করোনা ভাইরাসের জীবাণু

করোনা ভাইরাসের জীবাণু

জঙ্গিবাদ সীমা বোঝে, মহামারি অতসব বোঝে না

শিমুল বাশার

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০৬, ২০২০

জঙ্গিবাদ তবু সীমা বোঝে, মহামারি কিন্তু অতসব বোঝে না। জঙ্গি নিয়ন্ত্রণে যদি আন্তর্জাতিক বাহিনীর দরকার হয় তবে এই মুহূর্তে রোগ নিয়ন্ত্রণে আন্তর্জাতিক ঐক্যের খুব প্রয়োজন। কোনো একটা দেশে যখন সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে তখন সে দেশটাকে `একঘরে` করে রাখার নীতি দিয়ে প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার সাথেও এ নীতি  সঙ্গতিপূর্ণ নয়। বিশ্ব যখন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে কারণে-অকারণে গ্লোবালাইজেশনকেই নানাভাবে প্যাম্পার করে চলছে, তখন একটি দেশকে সংক্রামক রোগ ছড়াচ্ছে বলে একঘরে করে রেখে দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া হিউম্যানকাইন্ডের সাথে যায় না।

দ্য ব্ল্যাক ডেথের নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই, অনেকে বলেন `গ্রেট প্লেগ।` ১৩৩৪ সালে চীনে এ রোগটির প্রাদুর্ভাব ঘটে। পরে সে সময়ের বাণিজ্যিক রুট ধরে কনস্ট্যান্টিনপোলসহ গোটা ইউরোপে এ রোগটি ছড়িয়ে যায়। বলা হয়, ইউরেশিয়ার ৬০ শতাংশ মানুষ প্লেগে আক্রান্ত হয়ে সে সময়টাতে মারা যায়। ওই মহামারিতে অনেক বড় বড় শহর পৃথিবীর ইতিহাস থেকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। আমাদের এক সময়ের হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো সভ্যতা ধ্বংসের সাথে এমন রোগের সম্পৃক্ততা একেবারেই যে নেই, সেটা কিন্তু ইতিহাস কিন্তু নিশ্চিত করে বলে যায়নি। তবে চীনের গ্রেট ওয়ালের সাথে এমন সংক্রামক রোগের সম্পৃক্ততার বহু রেফারেন্স পাওয়া যায়।

বেইজিং ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির এক গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, প্রস্তুর যুগের চীনে অর্থাৎ যিশু খ্রিস্টের জন্মেরও ২৫৬ বছর আগে `জো` ডাইনেস্টতে এমন ১৭টা মহামারি রোগের ঘটনা ঘটে, এমনকি সবশেষ `কিইং` ডাইনেস্টির (১৬৪৪-১৯১১) সময়ে ২১৭টি মহামারির ঘটনা ঘটে, যারমধ্যে ১২৭টা মহামারি চরম আকার ধারণ করে। সব মিলিয়ে শুধু চীনের ইতিহাসেই এমন মহামারির সংখ্যা ৭৫৩টি। ১৯৪৯ সালের পর নয়া চীন তাদের রোগ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আনে। তাতে ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া ও স্মল পক্সসহ ভাইরাস জনিত রোগ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে সেই প্রাচীনকাল থেকেই বছরের পর বছর কিছু রোগের জীবাণু পৃথিবীতে সক্রিয় রয়ে যায়।

যেমন, থার্ড প্লেগ বা মর্ডান প্লেগ চীনে ১৮৫৫ সাল থেকে পরবর্তী ২০ বছর ধরে হংকংয়ের বন্দরগুলোতে ছড়াতে থাকে ইঁদুরের মাধ্যমে। শুধু চীন নয়, প্রাচীন গ্রীসের ইতিহাসেও সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ইতিহাসে রয়েছে। ভারতে ১৮৫২ সালে থার্ড কলেরা প্যানডেমিক বর্ডার ক্রস করে গেলে শুধু এক গ্রেট ব্রিটেনেই তখন মারা যায় ২৩ হাজার মানুষ আর রাশিয়াতে মারা যায় প্রায় ১০ লাখ।

বিশ্ব যখন এমনই এক ভয়াবহ ভাইরাসের মুখোমুখি, তখন আমার কিছু বন্ধু চীনে অবস্থান করছে। প্রতিরাতে আমার তাদের কথা মনে পড়ে। তাদের কথাবার্তায় আমার দমবন্ধ হয়ে আসে। আমি বুঝি, তারা দেশে ফেরা আর না ফেরার দোলাচলে জীবনটাকে এই মুহূর্তে ঝুলিয়ে রেখে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কথা বলছে। অনেকে আবার দেশে আসতে চাচ্ছে না। কারণ দেশে রোগটা ছড়িয়ে যাক, তা তারা চায় না। আবার এমন বিপদের দিনে আপন মানুষদের কাছে পাবার ইচ্ছাটাও তাদের মনের গহীনে জাগ্রত। অনেকে দেশে ফেরত আসার পর কি পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হবে, এ নিয়ে ভয়ঙ্কর শঙ্কায় আছে।

এ অবস্থায় আজ দেখলাম এক বন্ধু ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছে। একটি করোনা গাড়ির ছবি তুলে আপ করে পোস্ট টাইটেলে লিখেছে, “আমি এর পিছনে, আমার কি এখন মাস্ক পড়া উচিত?” এই রসিকতাটা আপনার রসবোধের কতটা পরিচয় দিচ্ছে আর কতটা নির্বোধের পরিচয় দিচ্ছে, এই বিবেচনা আপনার কাছেই থাক। মাত্র কিছুদিন আগের ঘটনা। আমার এক বন্ধু তার প্রিয়তম শিশুকে ডেঙ্গুর কাছে হেরে যেতে দেখেছে। হাসপাতালের বেডেও তার জায়গা হয় নাই। মেঝেতেই কোলের কাছে মারা গেছে তার আদরের শিশুটা। সেই কান্না আপনাকে কোনোদিন ছুঁতে না পারুক, এ কামনাই করছি। তবে সময় এসেছে ইন্টারন্যাশনাল হেলথ রেগুলেসন্স ইমার্জেন্সি কমিটিকে ক্ষমতায়িত করার। এ দায়িত্ব বিশ্ব নেতৃত্বের।

আজকের দিনের এ সুন্দর পৃথিবীটা আমাদেরই। এখানে আরো কিছুদিন সবাই ভালো থাকুন। পৃথিবীতে বেঁচে থাকুন হাসি আর আনন্দে।

লেখক: গল্পকার ও গণমাধ্যমকর্মী