জান্নাতুল ফেরদৌসের গল্প ‘বিপত্নীক’

প্রকাশিত : মে ২৭, ২০১৯

মোমিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরল। বাড়ির পাশেই একটি স্কুলে সে শিক্ষকতা করে। ঘরে ঢুকে বিছানায় বসলো। ছাদে বন্ধ ফ্যানটার দিকে তাকালো একবার। ভীষণ গরম পড়েছে আজ। বেশ কিছুক্ষণ এভাবেই বসে থাকলো। পুরো শরীরটা ঘেমে গেছে। কিন্তু কেউ আর ছুটে এসে তাকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিল না। ফ্যানটা চালুও করলো না। বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো মোমিনের। আজ প্রায় দুই মাস হলো জিনিয়া মারা গেছে। তারপর এতগুলো দিন সে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছে জিনিয়াকে।

এ বাড়িতে মোমিনের বড় ভাই-ভাবি ও তাদের দুই মেয়ে থাকে। মোমিনের বাবা বহু আগেই মারা গেছেন। তার মা বৃদ্ধ তবে ভীষণ তেজি স্বভাবের মহিলা। আর আছে মোমিনের একমাত্র ছেলে টগর। টগরের বয়স এখন বারো বছর। বড় ছেলের দুই মেয়ের পর ছোট ছেলের ঘরে টগরের জন্ম। তাই দাদির কাছে তার আদর একটু বেশিই। আর টগরের চাচি রিজিয়া মা মরা ছেলেটাকে নিজের সন্তান তুল্যই ভাবেন। মা মরে যাওয়ার পর প্রথম কয়েকদিন মন মরা থাকলেও টগর এখন একদমই স্বাভাবিক। বরং মা মরা ছেলে বলে সবাই যে তাকে একটু বেশিই মায়া দেখায়, এটা আজকাল উপভোগ করা শুরু করেছে সে।

এভাবেই পার হয়ে গেল আরো একটি মাস। এই কয়টি মাসে জীবনের রং যেন ফিকে হয়ে গেছে মোমিনের। যতক্ষণ পারে সে বাড়ির বাইরে থাকে। বাড়িতে ঢুকলেই একাকিত্ব তাকে পেয়ে বসে। রাতগুলো যেন তাকে শুষে খেয়ে নিচ্ছে। টগর আজকাল দাদির সাথে ঘুমায়। যে বিছানায় তিনটি মানুষ চাপাচাপি করে ঘুমাতো, সে বিছানা আজ শূন্যতায় ভরা। রাত গভীর হয় কিন্তু মোমিনের চোখে ঘুম আসে না। কোলবালিশটা নিয়ে এপাশ ওপাশ করতে থাকে সে। শেষরাতে হালকা তন্দ্রা আসে, কিন্তু ঘুমের কোনো গভীরতা নেই। বিছানাটাতে কাকে যেন হাতড়ে খোঁজে হাতগুলো আনমনে। দিনের বেলাটা নানা কাজে অকাজে কেটে যায়। কিন্তু রাত যেন বিভীষিকাময়। জিনিয়ার মৃত্যুর মাসখানেক বাদে বন্ধু জাকের একদিন বলেছিল, বাড়ি থেকে কী পাত্রী দেখা শুরু করেছে? মোমিন চমকে উঠেছিল। মেজাজটা খারাপ করেই ও বলেছিল, আমাকে তোর কী মনে হয়? আমি আরেকটা বিয়ে করবো? এসব বাজে বিষয়ে আমাকে আর কোনোদিন কিছু বলবি না।

ঘটনাটা বন্ধু সকল জেনেছিল, তাই তারা কেউ আর এ নিয়ে কোন কথাই বলে না। কিন্তু সময় যতই যাচ্ছে ততই সে উপলব্ধি করছে একটা ফাঁকা স্থান। একজন নারীই পারে সে স্থানটি পূরণ করতে। আজকাল কোনো মেয়ে দেখলেই শরীরটা সংকেত দেয় তার চাহিদার। কিন্তু কিশোর বেলার সেই কল্পনাশক্তির প্রয়োগ এখন আর শরীরে তেমন কোনো প্রভাব ফেলে না। মোমিন ভালো করেই বুঝে গেছে, তার একজন জলজ্যান্ত নারী দরকার। তাই বিয়ে করার ব্যাপারে নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো সে। বাড়ির কারো চোখেই যেন পড়ছে না, তার চোখের নিচের কালি, শরীরের রুষ্টতা। বাড়িতে সরাসরি নিজের বিয়ের কথাটা বলতেও লজ্জা ও সংকোচ বোধ করলো সে। অনেক ভেবে মোমিন ঠিক করলো, টগরকে দিয়ে বাড়িতে কথাটা উঠাবে। একদিন বিকালে কয়েকটা চকলেট নিয়ে সে নিজের ঘরে টগরকে ডেকে আনলো।

তুই কেমন আছিস?
টগর চকলেট খেতে খেতে বলল, আমি ভালো আছি।
তোর মায়ের কথা মনে পড়ে না?
হু মনে পড়েতো।
আমিতো বাইরেই থাকি সারাদিন। তোকে দেখাশোনার লোক দরকার। তাই ভাবছি তোর জন্য নতুন মা আনবো।
টগর কিছুটা তেজ দেখিয়েই বলল, আমি ভালো আছি, আমার নতুন মা লাগবে না। এই বলে সে ঘর থেকে ছুটে বের হয়ে গেল।

আশপাশের পরিচিত কেউ মোমিনকে বিয়ের বিষয়ে কিছুই বলে না। বরং সে নিজেই একাকিত্ববোধের গল্প করে। অবশেষে সে ঠিক করলো রাজু ঘটকের সাথে দেখা করবে। কিন্তু কোন মুখে সে দেখা করবে? জিনিয়ার মৃত্যুর কিছুদিন পরেই রাজু ঘটক তার সাথে দেখা করতে এসেছিল। সেদিন সে সরাসরি বিয়ের কথা বলেছিল মোমিনকে। কিন্তু তখনও শোকটা এতই কাঁচা ছিল যে, মোমিন পারলে রাজুকে মাইর দেয়া শুরু করে। রাজু সেদিন কটাক্ষ করেই বলেছিল, শেষ পর্যন্ত এই রাজু ঘটকের কড়া না নেড়ে তোমার আর কোনো গতি হবে না, বুঝলে।

চায়ের দোকানে পাশাপাশি বসে চা পান করছে রাজু ও মোমিন। কি বলে কথা শুরু করবে ভেবে পাচ্ছে না মোমিন। রাজুই নীরবতা ভাঙলো। বলল, কেমন পাত্রি চাও তুমি? বিধবা হলে চলবে?

মোমিন বলল, না অসুবিধা নেই। তবে বয়েসটা একটু কম হলে ভালো হয়।
বুজছি মিয়া। শরমে দেখি তুমি কথায় বলতে পরছো না। পাত্রির সন্ধান নিয়ে সপ্তাহ খানেকের ভিতর আমি তোমার সাথে দেখা করবো ইনশাআল্লাহ।
আমার সাথে দেখা করা লাগবে না। তুমি গিয়ে আমার মার সাথে দেখা করবা। খরচপাতি আমিই দিব।

এর দিন পাঁচেক পরে আসরের নামাজ পড়ে রাজু মোমিনদের উঠানে উপস্থিত হলো। মোমিনের মা হাঁসের বাচ্চাগুলোকে লাঠি দিয়ে তাড়া করে ঘরে ঢোকানোর চেষ্টা করছিলেন। রাজু তাকে সালাম জানালো, আসসালামু আলাইকুম চাচি। মোমিনের মা কিছুটা বিরক্ত গলায় বললেন, অলায়কুম আস সালাম। কী ব্যাপার?

চলেন একটু বসে কথা বলি।
যা বলার বলো। এখানে দাঁড়িয়েই বলো।
চাচি মোমিন ভাইতো… রাজু আর কথা শেষ করতে পারলো না। মোমিনের মা তেড়ে এসে বললেন, আমার ছেলে নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। আমি কি মরে গেছি? এখনই আমার বাড়ি থেকে বের হও। কিছুটা ঠেলেই এবং কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে তিনি রাজুকে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন।

সবকিছু জেনে মোমিন কিছুটা দিশেহারা হয়ে গেল। কিন্তু একটা আশার আলোও আছে। এমনতো হতে পারে মা নিজেই হয়তো তার জন্য মেয়ে খুঁজছেন। এরকম নানাবিধ আশা, শারীরিক আকাঙ্ক্ষা নিয়ে গহীন গভীর আরো কিছু রাত পার হয়ে গেল। বাড়িতে মোমিনের বিয়ে নিয়ে আলাপের আভাসও পাওয়া গেল না। অবশেষে লজ্জার মাথা খেয়ে মোমিন নিজেই একদিন রাতে ভাত খাওয়ার সময় ভাবিকে বলল, শরিফাকে বিয়ে দেও না কেন ভাবি?

শরিফার সাথে মোমিনের আগের একটা ইতিহাস আছে। সুন্দরী বেয়াইন শরিফার প্রতি মোমিনের দুর্বলতা ছিল। কিন্তু দেমাগি শরিফা প্রথমে তাকে পাত্তাই দিত না। কিন্তু ক্রমেই তাদের মাঝে একটা সংযোগ তৈরি হয়। যা গভীর হওয়ার আগেই মোমিনের মায়ের কানে চলে আসে। তিনি আর দেরি করলেন না। জিনিয়ার সাথে মোমিনকে বিয়ে দিয়ে দিলেন। জিনিয়া রূপ ও সাদাসিধে বাধ্যতাবোধে মোমিন খুব দ্রুতই শরিফাকে ভুলে গেল। কিন্তু বর্তমানে মোমিনের জীবনের মরুদ্যানে শরিফা যেন এক পশলা ঝুম বৃষ্টি।

মোমিনের কণ্ঠে এক ধরনের ইঙ্গিত ছিল। রাজিয়া তা বুঝতে পারলেন। কিছুটা চাপা গলায় সে বললেন, তোমার কারণেই আমার বোনটা বিয়ে করল না। এখন তুমি যদি রাজি থাকো তাহলে তোমার ভাইয়ের সাথে আলাপ করে আমি শরিফাকে আনার ব্যাবস্থা করি। মোমিন বলল, আমার আর ভালো লাগে না। তুমিই আমার শেষ ভরসা। কিছু একটা করো।

শরিফা কি সেই আগের মতোই আছে? বয়সতো বেড়ে গেছে। সৌন্দর্যে ভাটা পড়ায় স্বাভাবিক। তবু মোমিনের রাতগুলো শরিফার ভাবনায় কিছুটা রঙিন হলো। কিন্তু আবার শুরু হলো সেই তৃষ্ণাত্ব চাতকের জীবন। মোমিনের জীবনটা ফাঁকা শ্মশান হয়ে গেছে, যেখানে কোকিলতো দূরের কথা, কাকও ফিরে তাকায় না। এর মাঝে খুব সাহস করে দিন চারেক খুব গোপনে পাড়ায় গেল সে। কিন্তু ওসব মেয়ে দিয়ে আর কদিন চলে। আবার কেউ যদি দেখে ফেলে বা জেনে যায় এই চিন্তায়, পাড়াতে গিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় ভোগে সে।

মোমিন ঠিক করলো বেড়াতে যাবে কোথাও। স্কুল থেকে চার দিনের ছুটি নিল সে। তারপর কলেজ জীবনের এক বন্ধুর বাড়ি পাশের জেলায় বেড়াতে গেল। পাঁচ দিন পার হয়ে গেল মোমিনের কোন খবর নেই। বাড়ির লোকেরা ভাবনায় পড়ে গেল। সে কোন ঠিকানাও জানিয়ে যায়নি। যাবার তিন দিন পর থেকে মোবাইলও বন্ধ। ছয়দিনের দিন সকাল বেলা, উঠোনে বসে মাছ কাটছে রিজিয়া। মোমিনের মা বারান্দায় বসে আছে। এমন সময় সদর দরজা ঠেলে মোমিন উঠোনে এসে দাঁড়ালো। তার হাতে নতুন বড় একটা লাল সুটকেস। মোমিন গলা খাঁকারি দিয়ে সদর দরজার দিকে তাকিয়ে বললো, কিগো বাইরে দাঁড়িয়ে আছ কেন? ভিতরে আসো।

দরজা ঠেলে ছিপছিপে লম্বা লাল শাড়ি পরা একটি মেয়ে ঢুকল। লম্বা ঘোমটার কারণে তার চেহারা দেখা যাচ্ছে না। মোমিনের পাশে এসে দাঁড়ালো সে। মোমিন বলল, যাও ভাবিকে ছালাম করো। বউটি তাড়াতাড়ি রিজিয়াকে ছালাম করলো। এবার মোমিনের মাকে সালাম করতে গেল। কিন্তু মোমিনের মা পিছিয়ে গেলেন। এমন সময় ঘর থেকে শরিফা বের হয়ে আসলো। বউটি তাকেও ছালাম করতে গেল। শরিফা তাকে ধরে দাঁড় করিয়ে দিল। এরপর ঘোমটা সরিয়ে মেয়েটির থুতনিতে হাত দিয়ে বললো, বেঁচে থাকো। মোমিন ভাই দেখি অনেক খুঁজে অমাবস্যার চাঁদ ঘরে এনেছে।

অল্পবয়সী লিকলিকে গড়নের শ্যামলা বউটিকে শরিফার পাশে অন্ধকার রাতের আবছায়া মনে হচ্ছিল। বিয়ে করার আনন্দে মোমিনের চেহারায় যে পরিতৃপ্তির ছাপ পড়েছিল শরিফাকে দেখে নিমেষেই তা জানি কোথায় হারিয়ে গেল।