জিয়া হাশানের গল্প ‘প্রাণ প্রোডাক্ট’

পর্ব ২

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০৯, ২০২১

দুই.
সন্ধ্যার স্বভাব খারাপ। সে সোজা পথে হাঁটে না, নীরবে চলে না। বরং বানারিপাড়া-স্বরূপকাঠির বুক চিরে বাঁকের পর বাঁকে ফেলে কলকল স্বর তুলে তার খরস্রোতা চলা। আর যে বাঁকে দীঘলকাঠি হাট, তার কোল ঘেঁষা চরে গোলাপি ব্রিক ফিল্ড। দূর আকাশ পানে মুখ উঁচা করা ইট তৈরির কারখানা।

তার গোড়পত্তনি দিনে উদ্বোধনী আসর বসে চরজুড়ে। লম্বা সামিয়ানার উত্তর মাথায় পিঠ উঁচা করা স্টেজ। এত বড় চর, তারে কী কম চেয়ারে বাগে আনা, বগল তলায় রাখা সম্ভব? তাই এমপি, ইউএনও, টিএনও, চেয়ারম্যান-মেম্বর কেউ আর বাদ থাকে না। তাদের জন্য ঘাড় তোলা চেয়ারের লম্বা সারি পড়ে স্টেজের এমাথা-ওমাথাজুড়ে। ভাটার মহাজন কবির বেপারিরে দিয়া আসরের বক্তৃতার পালা শুরুহয়— মোরা এ্যাই ভাডায় দ্যাশের সেরা ইড তৈয়ার করতে চাই। হ্যার দেহো অইবে লোহার নাহান শক্তপোক্ত। শত শত ঝড়-বাদল, বান-ভূমিকম্পেও ভাঙবে না। গতর অইবে গোলাপের নাহান লাল টকটকে। হাজার বছরেও ঘুণ ধরবে না। তার লাইগা ভাডার নাম দিছি গোলাপি। ওই যে দ্যাহেন বিরাট সাইনবোর্ড— গোলাপি ব্রিক ফিল্ড। দূর থাইকা দ্যাহা যায়। নদীর ওপার থাইকাও নজরে পড়ে।

দুই দুইটা গরু জবাই করা সারা। তাদের রান্নাবাড়ার আয়োজন ও জোর কদমে আগানোর পথ ধরা। সুতরাং সামিয়ানার তলে শ’তিনেক লোকের হাততালিতে আর বাধা কোথায়? তারা সজোরে সোৎসাহে করতালি বাজায়। তবে গোস্তের ঘ্রাণে বেপারির পেয়ারের বউয়ের সাথে ফিল্ডের নামের মিলের কথা হয়তো তারা ভুলে যায়। এ সুযোগে বেপারির স্বর আরো জোয়ারি পথ ধরার, উৎসাহে ফেটে পড়ার সুযোগ পায়, হের লাইগা রাজধানী থাইকা কারিগর আনছি। হ্যার হাতের লীলা অপূর্ব। ছোঁয়া পাইলেই ইড দেহো শক্ত করে। গোলাপি বরণ লয়।

বেপারি মঞ্চে লতিফ কারিগররে ডাকে। সবাই তারে দেখে, ছোটখাটো মানুষ। তয় শক্তপোক্ত দেহ-কাঠামো। বয়স চল্লিশের ওপারে, তাই বোধহয় চুলের অর্ধেকের বেশি সাদার ঘরে। তারে বেপারি সবার সাথে পরিচয় করায়ে দেয়, রাজধানীর পাশের কালিয়াকৈরে বাড়ি। ইড-ভাডার ঝানু কারিগর। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-গাজীপুরের হাজার খানেক ভাডায় সাতদিন ধইরা খুঁইজা খুঁইজা হ্যারে পাইছি। বড় কিমতি দিয়া আনতে অইছে। মোডা মাইনের লগে থাকা-খাওয়া ও বিলাস-ব্যসনের কোনো কিছু হ্যার লাইগা বাদ রাখি নাই।

কবির বেপারি দীঘলকাঠি হাটের নামজাদা ব্যবসায়ী। তার করতলে নানা কিসিমের গোটা দশেক দোকান। আড়তদারি থেকে ফইরালি, মহাজনি থেকে দালালি কোনোটাই আর বাদ নাই। তাই তার ব্যবসার অভিজ্ঞতার খুতিহাতি গেলা সাপের মতো ফোলাফাঁপা। কিন্তু ভাটা সম্পর্কিত অংশ চিমটা, সাত দিন না-খাওয়া পেট যেনবা। অথচ ভাটা গড়া, সোনার বারের বলবান বড় ভাই বানানোর শখ ষোল আনা। তাই দিনরাতের পথের ওপারে সুদূর কালিয়াকৈর থেকে হাই পেমেন্টে লতিফ কারিগররে ভাড়া করে আনা।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ঝুট-ঝামেলা শেষে তার কাঁধে বেপারি হাত রাখে, গোড়া পত্তনি অইয়্যা গেল। এহন এরে, এ্যাই ভাডারে আদর-যতন কইরা, দরকারে পিটাইয়্যা-পাটাইয়্যা মানুষ করা গইড়া তোলার দায়িত্ব তোমার। মোর বহু দিনের শখ ভাডা গড়মু। এ্যাই এলাকায় এ্যাকটা ওজাতের ভাডা নাই। অজাত-কুজাতে ভরা। তাগো গরভের জিনিস দ্যাখলে ঘৃণা করে। ছুঁইতেও ইচ্ছা করে না। ইড তো নয় য্যানো চৌকোনা মাডির ঢেলা। তাই মোর বাড়িতে বিল্ডিং তোলার সময় শহর থাইকা ট্রলার বোঝাই দিয়া ইড আনা লাগছে। তয় এহন যারা ঘর তুলবে, দালান-কোডা বানাইবে তাগো কারো য্যানো আর শহরে ছুটতে না অয়। গোলাপি ফিল্ডে আইয়্যা য্যানো হগোলে ধরনা দ্যায়। হেই বেবস্থা করো। তা অইলেই মোর শখ পূরণ। দ্যাশের উপকার দশের খেদমত।

কারিগরও সোৎসাহে ভাটার চাবিকাঠি হাতে নেয়। নিজের ঘাড়ে বসায়। কেননা তার ভালো করেই জানা, জাতের ভাটা গড়ে তুলতে পারলে মহাজন যে-ই হোক, সাইবোর্ডে গোলাপি-টোলাপি যা-ই লেখা থাকুক না কেন, নাম হবে তার। মুখে মুখে ছড়ায়ে পড়বে লতিফ কারিগরের ভাটা। তার ইটের জাতই আলাদা। সবার চেয়ে উঁচা। নিজের গাঁও-গেরাম থেকে হাজার মাইল দূরে এমন একটা কীর্তি খাড়া করা গেলে আর কী লাগে? একজীবনে আর কোন কৃতিত্বের দরকার পড়ে? তাই কারিগর আদাজল খেয়ে নামে। এখানে তার কোনো আত্মীয়-স্বজন, স্ত্রী-পুত্রবন্ধু-বান্ধব নাই। নাই মনোযোগ দাবি করার কেউ। তাই কারিগর পুরাটাই ভাটায় থিতু করে। তারে গড়েপিঠে মানুষ করায় মনপ্রাণ ঢালে।

তবে খেলা শুরু হয় ইট তৈরির পর। ভাটার গোড়াপত্তন শেষে যুৎসই মাটি সংগ্রহ, তারে যাচাই-বাছাই করা, তারপর ইট বানায়ে পোড়াতে মাসখানেক কাটে। কিন্তু তার চেহারা-সুরত দেখে সবার চোখ ছানাবড়া, হায়! একী অদ্ভুত দশা ইটের। যার না আছে কোনো লগইত, যুৎসই আকার-আকৃতি, না আছে সুশ্রী রং। শোনা যায় মানুষের গর্ভে কখনো কখনো কিম্ভূতকিমাকার সন্তান জন্মে। তিন মাথাঅলা, দুই দেহবিশিষ্ট। আরো যে কত কিসিমের রূপ ধরে তারা জগতে পা দেয়। তেমনি দ্যাখো, এই ভাটা একি বিচিত্র চেহারা-সুরতের ইট জনম দিছে।

খবর শুনে সাত-সকালে মহাজন এসে হাজির। রাস্তার উপর মটরবাইক দাঁড় করায়ে সে সরাসরি খোলার মুখপানে ছোটে। কারিগর তার পিছু নেয়। চুল্লির আগুনে জল ঢালা হয়েছে আগেই। গুটিয়ে গেছে তার লেলিহান জিহ্বা। তারপর শিশির জলের হাতে পড়ে এখন সব ঠাণ্ডা। কাছে যাওয়ার, হাতে ধরে দেখায় আর কোনো বাধা নাই।

কবির বেপারি পয়েন্ট ব্ল্যাংক দূর থেকে ইট পানে তাকায়। অবাক বিস্ময়ে তার চোখ বড় হয়ে যায়। কপালে অসংখ্য ভাঁজ কেঁচোর মতো রূপ ধরে এমাথা ওমাথা জুড়ে শোয়।

পুরা হাঁড়ির খবর লেখা থাকে প্রতিটা ভাতের গা-গতরজুড়ে। একটা টিপলেই সবার নাড়ি-নক্ষত্র জানা হয়ে যায়। তাই বেপারি দুকদম আগায়ে খোলার মুখ থেকে একটা ইট হাতে নেয়। নেড়েচেড়ে দেখে, কই তার স্বপ্নের ইট? লোহার মতো শক্ত, গোলাপের মতো রং। এত চকের মতো ভঙ্গুর। চাপ দেবার আগেই ভেঙে ছত্রখান। আর রঙে তো একেবারে গোবর। কালশিটে গতর। ‘কারিগর! এ্যাই ইড কোন কামে লাগবে? কেডা কিনবে, অ্যাঁ? এ্যাত দিনের খাডাখাডনি সব বরবাদ। ট্যাহা-পয়সা সব মাডি। পুরাডাই লোকসান।’

কী জবাব দেবে লতিফ কারিগর! তার মুখও যেলা-জবাব, এত বছর ধরে, বলা যায় জীবনের পুরাটাই কেটেছে ভাটায় ভাটায়। কত হাজারো রকমের ইট দেখা হয়েছে। কিন্তু তাদের এমন অদ্ভুত আকার-আকৃতি কখনো নজরে পড়ে নাই। ভাটার গর্ভে এমন পোড়া মাটির ঢেলা জনম নিতে দেখা হয় নাই কোনোদিন।

কবির বেপারি সে ঢেলা ছুড়ে দেয়, অনেক হয়েছে ভাটা গড়ার শখ পূরণ। আর কত? সে হনহন করে হেঁটে ভাটার বাইরে পা দেয়। দীঘলকাঠিতে তার আরো কত ব্যবসা পথ চেয়ে বসে আছে, তাদের পানে বাইক ছোটায়। দুপুরের মধ্যে হাটের আগা মাথায় রটে যায়, মহাজনের ভাটায় বিকট আকারের ইট জন্ম নিছে। তার কোমর বাঁকা, চলতে ফিরতে অক্ষম। পিঠে উঁচা কুজো, ঠিকমতো দাঁড়ানোর সাধ্য নাই। আবার মুখজুড়ে কালশিটে তিলের সমাহার। দেখলেই গা শিউরে ওঠে। চোখ ফিরায়ে নিতে হয়। চলবে