জাকির তালুকদারের কলাম ‘তিনশো কপি বই, উপজেলা ৪৯২টি’

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২৪, ২০২০

প্রথমেই বলে রাখি, লেখাটি আমার ব্যক্তিগত বই সম্পর্কে নয়। দেশের সাহিত্যের ও বইপাঠের করুণ অবস্থা বোঝানোর জন্যই লেখা। ব্যক্তিগতভাবে আমার বইয়ের পাঠকসংখ্যা বেশ বেশিই। আমি যে ধারার লেখক, সেই ধারার পাঠকের সংখ্যা দেশে পাঁচ থেকে ছয় হাজার। কোনো কোনো বই ১২ হাজার পাঠক পর্যন্ত পৌঁছায়। আমার কোনো একক বই হয়তো সেই সংখ্যক পাঠকের কাছে পৌঁছেনি। তবে অন্তত পাঁচ-ছয় হাজার পাঠক আছে, যারা আমার কোনো-না-কোনো বই পড়েছে। আত্মশ্লাঘা প্রকাশের জন্য নয়, কথাটি না লিখলে আমার সেই পাঠকদের অপমান করা হবে ভেবেই উল্লেখটি করা।

১৯৪৬ সালে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন সম্পাদিত মাসিক সাহিত্যপত্রিকা ‘সওগাত’এর ডাকগ্রাহক সংখ্যা ছিল ১৮ হাজার। তারও আগে নাটোরের মহারাজ জগদীন্দ্রনাথ রায় সম্পাদিত মাসিক ‘মানসী ও মর্ম্মবাণী’ পত্রিকার গ্রাহক ছিল সাত হাজার। সেই সময়ের সবচেয়ে প্রভাবশালী সাহিত্যপত্রিকা রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের ‘প্রবাসী’র গ্রাহকসংখ্যা ৩০ হাজারের বেশি। এ থেকে বোঝা যায়, তৎকালে ডিগ্রিধারী বাঙালির সংখ্যা এখনকার তুলনায় অনেক কম থাকলেও তারা নিজেদের সাহিত্য সম্পর্কে, বাঙালির চিন্তাচর্চা সম্পর্কে, অবহিত থাকার চেষ্টা করতেন। ডিগ্রি লাভের মধ্য দিয়ে পড়াশোনায় ফুলস্টপ টানার প্রবণতা তখন ছিল না। সেই কারণেই সারা বাংলায় একটি সারস্বত শ্রেণি গড়ে উঠতে পেরেছিল। ডিগ্রি নিয়েই এখন যেমন সবাই ঢাকায় ছুটে আসে, সেই সময় তার উল্টোটা ঘটেছে অনেক।

কলকাতা থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে নিজ নিজ এলাকায় ফিরে ওকালতি, ডাক্তারি ও শিক্ষকতায় মনোনিবেশ করার পাশাপাশি তারা স্থাপন করতেন ক্লাব, পাঠাগার, সমবায় সমিতি, ব্যায়ামাগার, সমাজকল্যাণমূলক সংগঠন। তবে সকল কাজের সাথে পড়াশোনাটাকে বাধ্যতামূলক রেখেছিলেন তারা নিজেদের ও সঙ্গীদের জীবনে। যিনি বেশি পাঠ করতেন, সন্ধ্যায় বা দিনের যে কোনো অবসরে তার পাশে ভিড় জমাতেন অন্যরা। পাঠকের মুখে শুনতেন সদ্য পঠিত বইটির আলোচনা, সারাৎসার। বই এবং পত্রপত্রিকার বিনিময় হতো। এই কাজগুলি তারা করতেন কেবলমাত্র পাঠের আনন্দের জন্য নয়, করতেন একধরনের দেশপ্রেম থেকেও। প্রথমে ব্রিটিশবিরোধী ‘স্বদেশী’ বিপ্লবীরা এই কাজের সূত্রপাত ঘটান। পরবর্তীতে কংগ্রেস কর্মীরা। তাদের দেখাদেখি মুসলিম লীগ নেতারাও অন্তত নিজেদের সম্প্রদায়কে পিছিয়ে পড়তে না দেয়ার ইচ্ছায় এইরকম কাজ শুরু করেছিলেন। পরে এসব ক্ষেত্রে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন কমিউনিস্টরা। ১৯৫৪ সালের পরে তৎকালীন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা এই ধরনের কাজে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন।

তখন পর্যন্ত উন্নয়নের প্রধান সংজ্ঞা ছিল ‘মানুষের মননের উন্নয়ন’। যে সংজ্ঞাটি পুরোপুরি পরিবর্তিত হয়ে গেছে আমাদের স্বাধীনতালাভের পরে। এখন উন্নয়ন মানে হচ্ছে, কোনো খালি মাঠ দেখলেই সেখানে একটি বহুতল দালান তোলা। যার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি। বই পড়া যে মানবিক উন্নয়নের প্রধানতম শর্ত, তা আমাদের স্বাধীনতা-পরবর্তী কোনো সরকারেরই বিবেচ্য ছিল না। এখনো নয়। বরং পাঠবিমুখ একটি ভোঁতা জাতি গড়ে তুলতে পারলে মূর্খ রাজনীতিবিদ এবং ডিগ্রিধারী অশিক্ষিত আমলা ও টেকনোক্র্যাটদের পক্ষে ইচ্ছামতো দেশ পরিচালনা করা, দেশের সম্পদ নয়-ছয় করা, দেশের স্বার্থ বিকিয়ে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করা অনেক সহজ হয়।

আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা একটি ছোট্ট মফস্বল শহরে। আমাদের মহল্লাতেই দুটি বড় স্কুল। সেই দুই স্কুলের বেশ কয়েকজন শিক্ষককে দেখতাম আমাদের পাড়ার চায়ের দোকানে বসে খবরে কাগজের উপসম্পাদকীয় পড়ছেন, শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করছেন। এখন বুঝি তারা সময়ের চাইতে এগিয়ে থাকা মানুষই ছিলেন। তারা রবীন্দ্রনাথ, শেক্সপিয়ার পড়েছেন, সৈয়দ মুজতবা আলী পড়েছেন, রাজনীতিবিদদের আত্মজীবনী পড়েছেন। এমনকী শামসুর রাহমানের কবিতাও পড়তেন। অথচ শিক্ষকতা করতেন স্কুলে। এখন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেশিরভাগই পরশুরামের নাম শুনলে গরুর চোখে চেয়ে থাকেন। সেই শিক্ষকরা স্কুলের লাইব্রেরির দরজা খুলতেন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে, ছেলেমেয়েদের বই পড়তে উদ্বুদ্ধ করতেন, অনেক সময় জোরও করতেন। এখন তো স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা প্রাইভেট পড়ানো ছাড়া আর কোনো কাজের সময় পান না।

ছোটবেলায় যার বই পড়ার সূচনা হয় না, পূর্ণ বয়সে এসে সে কোনোদিন পাঠক হতে পারে না। বাপ-মায়েরা সন্তানের হাতে ‘আউট বই’ দেখলেই খেঁকিয়ে ওঠে। তাদের ভয়, এইসব বই সন্তানের জিপিএ-৫ পাওয়াকে ব্যাহত করবে। শিশু-কিশোর সংগঠনগুলোতে সাপ্তাহিক আসরে কিশোরদের উপস্থিতি নেই। তারা তখন কোচিং ক্লাসে। বই বিক্রির কথা আমি বলছি না। বলছি বই পড়ার কথা। বই তো নানাভাবে বিক্রি হয়। সরকার একটা বাজেট দেয়। যাদের ওপর বই বাছাইয়ের দায়িত্ব তারা নিজেদের পরিচিত লোকদের বই কিনে তাদের হাতে হয়তো লক্ষ টাকার চেক তুলে দিতে পারে। কোনো কোনো নামগেত্রহীন লেখকের তিন কোটি টাকার বই কেনে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। তাদের জন্য করুণা। সরকারি কেনা বই পড়ে থাকে কোনো মালগুদামের এক কোণে।

নব্বই দশকের শুরু পর্যন্ত বই পড়ার অলিখিত বাধ্যবাধ্যকতা ছিল প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনের কর্মী-সদস্যদের জন্য। শুধু রাজনৈতিক বই নয়, সাংগঠনিক বই নয়, সাহিত্যও ছিল তাদের পাঠচক্রের সিলেবাসে। এখন তো এসব রূপকথার মতো শোনায়। মননের উন্নয়নের বা প্রকৃত উন্নয়নের উপায় কী? উপায়, পরিবর্তন। স্বাধীনতার পর থেকে যে পদ্ধতিতে চলছে সরকার, যেভাবে ভোঁতা করা হচ্ছে জনগণের মননকে ও চিন্তাশক্তিকে, যেভাবে উন্নয়নের সংজ্ঞা সীমাবদ্ধ করা হয়েছে কেবলমাত্র অবকাঠামো নির্মাণের মধ্যে— সেই আত্মঘাতী পদ্ধতির পরিবর্তন। পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন এই পদ্ধতি সম্পর্কে মানুষকে সম্যক ধারণা দান। কাজটি শুরু করতে হবে তৃণমূল থেকে এবং দেশজুড়ে। খুব কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ পথ। তবে তার বিকল্প তো কিছু দেখি না।

লেখক: কথাসাহিত্যিক