জাতবেতা মিশ্রর গল্প ‘শীতে, বাবার মুখ’
প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০৮, ২০২১
কখনও পুকুরে নারকেলের গুড়ি ফেলা ঘাটে বসে থাকে সে আনমনে। কখনও বড় বটগাছটার ডালে দোল খায় তার আজন্ম শৈশব। কখনোবা দলবেঁধে সবেদা গাছে চড়ে গল্প করে আর সবেদা খেতে খেতে বিচিগুলো এ-ওর গায়ে ছোড়ে আর হেসে গড়িয়ে পড়ে।
ধানক্ষেত ধরে ছুটে যায় শ্যালোমেশিনের হু হু জলে আর ঝাঁপিয়ে চান করে চারদিকে জল ছিটিয়ে। যখনই পাশের বাড়ির মাসিমনির সঙ্গে সেও তাদের মামাবাড়ি যায়, তখনই এমনই জংলি হয়ে ওঠে।
এরপর, ফিরে এসে চট বগলে স্কুলে যায়। টিফিনে পেট ভরে জল খায় অথবা অঙ্গনওয়াড়ির খিচুড়ি। সন্ধে হলেই হ্যারিকেন জ্বালিয়ে পড়তেও বসে রোজ আর তারপরেই হারিয়ে যায়।
পড়ার নেশায় কখন যে আফ্রিকা আর ঠাকুমার ঝুলির ভাব হয়ে যায়। জানলার ঘন অন্ধকারে লেবুপাড়া হাতের পেত্নি ওৎ পেতে থাকে। ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমির সঙ্গে ক্ষীরের পুতুল আর জোয়ান অব আর্কের দেখা হয়ে যায় পথেই।
অথবা ঘোড়ার চড়া রাজকুমার দৌড়ে যায় গোমড়থেরিয়াম শিকারে। একেকটা জোনাকি বাবা ইয়াগার চোখ হয়ে জ্বলে ওঠে। স্বপ্নে দেখে বাবার মুখ, একসাথে বসেছে খেতে গরম ভাত।
এক এক গরাসে বাবা খাওয়ায় তাকে, ঠিক ওই ফুটপাতের বাচ্চাটার মতো। আহ্লাদে আরও খানিকটা বাবার গা ঘেঁষে বসে আর তখনই ঘুম ভাঙে। ঘুম ভেঙে বাবার মুখটা কিছুতেই মনে করতে পারে না আর।
টের পায়, একটা কর্কশ হাত তাকে সন্তর্পণে খুঁজে চলেছে। হাতটা পরিচিত কিন্তু এই স্পর্শটা নয় অথচ এই হাত ধরে সে আর মা গড়ের মাঠে হাওয়া খায় কখনও। কখনও দুপুরে হঠাৎ এসে এই হাত তাকে তেল মাখায়, স্নান করায় । এ হাত তার মায়ের প্রিয় বন্ধুর হাত, যাকে বেড়াতে গেলে বাবা ডাকতে হয়।
অজানা ঠাণ্ডায় কুঁকড়ে ওঠে সে। আর সারা ঘর ভরে যায় বোরোলিনের গন্ধে।
শীত নেমে আসে সিলিং থেকে চুঁইয়ে। বোরোলিন আর ভয় একাকার হয়ে ছড়িয়ে যায় মস্তিস্কে।
ভয় গিলতে গিলতে চোখ বুজে প্রাণপণ বাবার মুখটা মনে করার চেষ্টা করে সে।