জগলুল আাসাদের কলাম ‘দুর্যোগ ও মহামারি কিয়ামতের আলামত’

প্রকাশিত : মার্চ ৩১, ২০২০

মুমিনদের তো হওয়া উচিত ছিল, একটি প্রস্তুত জনগোষ্ঠী থাকা। যারা সব সময় ভবিষ্যতের বিপর্যয়ের জন্যে প্রস্তুত থাকবে। আজ আমরা এক অপ্রস্তুত ও হতবিহ্বল জাতি। মুসলিদের তো ভবিষতের দোযখের শাস্তির ভয়ে আর বেহেস্তের পুরস্কারের জন্যে ‘বর্তমান’ বা ‘উপস্থিত সময়’কে কাজে লাগানোর কথা, পৃথিবীকে সে অনুসারে আবাদ করার কথা। নবিজী (সা.) ভবিষ্যতের অনেক খবর আমাদের জানিয়েছেন তো এই জন্যেই যে, আমরা যেন ব্যক্তিগতভাবে, জাতিগতভাবে ও উম্মাহগতভাবে প্রস্তুতি নেই, প্রস্তুত থাকি।

`ইলমুল গায়েব` শুধু আল্লাহ সুবহানাতায়ালার আছে, আর নবির (সা.) ছিল `খবরুল গায়েব`। নবির কাছে দেয়া ছিল স্রষ্টার পক্ষ থেকে অদৃশ্যের খবর। সেই অদৃশ্যের খবর দেয়ার উদ্দেশ্য মানুষকে প্রস্তুত রাখা বা সে অনুযায়ী প্রস্তুতির দিশা দেয়া, হতাশ না হওয়া ইত্যাদি। সাহাবারা ও আগের সৎ মানুষদের একটা অভ্যাস ছিল কিয়ামত নিয়ে আলোচনা করা; কিয়ামতকে সন্নিকটে ভাবাই ছিল তাদের আকিদা। কিয়ামতকে সূদূর ভেবে গাফেল থাকা ইসলামের শিক্ষা ছিল না কখনো। আল্লাহপাক কেয়ামতের দিনক্ষণ কাউকে জানাননি, কিন্তু নবির মাধ্যমে আমাদের জানিয়েছেন কেয়মতের ছোট ও বড় আলামত।

ধীরে ধীরে মানবপ্রজাতি এগিয়ে যাচ্ছে সেই বৃহত্তম ঘটনার দিকে। মহামারি, নানা দুর্যোগ ও বিপর্যয়কে কেয়ামতের আলামত হিসেবেও হাজির করা হয়েছে হাদিসে। তাছাড়া মৃত্যুও তো ব্যক্তির জন্যে এক প্রকার কেয়ামতই। এছাড়াও আছে একটা প্রজন্মের কেয়ামত ও উম্মাহর কেয়ামত। ব্যক্তির গড় আয়ু ৬০-৬৫ বছর। একটা প্রজন্মের আয়ুও তো প্রায় শতবর্ষ, আর কোনও উম্মাহর সমাপ্তি ঘটে হাজারখানেক বছরেই। সেই মহাবিপর্যয়ের অন্তিম সময়টুকু অজানা। তা শুধু আল্লাহতায়ালা জানেন। অনেক ঘটনাক্রম শেষে এক হঠাৎ আকস্মিকতায় তা আসবে!

ভবিষ্যতের পৃথিবী কেমন হবে তা নিয়ে রাজনৈতিক, দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ, বিজ্ঞানী ও পরিসংখ্যানবিদদের অনেক কথা আছে। এগুলোর অন্যতম লক্ষ্য মানুষকে সতর্ক করা, প্রস্তুত করা। মুমিনদেরকেও প্রস্তুত থাকতে হবে। আগামীদিন কী কী সমস্যার জন্ম হতে পারে সেগুলো ভেবে ফিকাহ তৈরি করতে হবে, নবির দিক-নির্দেশনার সংকলন করতে হবে, সে অনুসারে ধর্মীয় ও জাগতিক প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা নিতে হবে। সামনে হয়তো পরিবেশ বিপর্যয় আসবে। সেসব নিয়ে দ্বীনি বুঝ ও জাগতিক পরিকল্পনা ও জ্ঞান দরকার হবে। প্রকাশনা প্রয়োজন হবে। বাংলাদেশে আমাদের ধর্মীয় নেতৃত্ব যারা দেন, তারা কেমন প্রস্তুত বিভিন্ন প্রেক্ষিতে, তা অবলোকন করা যায়।

এই প্রস্তুতিকে আরো জোড়ালো করতে হবে। জাগতিক বিভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের সাথে আলেমদের যোগাযোগ বাড়াতে হবে। ভবিষ্যতে আগত নানা বিপর্যয়, দুর্যোগ বা আজাব ও গজবের মুখোমুখি হয়ে আমাদের কী করতে হবে জাগতিক ও ফিকহি দৃষ্টি থেকে, সেটির আগাম প্রস্তুতি নিয়ে ভাবা দরকার। মুসলিমবিশ্ব ইতিহাসের বিভিম্ন বাঁকে নানা সংকটের মুখোমুখি হয়ে দ্বীনি ও জাগতিক প্রস্তুতির অংশ হিশেবে কী কী কর্মপন্থা অবলম্বন করেছিল, সেগুলোও সামনে রাখার প্রয়োজন হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইসলাম নিয়ে যে ভাবনা হচ্ছে, সেগুলো সম্পর্কে অবগত হয়ে সেগুলোর সাথে গড়ে তুলতে হবে ক্রিটিকাল ইনটিমেসি।

মুমিনের জন্যে আনাগত সময়ের সুসংবাদ আছে হাদিসে। সেজন্য দরকার ব্যাপক জ্ঞানগত ও বস্তুজাগতিক প্রস্তুতি। ব্যক্তির, প্রজন্মের, উম্মাহর চিন্তাগত ও আখলাকি প্রস্তুতি দরকার। গবেষণাগত দ্বীনি জ্ঞানের বিকাশ ও সমাজজুড়ে তার বিস্তার— প্রস্তুতির প্রাথমিক কাজ। আমাদের দ্বীনি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিবর্গ বিভিন্ন বিপর্যয়ে প্রতিক্রিয়ামূলক নয়, প্রো-অ্যাক্টিভ ভূমিকা কীভাবে পালন করতে পারে, তার নকশা করতে হবে সংশ্লিষ্ট মহলকে। শুধু আলেমদের উদ্দেশ্যে কিছু বই রচিত হওয়া দরকার। উলামারা নবিদের ওয়ারিশ। তারা আমদের মাথার তাজ। অনুসরণ করা ও তাদের জ্ঞান থেকে ফায়দা অর্জন ছাড়াও তাদের প্রতি সমাজের অপরাপর অংশের আরো নানা ধরনের দায়িত্ব আছে।

একটি হচ্ছে, তাদের জন্যে বাংলাভাষায় পাশ্চাত্য চিন্তা-দর্শন ও বিজ্ঞান ভাবনার লেটেস্ট বিকাশ ও বিচার নিয়ে বই দরকার, যাতে তারা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সঠিক জ্ঞান নিয়ে দ্বীনি দৃষ্টিতে তার যথাযথ ক্রিটিক করতে পারেন। ধর্মীয় জ্ঞানকে বিকৃত করা বা ধর্মীয় বিষয়ের বিকৃত উপস্থাপন যেমন অপরাধ, অন্য জ্ঞানশাস্ত্রকে বিকৃত করা বা বুঝে কিংবা না-বুঝে ভুলভাবে উপস্থাপনও অপরাধ। অনেকে বিজ্ঞান নিয়ে, মার্ক্সবাদ নিয়ে, পাশ্চাত্য চিন্তার ইতিহাস নিয়ে, ভূবিজ্ঞান ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে এমন অনেক বক্তব্য কনফিডেন্টলি দেন বা লেখেন, যা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গভীরভাবে যারা অবগত, তাদের কাছে প্রায়শই হাস্যকর ঠেকে, খণ্ডিত মনে হয়।

আমাদের এক কাল্পনিক পশ্চিম (ইমাজিনারি ওয়েস্ট) আছে, তার `এসেনশিয়ালাইজেশন` আছে, যেমন অন্যদের আছে এক ‘ইমাজিনারি ইসলাম’ বা কাল্পনিক ইসলামের ধারণা। যাই হোক, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যারা দ্বীনি জ্ঞান অর্জন করেছেন আর যারা (বিশেষভাবে, মুমিন ও সাধারণভাবে, বিবেচক `অপর`) প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জাগতিক বিভিন্ন বিষয়ের জ্ঞান-প্রজ্ঞা হাসিল করেছেন, তাদের মধ্যে জ্ঞানীয় লেনাদেন এখন সময়ের দাবি। অনেকে ইসলামের নিধর্মীকরণ ঘটাচ্ছেন, অন্যমত ও আদর্শকে ইসলামের উপর চাপাচ্ছেন। এসবকে বুঝে নিয়ে ক্রিটিক করা শিখতে হবে। শিখতে হবে আজকাল কীভাবে কোনও কিছুকে পাঠ করতে হয়, সেই শাস্ত্রকে।

দ্বীনি ও দুনিয়াবি জ্ঞানে অভিজ্ঞদের এসব বিষয়ে আগাম উদ্যোগ দরকার শিগগির। মুমিন প্রস্তুত থাকে ও তাওয়াক্কুল করে, এই বুঝ ছড়িয়ে পড়ুক।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক