‘জাগো হুয়া সাভেরা’ একটি ইতিহাসপর্বের সাক্ষী
ইমতিয়ার শামীমপ্রকাশিত : জানুয়ারি ১৭, ২০১৯
`জাগো হুয়া সাভেরা`র সব পোস্টারই সুন্দর। তবে এই পোস্টারটা আমার বোধহয় একটু বেশি ভালো লাগে। ২০১৬ সালে আবারও তোলপাড় তোলা এই ছবি দেখতে আমার বোধহয় একটু দেরিই হয়ে গেল। তবে এটি সত্যি, দেখার পর এই প্রশ্ন বারবার মনে জাগে, এত ভালো একটি দৃষ্টান্ত থাকার পরও পাকিস্তানের ও বাংলাদেশের সিনেমার মান ক্রমশ এত নিচে নেমেছে কেমন করে!
আখতার জং কারদার পরিচালিত এই ছবিকে মানিক বন্দোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে বলতে আমার অবশ্য দ্বিধা আছে। জেলেদের জীবনকাহিনি, দুই বোনের মধ্যে সংসারীজন শয্যাশায়ী, এমন কিছু বিষয় ছাড়া `পদ্মা নদীর মাঝি`র সঙ্গে এটির কোনো মিল নেই। সিনেমায় মূল উপন্যাসের অনেক কিছুই বিদায় নেয় সত্যি, কিন্তু হোসেনের মতো নিষ্ঠুর অথচ স্বপ্নদ্রষ্টা চরিত্রের অনুপস্থিতির কারণে এটিকে আমি কিছুতেই মানিকের কাহিনি বলতে রাজি নই। মানিকের মৃত্যুর পর এই ছবি হয়েছে। ফয়েজ আহমেদ ফয়েজকে যত কাছেরই মনে করুন না কেন, আমার মনে হয় মানিক জীবিত থাকলে তার উপন্যাসের এই পরিণতি মেনে নিতে পারতেন না।
অবশ্য এই সিনেমা শেষ পর্যন্ত একটি নিজস্ব কাহিনি, নিজস্ব ভাষা তৈরি করে নিয়েছে। মানিকের কাঁধে তার খানিকটা ভাগ চাপানোর সদিচ্ছা কীভাবে জেগেছিল, তা হয়তো নিশ্চয়ই কেউ জানেন। কিন্তু আমার জানা নেই। তবে ২০০৮ সালের দিকে আমি ভিসকোন্তির `লা টেরা ট্রেমা` দেখেছিলাম। সেটিও অনেক আগের ছবি- ১৯৪৮ সালের। এমনই সাদা কালো যুগের। জাগো হুয়া সাভেরা` দেখতে দেখতে সেটির কথাও মনে পড়ল আবার। এক হিসেবে এটি ইতালির সেই বাস্তববাদী ঘরানারই ছবি।
কালের বিবর্তনে `জাগো হুয়া সাভেরা`র নির্মাণশৈলী আর সময়কালই হয়তো এখনকার চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কিন্তু আমার মতো ছা-পোষা দর্শকের কাছে এর পেছনের নানা কাহিনিও কম রোমাঞ্চকর নয়। একটি সিনেমা নির্মাণ করা মানে আমাদের মতো দেশে নাকি মাত্র অর্ধেক কাজ সম্পন্ন করা। বাকি অর্ধেকই হলো এর মুক্তির সংগ্রাম। `জাগো হুয়া সাভেরা`র ক্ষেত্রে তাই ঘটেছে। এ সিনেমার জন্যে জড়ো হয়েছিলেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিখ্যাত অনেকে। কিন্তু এর নির্মাণকাজ শেষ হতে না হতেই ক্ষমতায় এসেছিল সামরিকজান্তা আইয়ুব খান। এর প্রদর্শনী বন্ধ করে দেয়ার জন্যে এই উর্দিপরা ভদ্রলোক কম চেষ্টা করেননি।
ভারতবিভক্তির এক দশক পরে এই ছবিকে কেন্দ্র করে একত্রিত হয়েছিলেন পাকিস্তান ও ভারতের সংস্কৃতিপ্রেমীরা। বিষয়টিকে তিনি মেনে নিতে পারেননি। তাছাড়া তৃপ্তি মিত্র বাম ঘরানার, ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ বাম ঘরানার, জহির রায়হান বাম ঘরানার— এসবও অনেকের কাছে সহ্য হয়নি।
অতএব পাকিস্তানে `জাগো হুয়া সাভেরা` মুক্তির মাত্র তিনদিন আগে বন্ধ হয়ে যায়। লন্ডনে এ ছবির প্রিমিয়ার হয়। আইয়ুব খান পাকিস্তানের হাইকমিশনারকে নির্দেশ দেন অংশ না নিতে। তবে হাইকমিশনার সেই নির্দেশ না মেনে সিনেমাটির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যান, যা ছিল এক বিরল ঘটনা। এমন ঘটনা হয়তো এখনকার কখনোই ঘটবে না।
এ ছবির প্রেক্ষাপট পূর্ববাংলা। মানিকগঞ্জে মেঘনা নদীর তীরে ষাটনল গ্রামের জেলেপল্লীতে এর দৃশ্যধারণ করা হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানে এ ছবি চলবে, এমন চিন্তা মাথায় রেখে নিশ্চয়ই করা হয়নি। তার পরও এই ছবির সংলাপ বাংলার বদলে উর্দু ভাষায় করা ছিল নিঃসন্দেহে একটি ভুল সিদ্ধান্ত।
২০০৭ সালে ফ্রান্স চলচ্চিত্র উৎসবকে সামনে রেখে মাত্র সপ্তাহখানেক আগে উদ্ধার হয় এ ছবির একটি প্রিন্ট। নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে দিয়ে ছবিটি সঠিকভাবে পুনরুদ্ধারের কাজ করেন ছবিটির প্রযোজক নৌমান তাসিরের ছেলে আনজুম তাসির। ২০১৬ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসবে ছবিটি প্রদর্শিত হয়েছে বটে, কিন্তু সেখানে নাকি ছিলেন সাকুল্যে চারজন ভারতীয় সাংবাদিক, কোনো পাকিস্তানি ছিলেন না, বুনুয়েল থিয়েটার হলের অর্ধেকই নাকি ছিল ফাঁকা। বাংলাদেশের কেউ ছিলেন কি না জানা নেই।
`জাগো হুয়া সাভেরা`র গায়ে পাকিস্তানের ছাপ মারা থাকলেও তা নিতান্তই একটি ইতিহাসপর্বের সাক্ষী। আসলে তা বাংলাদেশেরই ছবি। মজার ব্যাপার, ২০১৬ সালে মুম্বাই ফিল্ম উৎসবের সময় সেখানকার বিভিন্ন উগ্রপন্থী সংগঠনের দাবির মুখে ভারত এটি আর প্রদর্শন করেনি। জম্মু-কাশ্মীরে উরি হামলার প্রেক্ষাপটে এসব সংগঠন দাবি করে, এটি পাকিস্তানের ছবি, এটি দেখানো যাবে না। এবং সত্যিই ছবিটি দেখানো হয়নি।
পাকিস্তান দেখায়নি, দেখাতে চায় না এ ছবি। ভারতও দেখাতে রাজি নয়। বাকি এই বাংলাদেশ। যে বাংলাদেশে মানুষ আর প্রেক্ষাগৃহে যায় না। খুব ভদ্দরনোক যারা তারা সিনেপ্লেক্সে যান, ভুট্টাভাজা খেতে খেতে তারা যা দেখেন তা আর যাই হোক `জাগো হুয়া সাভেরা`র মতো কিছু না।
লেখক: কথাসাহিত্যিক