সরকার’ গঠিত হবে। জেলা সরকার একহাতে নগর সরকারগুলোকে এবং অন্যহাতে গ্রামীণ স্থানীয় সরকারগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করবে। কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে শুধু জেলা সরকারের সম্পর্ক থাকবে। ৬৪টি জেলা সরকার থেকে ১২৮জন প্রতিনিধি নিয়ে জাতীয় সংসদের ‘উচ্চতম কক্ষ’ সৃষ্টি করা যেতে পারে। জেলা সরকার হবে প্রদেশের বিকল্প হিসেবে স্থানীয় সরকারের একক উচ্চতম স্তর। মনে রাখা দরকার, ২০৫০ সালের মধ্যে সমগ্র দেশটি নগরায়ন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সেজন্য পরিবেশবান্ধব-পরিকল্পিত নগরায়নের স্বার্থে জেলা সরকার হতে পারে সকল ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু। এই ডিজাইন গৃহীত হলে ভবিষ্যতে নগর সরকারগুলোকে এককভাবে ‘জেলা সরকার’ নিয়ন্ত্রণ করবে। তখন বর্তমানের মতো স্থানীয় সরকারের একাধিক ও দূরবর্তী কোনো কর্তৃপক্ষ থাকবে না।

লেখক: গণতন্ত্রায়ন ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ে গবেষক