জাহীদ ইকবালের গল্প ‘জ্বলে ওঠা মোম’
প্রকাশিত : নভেম্বর ১০, ২০২২
ফুরফুরে মেজাজে পদ্মা সেতুর কাছাকাছি আসামাত্র আকস্মিক টের পেলাম আমার প্যান্টের সাটার খোলা। শিশ্নবাবু রেগেমেঘে ফায়ার। বদমাশটা লাফালাফি করার আর কোনো মোক্ষম ফুরসত পেলো না; যাত্রাপথে, তা-ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসের মধ্যে! বাসভর্তি গিজগিজ করছে মানুষ। তিরিক্ষি মেজাজে নিজেকে শাসণ করার চেষ্টা করি। চোখ মেলতে ইচ্ছে করছে না। ওকে গালি দিয়ে আর কী হবে! ও তো জন্ম থেকেই এমন। আগে জ্বালাতো বাবা-মাকে, ভিজাতো লেপ-তোষক, কাঁথাবালিশ, এখন জ্বালাচ্ছে আমাকে।
আচানক মনে হলো কেউ একজন ওর মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে জাগিয়ে তুলেছে। গাধাটাও হুটহাট করে ক্যাবলাকান্তের মতো ফাঁকামাঠে দাঁড়িয়ে গেছে। সে যেন কামানের গুলি; এক্ষুণি ছিঁড়েফুড়ে বেরিয়ে যাবে।
কেউ যেন আমার নাকের কাছে তাজা বকুল ফুলের মালা চেপে ধরে আছে। এই ঘ্রাণটা আমার ভীষণ অপছন্দ। এত ফুল থাকতে আমি কেন বকুল ফুলের ঘ্রাণ পাচ্ছি! পৃথিবী থেকে বেলি, হাস্নাহেনা, রজনীগন্ধা ফুল কি বিলুপ্ত হয়ে গেছে!
চোখ মেলতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু না মেলেও কোনো উপায় নেই। কে যেন আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে। তার শরীর থেকেই কাঁচা বকুলের ঘ্রাণ আসছে।
চোখ মেলে চোখ রগড়ে যাকে দেখলাম, এটা রীতিমতো অবিশ্বাস্য। বুঝে উঠতে কিছু মুহূর্ত সময় লাগলো। ভাগ্যে পেত্নী জোটে না অথচ জলজ্যান্ত এক হুর এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। তার হাতটা ভীষণ সুন্দর। গোলাপি থ্রী-পিচে তাকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। তার মুখ আমার কাঁধে, তার বাঁ হাত আমার কোলের কাছে, তার ডান হাত আমার পিঠ জড়িয়ে আছে। তার চোখ বন্ধ। সে যেন গভীর কোনো স্বপ্নে বিভোর।
কে এই হুর ? কোত্থেকেই বা এলো সে! আর যাবেই বা কোথায়! পাশের সীটে ষাটোর্ধ একজন বয়স্কলোক বসা ছিল; সেই লোকটা-ই বা কোথায় হাওয়া হলো! ভাবতে পারছি না। না স্বপ্নের ভেতরে নতুন কোনো স্বপ্ন এসে ঢুকে পড়েছে! ঢোকা অস্বাভাবিক কিছু নয়; ঢুকতেই পারে। স্বপ্ন হচ্ছে স্বাধীন। স্বপ্ন কোনো শৈরশাসকের শাসণ মানে না। তাছাড়া বউ পালানো মানুষের স্বপ্ন স্বাভাবিক হবার কথাও নয়।
আমি দ্রুত চোখ বন্ধ করি। শিশ্নবাবু রাগে সরীসৃপের মতো ফণা তুলে ফোঁস ফোঁস করছে। হুর তখনো ঘুমোচ্ছে। আমি ঘুমাতে পারছি না। আমার ঘুমানোটাও এই মুহূর্তে ঠিক হবে না। গতকাল প্রধানমন্ত্রী আমাদের স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধন করেছেন, সেতুটা একঝলক হলেও দেখা দরকার। খুলনা ছেড়ে যাচ্ছি। আর কবে আসব তা-ও জানি না।
আমাদের বাস কিছুক্ষণের জন্য সেতুর মধ্যখানে দাঁড়াবার কথা। রাত এখন কটা বাজে জানি না। তবে আকাশে গোলগাল বিশাল এক চাঁদ উঠেছে। সেই চাঁদের ছায়া পড়েছে পদ্মার জলে। এ যেন ঘোরলাগা মায়াবী চাঁদের হাট! সত্যিই অতুলনীয়।
দেশে গতকাল ঈদের মতো বড় ধরনের একটা উৎসব হয়ে গেল। এই ঐতিহাসিক উৎসবের আমেজ অনেকদিন বিরাজ করবে। খুলনা আমার শ্বশুরবাড়ি। বউ না থাকলেও শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সাথে আমার রিলেশন ভালো। তাঁরা আমাকে ভালোই যত্ন-আত্তির করেন। বিশেষ করে আমার ছোটো শালী রুবিনা তো আমার জন্য পাগল প্রায়। পারলে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাস্তবে তার উল্টোটা। যতোটুকু জানি রুবিনার বয়ফ্রেন্ড আছে। খুব বেশীদূর আগানো যাবে না। এটা জেনে পিছিয়ে এলেও তার সাথে আমার পেছনের অনেক স্মৃতিই আমাকে পুড়িয়েছে। এই রুবিনাকে জড়িয়ে স্নেহা সংসারে কতো অশান্তিই না ঢেকে এনেছে। অথচ শেষমেশ সে নিজেই একটা কাণ্ডজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিলো!
আমি কতোটুকু মন্দ স্বভাবের, এটা আপনাদের জানার কথা নয়। মন্দ না হলে কেন আমার স্ত্রী আমাকে ছেড়ে অন্য পুরুষের হাত ধরে চলে যাবে! তা-ও একদিন দুদিন নয় দীর্ঘ পাঁচ- পাঁচটি বছর। এর মধ্যে আমি কোনো নারীর সান্নিধ্য পাইনি। এটা ভাবা যায়! অথচ স্নেহা বলেছিল আমি নাকি মেয়েমানুষ ছাড়া একটি দিনও চলতে পারবো না। কথাটা মিথ্যা প্রমাণিত হলো।
কতবার ভেবেছি কোনো ফুলটুসির কাছে যাব; অফিস শেষ করে কয়েকটি হোটেলেও গিয়েছি। কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বলতে পারিনি কীভাবে সেক্সপাটনার চাইতে হয়। কাম বানানোর আশায় নিজের সুন্দর একটা ফ্ল্যাট থাকার পরেও সমস্ত রাত হোটেলে কাটিয়েছি। নিদ্রাহীন এপাশ ওপাশ করে করে সকালে টাইমলি অফিস করেছি। না কোথাও নারীসঙ্গ মেলেনি। ভ্রাম্যমাণ পতিতার পেছনেও ঢের ঘুরেছি। তারা একাধিকবার আমাকে আহবানও করেছে। কিন্তু আমার সাহস আর রুচিতে কুলায়নি।
অনেক চেষ্টা করে একজন ডিভোর্সিকে পটিয়েছিলাম। সে আমার অফিস সহকর্মী ফারজানা চুমকি। অবিশ্যি অনেকদূর এগিয়েছিল সে। কিন্তু মাঝপথে এসে হঠাৎ জনমের মতো বেঁকে বসল; আর সোজা হলো না। আমার ফাটা কপালও আর জোড়া লাগল না।
এই যে শুনছেন, আপনি কোথায় যাবেন?
আপনার মর্জি।
মানে?
যেখানে আমাকে নিয়ে যাবেন, আমি সেখানেই যাব!
আমি যদি জাহান্নামে যাই আপনিও কি জাহান্নামে যাবেন?
নিয়ে গেলে যাব।
আজব! কে আপনি?
আমি স্বপ্না।
যাবেন কোথায়?
যদিও বিব্রতকর প্রশ্ন! তবুও বলছি, স্বপ্নপুর যাব।
হেঁয়ালিপনা রাখুন। বাসের সব যাত্রী নেমে গেছে। বাকী শুধু আপনি আর আমি। উঠুন।
হ্যাঁ, চলুন। আমাকে আপনার পছন্দ হয়নি!
পছন্দ হবে না কেন! আপনি তো আগুন সুন্দরী। যে কোনো পুরুষ আপনাকে দেখামাত্র ক্রাশ খাবে।
অন্যসব পুরুষের কথা বাদ দিন। আপনার কথা বলুন!
আমিও।
তাহলে আর এত ভনিতা করছেন কেন! চলুন।
কোথায়?
কোথায় আবার! আপনার জাহান্নামে।
তারপর!
তারপর আপনি ক্ষুধার্ত সিংহের মতো আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বেন। আপনি ভীষণ ক্ষুধার্ত।
বিষয়টা তা নয়।
বিষয়টা তাহলে কি!
গেটের দারোয়ান এবং অন্যান্য ফ্ল্যাটের লোকজনই বা কী ভাববে! তারা তো জানে আমার ওয়াইফ চলে যাওয়ার ঘটনা।
এতকিছু ভাবলে এ জীবনে আর লাইফপাটনার জুটবে না। সমস্ত জীবন কোলবালিশ নিয়ে থাকতে হবে।
আমি বুক খালি করা একটা দীর্ঘশ্বাস রিলিজ করি, আপনি ঠিক বলেছেন।
স্বপ্না হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গিতে আমার হাত ধরে। আমি তার সঙ্গে নিশিপাওয়া মানুষের মতো হাঁটতে থাকি। কিছুদূর হাঁটার পর আমরা একটা সিএনজিতে উঠি। স্বপ্না আমার শরীরে অক্টোপাসের মতো কামড়ে থাকে। আমিও যেন জ্বলে ওঠা মোম। স্বপ্নার ভেতরে জ্বলে জ্বলে গলে যেতে থাকি। স্বপ্নার অবস্থাও আমার মতো। আমি যেন জঙলার হিংস্র পশু। ভীষণ ক্ষুধার্ত আর তৃষ্ণার্ত। অনেক অনেক দিন পর শিকার কাছে পেয়েছি। এ সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করা যাবে না...।
রুবিনা এভাবে আমাকে জাগাত; শ্যালিকা বলে আমি তার গভীরে ডুব দিতে ভয় পেতাম। কিন্তু সে নিজেকে আমার কাছে কতোভাবে যে মেলে ধরত, ওর এপ্রোচ দেখে আমি পাগল হয়ে যেতাম। তবুও নিজেকে কঠিনভাবে সামলে নিতাম। শাসণ করতাম। রুবিনা নাছোড়বান্দা। সে আমাকে পরিপূর্ণভাবে পেতে চায়। আমি তার আবেদন কোনোভাবেই নাকচ করতে পারতাম না। তার আহবানে সাড়া না দিলে অভিমান করে আমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিত। ফোন রিসিভ করত না। কিন্তু তাদের বাসায় গেলে ঠিকই পুনরায় সব অভিমান ভুলে আমার বুকে মুখ গুঁজ তো।
রুবিনা আমার সঙ্গে পালাতে চাইত। প্রায়শই সুইসাইডের ভয় দেখিয়ে খানাপিনা অফ করে দিত। ঘন ঘন বায়না ধরতো। তার আবদার পুরণ করতে না পারলে তার সঙ্গে আমাকে সেক্স করতে বাধ্য করত। কনডম ছিল ওর অপছন্দ। ওর প্রচণ্ড সাহস দেখে আমি ঘাবড়ে যেতাম। কতো রকমভাবে যে ওকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। কে শোনে কার কথা। সবকিছুতে তার ছিল ঘাড়ত্যাড়ামি, ছেলেমিপনা আর মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি। তবুও রুবিনার প্রতি ছিল আমার প্রচণ্ড রকম দুর্বলতা। এই দুর্বলতার কথা ওকে কখনোই বুঝতে দিইনি।
নানান অজুহাতে রুবিনা আমার সঙ্গে সেক্স করার জন্য শুধুমাত্র খুলনা থেকে ঢাকায় উড়ে আসতো। আমি ঢাকা থেকে খুলনায় যেতাম। আমাকে সে যেতে বাধ্য করতো। আমাদের এই বিষয়টি স্নেহা টের পেয়েছিল আরম্ভেই; কিন্তু আমরা সেটা ক্ষুণাক্ষরেও আঁচ করতে পারিনি। স্নেহা যখন আমাদের বেলেল্লাপনা দেখে দেখে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে, ঠিক তখনই সে রুবিনাকে আমার কাছে রেখে কাউকে কিছু না বলে কয়ে চলে যায়। তাকে খুঁজতে কোথাও বাদ রাখিনি। রুবিনা তখন ঢাকায়। আমাদের ফ্ল্যাটে শুধু একজন কাজের বুয়া, রুবিনা আর আমি। বুয়া সন্ধ্যার পরপরই চলে যায়। সেই সুযোগে আমারা নিষিদ্ধজলে গা ভাসাই।
খবর পেয়ে রুবিনার বাবা এসে রুবিনাকে খুলনায় নিয়ে যায়। তারপর থেকে সে আমাকে এভোয়েট করে চলে। আমি ভীষণ একা হয়ে যাই। একাকীত্বের এ এক অসহ্য যন্ত্রণা। এ যন্ত্রণা জ্বলেপুড়ে দগ্ধ হওয়া ছাড়া কারোর সঙ্গে শেয়ার করা যায় না। রুবিনা বয়ফ্রেণ্ডের অজুহাত দেখিয়ে চরম ভাবে বেঁকে বসে। সে আর আগের মতো আমার সঙ্গে মেশে না। অথচ তার বয়ফ্রেণ্ড আগেও ছিল। তখন ভুলেও বয়ফ্রেণ্ডের প্রসঙ্গ ওঠেনি।
রুবিনা কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে এখন ভার্সিটিতে। সে আর আগের সেই রুবিনা নেই। তার ভেতরে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। পালটে গেছে সে। তার সঙ্গে যে আমার আদৌ কোনোকিছু ছিল, এটা বোঝার কোনো উপায় নেই।
রুবিনাদের বাড়িতে যাবো না যাবো না করেও বছরে দু- চারবার যাওয়া পড়ে। গত বছরে শুধু একবার গিয়েছি। আমার শশুরশ্বাশুড়ি খুবই সাদাসিধা মানুষ। আমাকে তাদের বাসায় যেতে বলে। নিয়মিত আমার খোঁজখবর নেয়। আমাকে বিয়ে করে সংসারী হতে বলে।
না, আমাকে দিয়ে আর সংসার হবে না। শুনেছি স্নেহা স্বামী সংসার নিয়ে কানাডায় সুখেই আছে। ওদের সুন্দর একটা বেবী হয়েছে। আমি তিন বছরে ওকে যেটা দিতে পারিনি, সাকিল তাকে এক বছরেই তা দিয়েছে।
না, ওবাড়িতে আর নয়। যে বাড়িতে বউ নেই, সেই বাড়িতে আমার কেউ থাকার কথা নয়। কার টানে আমি ওখানে উন্মাদের মতো ছুটে যাই! কে আছে ওখানে আমার! আমি তো চরম একটা বদমাশ! স্নেহাদের ক্ষতি ছাড়া ভালো কিছু করিনি! ভাগ্যিস স্নেহা আমার বিষয়ে তার বাবা-মাকে কিছুই বলেনি।
স্বপ্না আমার নিশিপাওয়া নিশিপরী। সে ফ্ল্যাট পর্যন্ত গড়ায়নি, বেড তো দূরের কথা। তার আগেই উড়ে গেছে। সিএনজিওয়ালার ভাড়া দিতে গিয়ে দেখি, পকেটে ফোন, মানিব্যাগ কিছুই নেই। মানিব্যাগে হাজার ত্রিশেক টাকা, ক্রেডিটকার্ড আর প্রয়োজনীয় কিছু ভিজিটিং কার্ড ছিল।