জুয়েল মাজহার
জুয়েল মাজহারের কবিতা ‘মম প্রিয় বন্ধুগণ’
প্রকাশিত : জুন ১০, ২০২১
১.
মম প্রিয় বন্ধুগণ তপ্ত লাল শলাকা শানায়। আর
রক্তজবা কানে গুঁজে শব্দ করে ভয়ানক হাসে
মাঝে মাঝে বক্ষো’পরে বসে তারা
মোর পানে উঁচায় খঞ্জর
তাদের চেহারাগুলি ঘোরলাগা
লাল আর বিভীষিকাময়
আমাকে তারাই ফের পিঠে নিয়ে চলে বহুদূর
আমাকে তারাই ফের তৃপ্ত করে
লেহ্য-পেয়ে, সুরায় আরকে!
দিন ক্রমে নত হয়!
সূর্যের গ্রীবা ঢলে পড়ে
যখন সবাই ঘুমে
বদ্দিরাজ গাছে এক চোর
মগডালে রুপালি বর্তুল।
সাদা-নীল পরচুলা, উঁচু টুপি,
লাল মোজা, কালো মোকাসিন
বিনোদক বাঁশি নিয়ে
রাতেই নীরবে তারা আসে;
সময় হলেই তারা অবলীলাভরে
বুকে উঠে দ্রুত হাতে চালায় খঞ্জর!
সুর্মাটানা চোখজোড়া প্রপীড়িত
প্রেমময় অন্ধ খোড়লে!
রূপালি নদীর জলে ভিস্তি ভরে
দল বেঁধে কারা আসে, কারা যায় হেঁটে
মোগলটুলিতে আর আরমানিটোলায়
বৈকালিক পথে কারা বাজখাঁই হাঁক দিয়ে যায়?
আর আমি, হয়তো চোখের ভ্রম, দেখি:
খাম্বিরা তামাকে তৃপ্ত পুরান ঢাকার সব
রাংতা-মোড়া জানালার কাচ ভেঙে পড়ে
২.
এ সময় তুষারঝড়ের গ্রীবা নড়ে যদি সমূহ বিপদ
সুবিস্তীর্ণ স্তেপজুড়ে ঠাণ্ডা হিম করাতের দাঁত
তারপর শান্ত সব। গর্জনেরা হঠাৎ নীরব!
চতুর্দিকে অসীম বরফ শুধু, ধ্বংসরেখা আর
পাহাড়ের উচ্চাবচ চূড়া যেন বিমর্দিত স্তনের কাফেলা
ঝড় শেষ হওয়া মানে
আকাশে রূপালি তাঁবু ফুলে উঠবে এখন আবার
ধারালো নখের নিচে ঈগলেরা লুকায় শিকার
আর তারা বিপুল ডানার তলে, ছানাদের আগলে রাখে
সুকোমল লোমের আদরে
অপর্যাপ্ত খাদ্যকণা, যবদানা, ঠাণ্ডা মাংস পথে-পথে এখন সম্বল;
মিতব্যয়ী, সচেতন তারা জানে রসদ সামান্য কিন্তু
সামনে আরো লড়াই লড়াই শুধু লড়াই লড়াই!
ঠাণ্ডা রুটি ধেনো মদ যবদানা তারা তাই ভাগ করে খায়।
নিজে খায়, পশুকে খাওয়ায় আর
পালান নামিয়ে রেখে ঘোড়াগুলো ছেড়ে দেয় ঘাসে
ত্রস্তে তারা জড়ো হয়
চম্রি গাইয়ের ত্বকে তৈরি এক দড়াটানা তাঁবুর ভিতরে;
মধ্যরাত। বাইরে হু-হু হাওয়ার ঝাপট
তাদের ক্লান্ত হাতে অভ্যাসের তাস জমে ওঠে!
তাঁবুর ভেতরে তারা খুমিশ ঢালছে পেয়ালায়!!
৩.
ক্রূর, বক্র ভীতিপ্রদ, অতিকায় তাদের নাসিকা;
গুম্ফ নেড়ে নেড়ে তারা ত্রাহিরবে দুনিয়া কাঁপায়!
তাদের করাল ঠোঁটে রক্ত-চর্বি, ছিন্নমাংস চূনিগাঢ় লাল!
বক্র-শ্যেন-ঘোরলাগা রক্তজবা তাদের নয়ান!
তাদের চক্ষু থেকে ক্ষণে ক্ষণে ঝরে শুধু
শত শত মৃত্যু আর শব
তারাই আমার সখা
সদাহাস্য তাহাদের কপালে তিলক;
যুদ্ধ আর রিরংসার তরবারি দিয়ে তারা
ক্রমাগত আমাকে শাসায়!
আস্তিনের ভাঁজ খুলে বের করে খড়্গ-চাকু,
জংধরা বাঁকা তলোয়ার
কল্লাবালু দিয়ে তারা ছুরি-কাঁচি ধার দিয়ে চলে।
আর এই আমি যেন ঈশ্বরের প্রিয়তম ভেড়া
প্রতিদিন দিবালোকে বলি হয়ে যাই
কপালের ফেরে হায়, এ-যেনবা শেষ নিশিভোজ
সকলের মধ্যে একা। নীলমণি-যিশু!
নিজের কলবে আমি কান পেতে রই আর শুনি:
পাপাল বুল-কে ঘিরে টানাদীর্ঘ চারশো বছর
কোটি কোটি মার্জারের অবিরাম মরণ-চিৎকার!
৪.
অভ্রভেদী লাফ দিয়ে, ভয়ে আমি,
অবিরাম দ্রুত উড়ে উড়ে
শত শত ক্রুশ আর সূচ্যগ্র শলাকা থেকে নিজেকে বাঁচাই
ক্রমাগত ভিক্ষা করি
লক্ষ নিমেষ আর একটি নিমেষ!
আর আমি দুই চোখ মুদে
প্রেমপূর্ণ রিরংসায় মম প্রিয় বন্ধুদের দেখে যেতে চাই:
মধ্যরাত। তাঁবুর ভেতরে তারা
খুমিশ ঢালছে পেয়ালায়!