জিয়া হাশানের গল্প ‘প্রাণ প্রোডাক্ট’
পর্ব ৪
প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২১
এগুলা সব অপঘাতে মরণ। তাগো আত্মারা কী আর সুইস্থো আছে। হগোল অসুইস্থো প্রেতাত্মা অইয়্যা গ্যাছে। তারা সুইস্থো-সবল কিছু দ্যাখতে পারে না। হগোলরে অসুইস্থো বানাইয়্যা দ্যায়। তাই ইডগুলা ব্যাঁকা-ত্যারা অইয়্যা জনমাইছে। বুঝলা মিয়া।
তাগো বোতলবন্দি কইরা দ্যান।
ক্যামনে অ্যাঁ? আত্মা অইলো আল্লার নিজের হাতের তৈয়ার। তাগো তাই মরণ নাই। হ্যারা অমর। তাই আগুনে পোড়ে না। পানিতে ডোবে না। হাওয়ায় হাওয়ায় ভাইসা বেড়ায়।
তাগো তাড়াইয়্যা দূর করি কী উপায়ে?
মাহফিল দাও। তিন দিনের ওয়াজ মাহফিল। বড় বড় আলেম-ওলামাগো ডাকো। তাগো আদর-যতন করো। খুশি কইরা দ্যাও। দ্যাখবা তাগো মুহের পাক-পবিত্র কথায়, আল্লা-রসূলের বয়ানে হগোল প্রেতাত্মা দূর অইয়্যা গ্যাছে। মাইকে হ্যাগো মুহের আওয়াজ যত দূর যাইবে হ্যার মইদ্যে আর আওয়ার সাহস পাইবে না। তারপর শ্যাষদিন আখেরি মোনাজাতে দাও। পিরসাবরে ডাকো। গাঙের ওপাড়েই তো আছেন কামেল পির। হ্যায় আখেরি মোনাজাত ধরলে বদআত্মাগো আর রক্ষা নাই। আওয়াজ যত দূর যাইবে খুডি পোতা অইয়্যা যাইবে। কোনো বদ আত্মা আর আগাইতে পারবে না। ভাডার হাওয়া পাক-পবিত্র অইয়্যা যাইবে। ইডেরাও তহন কেতাদুরস্ত অইয়্যা জনমাইবে। হেয়া বেচলে মহাজনের খুতি ফুইল্যা উডবে দ্যাখবা। যাও, আয়োজন করো। আর আল্লার উপর ভরসা রাখো। সব মুসকিল আসান অইয়্যা যাইবে। ইনশাল্লা।
ওয়াজ মাহফিল! মহা পুণ্যের কাম। সওয়াবের ঢল। কবির মহাজন একবাক্যে ঘাড় কাতায়। জেলা-উপজেলা ও সদর থেকে আলেম-ওলামা ভাড়া করে। গাঙের ওপার থেকে পিরসাবরে।
গ্রামসংলগ্ন চর তাই আশপাশের চৌদ্দগাঁও থেকে লোকজন সমবেত হয়। ট্রলারে গাঙ পাড়ি দিয়াও আসে। ফলে ভাটার দক্ষিণে খাড়া করা সামিয়ানার খুঁটি পায়ে পায়ে আগায়। আখেরি মোনাজাতের দিন জোর কদম চালায়। তারা যত দূর আগায় তার পুরাটাই মহাজনের বগল তলায় চলে আসে। এমাথা ওমাথা জুড়ে বিঘা পাঁচেক চর-জমি ভাটার সাথে জয়েন করে। গলাগলি দিয়া শুয়ে আগামী মৌসুমে তরমুজ চাষের জন্য উম্মুখ হয়ে থাকে।
তিন.
সঙ্গমের শীর্ষে আরোহণ করে নগ্ন আছিয়ার বুকের ওপর গোড়া কাটা কলাগাছের মতো ধসে পড়ার পর লতিফ কারিগর নিশ্চিত হয়. পেরান প্রোডাক্টের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন হয়ে গেছে। কেননা একে তো দিনক্ষণ হিসাব করে, মাস-পিরিয়ড হাতের মুঠায় পুরে আসা। তারপর শুরু থেকেই আছিয়া যেভাবে শরীর মোচরাইছে, সাগরের ঢেউয়ের মতো উথাল-পাথালে নাচাইছে, মুখে শীৎকার-চেচামেচি ধ্বনিতে গলা তুলছে তাতে সন্দেহ-সংশয়ের আর কোনো জায়গা নাই। চার চারটা প্রাণ প্রোডাকশনের অভিজ্ঞতায় সম্মৃদ্ধ কারিগর নিশ্চয় তার খুঁটি গাড়ে. কেল্লা ফতে! ভিত্তিপ্রস্তর একেবারে মূলে গাঁথা হয়ে গেছে। এখন শুরু হবে আল্লার কুদরত, তার অপার মহিমা। তিনি ভিত্তির উপর একটু একটু পলেস্তরা ফেলবেন, গা-গতরের আকার দেবেন। তবেই দশ মাস দশ দিন পর একেবারে ফিনিশড প্রোডাক্ট, চার হাত পাঅলা সজীব প্রাণ হাজির হবে।
কারিগর তাই নিশ্চিত মনে আছিয়ার বুক থেকে ওঠে। খুলে রাখা জামা কাপড়ে কেতাদুরস্ত হয়। শেষে আছিয়ার পানে একগোছা নোট আগায়ে দিয়া ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানের ইতি টানে, নে ধর। ভালোমন্দ যা মন চায় খাইস। তয় সাবধানে চলাফেরা করবি। য্যানো ঝইড়া না যায়। এ অমূল্য ধন। এরে যতনে ধইরা রাখবি।
আছিয়ার ঘর থেকে বার হয়ে কারিগর হাটের ওমাথায় চালপট্টির পথ ধরে। সেখানে লম্বা ঘরে করিব মহাজনের টাকার কারখানা, হাটের বৃহত্তম আড়ত। টিনে ছাওয়া ঘরের ছাদঘেঁষা চালের বস্তার মাঝে পাতা চৌকিতে মোটা গদি। এখন নিশ্চয়ই তাতে বসে ক্যাশ বাক্স আগলে দিনের হিসাবে ব্যস্ত মহাজন। তারে সুখবরটা দেয়া দরকার, বেপারিসাব! আরেকটু ধৈর্য ধরেন। দশটা মাস মাত্তর। তার পরই আপনার ভাটায় সোনা ফলবে। আপনার দুচার খোলা বাঁকা-তেরা ইটের ক্ষতি, গণ্ডাকয়েক লোকসান তহন সব সুদেমূলে আইয়্যা আপনার খুতিতে বসত নিবে। ব্যাংক একাউন্টে বুক ফুলায়ে খাড়াবে। সে ব্যবস্থা কইরা আইলাম এ্যাই মাত্তর। আলেম-ওলামা দিয়া দোয়া-দরুদের জোয়ার বসাইলেন, তিন দিনের মাহফিল দিলেন, তাতে কাম হয় নাই। কিন্তু এ্যাইবার অইবে। তাজ ওস্তাদের মাসুম ও নিষ্পাপ দাওয়াইয়ের ব্যবস্থা করছি। মূল অনুপানের চারা রোপণ কইরা আইলাম এ্যাই মাত্তর। ফল দিবে দশ মাস দশ দিন পর। এ্যাই কয়ডা দিনের অপেক্ষা কেবল। তারপর ফলডা ভাটারে খাওয়াইলে দ্যাখবেন তার কারিসমা, দাওয়াইয়ের তাকত। ভাটা ক্যামনে খোলার পর খোলা আপনার স্বপনের ইট, লোহার নাহান শক্ত, গোলাপের নাহান রঙিন চারকোনা বার জনম দ্যায়।
তয় স্বীকার করতেই হয় হুজুর সাহেবরা, আলেম-ওলামা-পিরগণ খাটাখাটনি কম করেন নাই। চেষ্টারে তারা তাদের সাধ্যের চূড়ায় নিয়া গেছিলেন। টানা তিন দিন তারা গলা ফাটাইছেন। অশুভ আত্মার পিছনে দৌড়ে বেড়াইছেন। তারপর খোলায় নতুন করে কাঁচা ইট সাজানোর পর চুল্লির মুখে আগুন দেবার দিন আবার ফুঁ দিয়া গেছেন। দোয়া-দরুদ পড়ে খোলার মুখে মুখ ঘুরাইছেন। কিন্তু কামের কাম কিছু হয় নাই। পোড়ানো শেষে হলে দেখা যায়, যে কে সে-ই। আগের মতোই ইটের বাঁকা-তেরা দেহ। কালশিটে মুখাবয়ব।
তাদের চেহারা-সুরত দেখে তো করিব মহাজন রীতিমতো হাউমাউ করে ওঠে। দিনে দুপুরে কপাল চাপড়ায়, হায় খোদা! একী অইলো? আগের খোলার এ্যাকটা ইটও বেচা অয় নাই। গাঙপাড়ে থুপ দিয়া আছে। আবার এ্যাই খোলাও কানা-খোড়া। হায় আল্লা! বেবসাপাতি হগোল শ্যাষ। লোকসানের উপ রলোকসান।
বিলাপের মাথায় গিয়া মহাজন কারিগররে ডাকে, শোনো, দোয়া-দরুদ, ওয়াজ-মাহফিল গিট্টু বান্ধে নাই। ফসকাইয়্যা গ্যাছে। এহন দাওয়াই ধরো। ডাক্তার ডাকো, ধন্বন্তরী করিরাজরে খবর দাও। তাগো ভাডা দেহাও। জিগাও, ভাডার মাথার কোন খতিয়ান খারাপ, প্যাডের কোন খাতে কী গণ্ডগোল।
ওস্তাদের যেমন ওস্তাদ থাকে লতিফ কারিগরের তেমন তাজ মিয়া। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-গাজীপুরের হাজারো কারিগরের গুরু। তার নামে ভাটার জগতে সালামের জোয়ার বয়। আবার তার দাওয়াই ধন্বন্তরী। নাম শুনলেই সাত বছরের মরা ভাটা সোজা হয়ে খাড়ায়। তার দুই ডোগ দাওয়াই খেয়ে খোলার পর খোলা সোনার বরণ ইটের জন্ম দেয়। তারা একটু চিত-কাত হয়ে শুলে তবেই রাজধানীর উঁচাউঁচা বিল্ডিংগুলা শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে সক্ষম হয়।
আর কোনো উপায়ের খোঁজ-খবর না পেয়ে শেষে গুরুরেই ফোন দেয় লতিফ কারিগর,ওস্তাদ, মোরে বাঁচান। আইছিলাম কীর্তি খাড়া করতে। ইচ্ছা আছিল এমন ভাটা গড়মু ভূ-ভারতে তার নাম ছড়াইয়্যা পড়বে। হগোলে এ্যাক নামে চিনবে। এহন হে স্বপন তো ধুলায় মিইশ্যা গেছেই বরং নিজের জান লইয়্যা টানাটানি শুরু অইছে।
ক্যান কী অইছে আবার? চলবে