জিয়াউল হক মিয়াজী
জিয়াউল হক মিয়াজীর ৬ কবিতা
স্মরণ
প্রকাশিত : নভেম্বর ২৭, ২০২৩
কবি জিয়াউল হক মিয়াজীর আজ প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০২২ সালের ২৭ নভেম্বর হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ফরিদপুর শহরের আলিপুরে ১৯৭৩ সালের ১২ নভেম্বর তার জন্ম।
তাকে সমাহিত করা হয় ফরিদপুরের বিখ্যাত আলিপুর গোরোস্থানে। দুই কন্যা অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া মৌমিতা জয়ী ও চার বছর বয়সী আরজিয়া পৃথাকে নিয়ে মিয়াজীর সহধর্মিনী সাজেদা সুলতানা বর্তমানে আলিপুরের বাড়িতেই বসবাস করছেন।
ফরিদপুরের স্থানীয় ছোটকাগজে লিখে মিয়াজীর কবিতা লেখায় হাতেখড়ি। এরপর দৈনিক জনকণ্ঠের সাহিত্য সাময়িকীতে বেশ কয়েকটি কবিতা প্রকাশিত হয়। জীবিকার টানাপড়েনে একটা সময়ে তিনি কবিতাচর্চা ছেড়ে দেন। বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে থাকায় তার কবিতার সঠিক সংখ্যাও জানা যায় না। তার কবিতার কোনো বইও প্রকাশিত হয়নি। আজ সোমবার বিকেল ৩টায় চাঁদের হাট ফরিদপুর জেলা শাখার উদ্যোগে ফরিদপুর প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত হবে ‘কবি জিয়াউল হক মিয়াজী স্মরণ সভা’। সভায় উপস্থিত থাকবেন স্থানীয় কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা। —ওয়ালী নেওয়াজ
জিয়াউল হক মিয়াজীর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তাকে স্মরণ করে তার রচিত ছয়টি কবিতা এখানে প্রকাশিত হলো:
দুই যুগ পর
দুই যুগ পর
ছাতিম ফুলর গন্ধ মালা গেঁথে
ছড়িয়ে দিল টগর ফুলের পায়ে
পাখা নাড়ে হৃদয়ের সেল্যুলার পাখি
হাহাকার ওড়ে আকাশ-সীমানা
ধরা যাবে না— ছোঁয়া যাবে না
বলা যাবে না।
হিরণ্ময়ের দ্বারে মাথা নোয়ালাম
জগৎময়ী শান্তি দাও
ক্লান্ত হয়ো না ক্লান্তি আসার আগে।
রাতের পুরুষ
আমি আর শম্ভুনাথ ছাড়া পুরো শহর গাঢ় ঘুমে নীরব পাথর
কেতলির কোণ ঘেঁষে ছেঁকে ছেঁকে ধোঁয়া আকাশের দরজা
ভেদ করে মিলিয়ে যায় দূরে। বাদামি রঙের কুকুর
দু’চারটে আসে-যায়। কারো মুখে নেই ভাবান্তর।
মরা সাপ পড়ে আছে যেন সুদীর্ঘ রাস্তার অবয়বে।
কী এক নীরব লেনাদেনা— মিটিয়ে নেয় সময়! সহসা মনে
জাগলো পিচ ভেদ করে বুনো ষাঁড়ের মতো উঠে এলো
কে এক— তার লাল চোখে নীল ছোপ ছোপ সমস্ত মুখ
আকাঙ্ক্ষা বৃক্ষ। বাতাস তোলপাড় করে উঠে যায়
স্টেটোমণ্ডল আয়নমণ্ডল... না, আর দ্যাখা যায়নি।
আত্মারা চলে গেল! গভীর নিশ্বাসে বলে ওঠে শম্ভুনাথ
আমি বললাম, কিছু ফেলে গেল কি?
পরদিন সকালে পেপার দিল হকার। পেপার কই?
আকাশের কাবিননামা শম্ভুনাথকে দিতেই সব অক্ষর শাদা হয়ে গেল
যেভাবে আমাদের প্রতিটি দুঃখ শাদা হয় নীরোদের ভালোবাসা সোহাগপুরের
চন্দনা। যেভাবে শাদা হয়েছিল সামাজিক আপেক্ষিক
গুরুত্বের পাশা খেলায়।
দ্বৈত পৃথিবী আমার
কালো মেঘ মেয়ে হেসে হেসে ভেসে ভেসে
আমার দেড়ফুট করোটি ঘরে।
অণুর মতোন লুকিয়ে ফেলে নিজেকে
মহাকাশে গ্রহের আবাস।
হাতে নেড়ে, মুখ মন নেড়ে তৈরি
আইনস্টাইনিক গতিসূত্রে ধাবিত,
কুহেলিকা চাঁদে মায়াহীন বসবাস
পিতৃস্বভাব বৃহস্পতি আঙিনা
পেরুলে, প্লুটোর প্লাটনিক কথকতা
আমার এ দিনলিপি,
এরপর অনন্তের অন্ধকার কবিগাথা
মেঘের চেয়ে, অন্ধের পৃথিবীর চেয়ে গাঢ়
যন্ত্রণা, কালো গর্তের গভীরে বিলীন
আশা ও হতাশা সব মূর্চ্ছা,
ঘুম ভেঙে দেখি, সে ও আমি
বিছানায় নেই।
দেহহীন আত্মার চিত্রকল্প
ভালোবাসার কোনো এক ট্রেন বিচ্যুত হলো
অসময়ে।
চালকের আসনে দক্ষ চালক ছিল
যাত্রীর আসনে দক্ষ যাত্রী।
অথচ কোত্থেকে বেসম্ভব ঝড় এসে
উল্টে নিয়ে গেল ট্রেনটা।
আমরা পোস্টমর্টেমের জন্য
কোনও লাশ পাইনি।
পদচারণ
পায়ে পায়ে হাঁটি পুনশ্চ
অপরাজিত বাংলার পাদদেশে
পরাজিত শতাব্দীর অন্ধকারালোকে
যূথবদ্ধ অপরান্তরের সাথি
সে তুমি সীমারেখা ছোঁওনি কখনো
ভুল তথ্য দেয় ঘুণে ধরা মাদারবোর্ড
না বলতে না পারার জটিলতায়
কাকেদের টয়লেটে আমার ঢাকায় বসবাস
ইরানি বাগান রঙিন হতে যেয়ে
শাদা হয়ে যায়
হেরোইনে বুঁদ মূর্তির বুদ্ধ
শান্তি সুখ হায়েনা হও
বুক চিরে হৃদয় খাও
রঙ দেখি, রঙ দেখি।
বোধের কবন্ধ
হাত-পা বাঁধার পর
ঝুলিয়ে দেয়া হলো দেড়ফুট উঁচু বটের কাণ্ড বরাবর।
নিষ্পলক চোখ দু’বার পিটপিট করে
টর্চের মতো জ্বলে উঠল,
সমবেত জনতার ভেতরের পশুগুলো দিগ্বিদিক জ্ঞানহীন
দপ্ করে আলো তার লেলিহান শিখায় প্রভাবিত করলো,
‘খুনি হলে খুন হতাম না’
এরপর আমার শব্দ আটকে দেয়া হলো
বোধের উঠোনে নেমে এলেন তিনি
দু’চারজন, মানুষকে বাঁচাতে এলো
এক-দুই-তিন-চার
ঠাস ঠাস ঠাস গুলির চমক।
চলে গেল সমবেত যাত্রী
এরপর আমার হাত-পা-মুখ কেটে ফেলা হলো
আমি তার হাত ধরে চলে যাচ্ছি দূরে... বহু দূরে...