জনদলন
অমিতাভ পালপ্রকাশিত : জুলাই ০২, ২০১৮
হঠাৎ বৃষ্টি নামার মতো রটে গেল খবরটা। একদল লোকের নাকি অচেনা একটা ভাইরাসের সংক্রমণ হয়েছে। এখন তারা যাকে সামনে পাচ্ছে, তারই ঘাড় কামড়ে ধরে শরীর থেকে নিচ্ছে মাংস, শিরা থেকে রক্ত আর পকেট থেকে টাকা-পয়সা।
খবরটা রটার সাথেসাথে পিছু ধেয়ে এলো আতঙ্ক। সবাই তাকাতে লাগলো তার পাশের লোকটার দিকে, পরীক্ষা করে দেখতে চাইলো সংক্রমণ হয়েছে কীনা— তারপর পরস্পরের কাছ থেকে সরে যেতে থাকলো দূরে, বহুদূরে যাতে সংক্রমণ কোনোভাবেই নাগাল না পায়।
এখন সবার ভিতরে অবিশ্বাস, ভয় আর সন্দেহ। এখন সবাই একা। কেবল কেবল টিভির সঙ্গেই তাদের যাকিছু ঘনিষ্ঠতা— সেটাও সংক্রমণের সাম্প্রতিক খবর পাওয়ার জন্য আর যৌবনভরা শরীরের মেয়েদের নাচগান দেখে দুঃসহ সময়টাকে কিছুটা ভুলে থাকার জন্য।
কিন্তু কিছুদিন পরেই চারপাশের অবস্থা এমন আড়ষ্ট হয়ে উঠলো যে, সবারই মনে হতে থাকলো, সে আর তার ঘরের নিরাপত্তা বেষ্টনির মধ্যে নেই। অন্য সবার সঙ্গে পরস্পরের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে একটা খোলা রাস্তায়। কাদায় কোমর ডুবিয়ে। আতঙ্ক আবার ছড়ালো ভয়াবহভাবে। অস্তিত্বের ভিতরে ঢুকে গেল একটা হিমশীতল ভয়ের স্রোত আর এই ভয়ের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে সবাই আবার বের হয়ে এলো ঘরের গুহা থেকে। অন্যের মুখ, সূর্যের আলোর উত্তাপ আর চায়ের দোকানের গাদাগাদি করা ঘনিষ্ঠতা ভরসা যোগালো তাদের এবং ঘরে থাকতে থাকতে ফ্যাকাশে হয়ে পড়া চিন্তাভাবনাগুলি আবার বাদামি ও পুষ্ট হতে শুরু করলো।
এবার সবাই ভাবলো দূরে গিয়ে না বরং সম্মিলিতভাবে মুখামুখি হতে হবে এই আতঙ্কের। তবে তার জন্য চাই এমন কোনো কিছুর সহায়তা যা তাদের দেবে আইনের সমর্থন এবং আক্রমণের শক্তি। আর এই সহায়তার কথা ভাবতে গিয়ে প্রথমেই তাদের মনে পড়লো পুলিশের কথা এবং সেইমতো তারা প্রতিনিধি পাঠালো স্থানীয় থানায়। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কয়েকজন উত্তেজিত লোককে তার কাছে আসতে দেখে প্রথমে ঠিক ঠাহর করতে পারলো না ব্যাপারটা কি। তারপর যখন শ্রবণেন্দ্রিয়ের জালে ধরা পড়া উত্তেজিত কণ্ঠস্বরগুলির ভিতর থেকে পাকা রুইয়ের মতো প্রধান শব্দগুলিকে বেছে নিতে পারলো সে, তখন ব্যাপারটা ধরতে পারলো। কিন্তু জনকল্যাণের সুযোগ পেয়েও খুব একটা আগ্রহ দেখালো না। কেননা সেও ছিল সংক্রমণে আক্রান্ত হওয়াদের একজন। সেও মানুষের ঘাড় কামড়ে ধরে, শরীর থেকে মাংস, শিরা থেকে রক্ত আর পকেট থেকে টাকা-পয়সা নিতে ভালোবাসে।
প্রথমে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ভেবেছিল উত্তেজিত মানুষগুলিকে কিছু একটা বলে বিদায় করে দেবে। কিন্তু হঠাৎ সে বুঝতে পারলো এই লোকগুলি তাকে পর্যাপ্ত রক্ত, মাংস এবং টাকা-পয়সা দিতে পারবে। শুধু লোকগুলিকে একটা বদ্ধভূমিতে নিয়ে ফেলতে পারলেই হয়। তখন তার নিজেরও যেমন পেট ভরবে, সংক্রমিত হওয়া বাকিরাও পাবে নিজেদের তৃপ্ত করার সুযোগ। এখন একটা বধ্যভূমি ঠিক করে সংক্রমিতদের জানাতে হবে এবং উত্তেজিত লোকগুলিকে কিছু বুঝতে না দিয়ে সেখানে নিয়ে যেতে হবে। তারপরই কেল্লা ফতে।
হঠাৎ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার মনে হলো, তার থানার হাজতটাই হতে পারে সবচেয়ে ভালো বধ্যভূমি। এখানেই উত্তেজিত লোকগুলির শরীর থেকে মাংস, শিরা থেকে রক্ত এবং পকেট থেকে টাকা-পয়সা ভালোভাবেই আদায় করা যাবে। আর অন্য সংক্রমিতদেরও থানায় আসতে সুবিধাই হবে। কেননা শিকারের ভাগ নিতে তারা তো নিয়মিতই এখানে আসে।
সেই রাতে থানায় চললো মহোৎসব। মাংস রক্তের গন্ধ আর টাকা পয়সার ঝনঝনানিতে বিতাড়িত হলো রাতের নিস্তব্ধতা। সকালে দেখা গেল, উত্তেজিত প্রতিনিধিদের দলটাও সংক্রমিত হয়ে গেছে। এখন তারাও খুঁজছে কারো ঘাড় কামড়ে দেবার জন্য, শরীর থেকে মাংস, শিরা থেকে রক্ত এবং পকেট থেকে টাকা-পয়সা নেবার জন্য। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ভাবলো, এটাই সুযোগ। এদের দিয়েই এদের দলের বাকি লোকগুলিকে ঘায়েল করতে হবে।
দুই.
প্রতিনিধিদের থানায় পাঠিয়ে মনমরা হয়ে বসেছিল বাকি লোকগুলি। চায়ের কাপে ঠাণ্ডা হচ্ছিল গরম চা। একটা রাত কেটে গেছে অথচ প্রতিনিধিরা কেউই ফিরছে না, চিন্তাতো হবেই। কিন্তু এরচেয়েও বেশি দুঃশ্চিন্তায় ভুগলো প্রতিনিধিদের পরিবারের লোকেরা। তারা সারারাত ঘুমাতে পারেনি, কিছুটা ঝিমিয়েছে হয়তো কিন্তু সামান্য শব্দেই ধড়মড় করে উঠে বসেছে। আশা নিয়ে দরজা খুলেছে এবং হতাশ হয়ে আবার ফিরে এসেছে নিজের জায়গায়। এখন এই সকালে বাকিদের সঙ্গে বসে তারা আলোচনা করে খোঁজার চেষ্টা করছে, কেন প্রতিনিধিরা এতে দেরি করছে। অথচ থানায় লোক পাঠালেই হয়তো জানা যেত দেরির কারণ, কিন্তু আগের দল না ফেরায় ভরসা করে যেতেও পারছে না কেউ। বড় সাধারণ মানুষ এরা!
হঠাৎ একটা বাচ্চা চিৎকার করে জানালো প্রতিনিধিদের ফেরার খবর। চিৎকারটা শুনেই সবাই যে যার জায়গা থেকে লাফিয়ে উঠে জড়ো হলো রাস্তায় এবং তাকিয়ে দেখলো দূরের প্রতিনিধিদের দলটাকে। তাদের হেঁটে আসার দৃশ্যে রাত জাগার ক্লান্তি সামঞ্জস্যে ভরা রঙের মতো মিশে আছে। তবে এই ক্লান্তি কোনো প্রভাব ফেলতে পারলো না বাকিদের মনে। কারণ তারা ফিরে পেয়েছে স্বজন, খুঁজে পেয়েছে সংক্রমণের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর আশা আর নিজেদের হারিয়ে যাওয়া শক্তি ও উদ্যম।
প্রতিনিধিদল ফিরে এসে সবাইকে জানালো, পুলিশ নিশ্চয়তা দিয়েছে সংক্রমণ তাদের এলাকায় ঢুকবে না এবং সেই নিশ্চয়তা পরীক্ষা করার জন্যই তাদের খরচ হয়েছে পুরা একটা রাত। কেউ কেউ অবশ্য সন্দেহ করলো পুলিশের নিশ্চয়তার ঘনত্ব নিয়ে। তবে ভরসার সুশীতল বাতাসের ঝাপটায় মুগ্ধ বাকিরা পাত্তাই দিল না সন্দেহের মেঘের ডাককে।
তিন.
দিন আবার রমরমিয়ে চলছে। দুঃশ্চিন্তা লজ্জায় মুখ লুকিয়েছে কোথায় যেন। ছেলেপিলেরা হয়তো মাঠঘাটে খেলতে গিয়ে তার গর্ত খুঁজে পাবে কিন্তু বড়দের কি সেই সময় আছে? ফলে দুঃশ্চিন্তাকে নিয়ে আর মাথা ঘামালো না কেউই বরং জীবনের দৈনন্দিনতায় ডুবে গেল আপাদমস্তক। এখন সংক্রমণ যেন স্বপ্ন, কোনো এক ভোররাতে দেখা দিয়ে যে মিলিয়ে গেছে দিনের আলোর অসম্ভব উজ্জ্বলতার সাথে পাল্লা দিতে না পেরে।
এইসময় হঠাৎ একদিন সকালে দেখা গেল, বাকিদের দলের একজনের মৃতদেহ পড়ে আছে রাস্তায়। তার ঘাড়ে কামড়ের চিহ্ন, শরীরের বিভিন্ন জায়গা থেকে মাংস উধাও, শিরা রক্তহীন ফ্যাকাশে আর পকেটে কোনো টাকা-পয়সা নেই। ঘটনাটা কাঁপিয়ে দিল বাকিদের দলটাকে। তারা দৌড়ে গেল প্রতিনিধিদের কাছে এবং গিয়ে দেখলো, প্রতিনিধিরা রক্ত, মাংস এবং টাকা-পয়সা ভাগ বাটোয়ারা করছে এবং হাসছে। ভয়াবহ এই দৃশ্য বাকিদের দলে তৈরি করলো এক হুলুস্থুল অস্থিরতা এবং সবাই পালিয়ে যেতে চাইলো এমন কোনো নিরাপত্তার ঘেরাটোপে, যেখানে সব ঝড় এসে থমকে দাঁড়ায়, সব দাঁত নখ হেরে যায় সীমাহীন কঠোরতার কাছে। কিন্তু এমন জায়গা কি আদৌ আছে?
নেই যে সেটা বোঝা গেল প্রতিনিধিরা তাদের দিকে আসা শুরু করতেই। আতঙ্কিত বাকিরা দিকবিদিক ছোটা শুরু করতেই টের পেলে, তাদের আসলে কোনো যাবার জায়গা নেই। আবহমান কাল থেকে এই অঞ্চলে তারা আছে, পায়ের নিচে গজিয়ে গেছে মোটা ও গভীর শিকড় আর চারপাশ তাদের টানছে পরম আত্মীয়ের মতো। তারা টের পেলে, এই অঞ্চল আসলে তাদের জেলখানা আর তারা যাবজ্জীবনের দণ্ডে দণ্ডিত। এদিকে প্রতিনিধিরা এসে পড়েছে নাগালের মধ্যে। এখন মাংস, রক্ত আর টাকা পয়সা দিয়ে দিতেই হবে।
হঠাৎ এক তরুণ চিৎকার করে উঠলো বিপ্লবীদের স্লোগানের ভঙ্গিতে। বাকিদের সে জানাতে চাইলো নিজেদের সংখ্যাধিক্যের কথা। সেইসাথে এটাও জানালো যে, দলভারিরা নানান সুবিধা পায়, যদি তারা চায়। এখন শুধু প্রতিনিধিদের ধরে ফেলতে হবে এবং তাদের আটকে রেখে জানতে হবে সংক্রমণের কারণ আর সেইমতো করতে হবে চিকিৎসা। অধিকাংশ বাকিরা অবশ্য তার কথাকে উড়িয়ে দিল গুজবের মতো, কিন্তু কয়েকজন, তারা কেউ তরুণের বন্ধু, কেউ নিষ্পেষিত হতে হতে দিশাহারা কিংবা কেঊ হয়তো রোমান্চিত, মরিয়া এবং এই কেউরা প্রতিনিধিদের চেয়ে দলে ভারি। তারা দাঁড়িয়ে পড়লো তরুণের পাশে এবং তরুণকে ভরসা দিল এগিয়ে যাবার। আর এসব কিছুতে সাহস পাওয়া তরুণ মিত্রদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ধরে ফেললো প্রতিনিধিদের এবং বেঁধে গুদামজাতও করে ফেললো। অবশ্য এতে তাকে ঝক্কি পোহাতে হয়েছে অনেক কারণ দূরে সরে থাকা বাকিদের দাবি ছিল গণপিটুনীতে এদের হত্যা করার। কিন্তু বিজ্ঞানের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট তরুণতো মানবিক ও যুক্তিসঙ্গত, তাই প্রতিনিধিদের শরীরে আঁচড়টিও পড়লো না।
বিজ্ঞানমনস্ক তরুণটি এরপর উদ্যোগ নিল প্রতিনিধিদের রক্ত পরীক্ষার। সেইমতো তাদের প্রত্যেকের শরীর থেকে নেয়া হলো রক্ত এবং পাঠানো হলো পরীক্ষাগারে। এবার রিপোর্টের অপেক্ষা।
চার.
রিপোর্ট এসে গেছে। আর তাতে স্পষ্ট ভাষায় লেখা, প্রতিনিধিদের রক্ত পাওয়া গেছে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের তৈরি করা ভাইরাস, যা একজন সুস্থ ও সবল মানুষকে করে তোলে রক্ত-মাংস-টাকা পয়সা লোলুপ এমন এক জন্তুতে, যে নিজের সমস্ত পরিচয় ভুলে যায়। আর তারা হয়ে পড়ে ধনী, মোটা এবং ধমক দিয়ে কাজ আদায়ের অধিকারী।
ব্যাপারটা বেশ ভাবালো বাকিদের দলটাকে। নিজেদের নিরাপত্তাহীন নড়বড়ে জীবনটা আরো বেশি করে সামনে মেলে ধরলো ওই রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট। আর তাতে টলমল করতে করতে সবাই একসময় সিদ্ধান্ত নিল, এই ভাইরাস তাদের শরীরেও চাই। তারাও হতে চায় রক্ত, মাংস ও টাকা-পয়সার মহোৎসবে নিমন্ত্রিত এবং ধনী, মোটা ও ধমক দিয়ে কাজ আদায়ের অধিকারী। বাকিদের এই দলে বিজ্ঞানমনস্ক তরুণও ভিরে গিয়েছিল কীভাবে যেন।
পাঁচ.
এখন সবাই সবার ঘাড় কামড়ে ধরছে, শরীর থেকে খুবলে নিচ্ছে মাংস, শিরা থেকে রক্ত আর পকেট থেকে টাকা পয়সা। কারো কোন আতঙ্ক বা নালিশ নেই।