জগলুল আসাদের কলাম ‘হাদিসপাঠ মানে নবির পরোক্ষ সহবত’
প্রকাশিত : ডিসেম্বর ৩০, ২০২০
রসুলের (সা.) কথা, কাজ ও অনুমোদনকে অর্থাৎ হাদিসকে কীভাবে দেখতে হবে তার নির্দেশ কোরানুল কারিম থেকে পাওয়া যাবে। হাদিস দ্বারা নবি কর্তৃক প্রদত্ত শরয়ি আদেশ-নিষেধই বোঝায় না শুধু , প্রায় প্রতিটি দিকে সর্বোৎকৃষ্ট করণীয় ও সবচেয়ে কল্যাণকর অনুভব ও চিন্তার পরিচর্যা ও দিকনির্দেশনাও বোঝায়। আর, কোরান যে কারণে সংরক্ষিত হয়েছে, হাদিসও সংরক্ষিত হয়েছে একই কারণে। কোরান যাঁর উপর নাযিল হয়েছে, হাদিসও নাযিল হয়েছে তাঁরই উপর। উভয়ের উদ্দেশ্যও অভিন্ন— ঐশী নির্দেশ অনুযায়ী জীবনকে যাপন করা, সম্পর্ক নির্মাণ, চিন্তা ও অনুভূতি তৈরি করা খোদায়ী আদেশ ও নবির দেখানো পথ অনুযায়ী।
কালিমার চাবি আছে মুর্শিদের হাতে— কার বাণী যেন! খোদায়ী কালাম বুঝবারও চাবি আছে যে মুর্শিদের কাছে তিনি প্রথমত ও প্রধানত নবি করিম (সা.), তারপর সাহাবা আজমাঈন (রা.) ও সালফে সালেহিনগণ,তারপর তাঁদেরই অনুসারী উলুল আলবাবগণ। হাদিসকে বুঝতে হয় সাহাবাদের আমল ও ব্যাখ্যার মধ্য দিয়ে, তাঁদের অবলম্বিত পদ্ধতি থেকে, নবির নিকটবর্তী প্রজন্মের বুঝ ও অন্তর্দৃষ্টি থেকে, বছরের পর বছর ধরে দিনকে রাত ও রাতকে দিন করে যাঁরা একেকটা হাদিস নিয়ে জীবনপাত করেছেন, তাঁদের কাছ থেকে। ইসলামের কোনো শাস্ত্রই এমেচার-ব্যাপার না, শত বছরের অশ্রু-ঘাম-কিয়াম-দরুদ-আস্তাগফির আর ইলমি মুজাকারার ফল তা।
একটা হাদিস যখন সমর্পিত হয়ে পাঠ করবো, ওই আত্মনিবেদনের অংশ যেন হয়ে উঠি আমরাও। ইসলামের ইতিহাসের কোনো পর্যায়েই হাদিসকে সাহিত্য পাঠের দৃষ্টভঙ্গিতে বা শুধুই আনন্দানুভূতির নিমিত্তে পাঠ করা হয়নি। এরিস্টটল কথিত ‘ক্যাথারসিস’ও হাদিস পাঠের মূল মাকসাদ না, বা বার্টোল্ট ব্রেখটের এলিয়েনশন তত্ত্বও হাদিস পাঠের তরিকা নয়, কোলরিজ কথিত ‘উইলিং সাসপেনশন অব ডিসবিলিফ’ দিয়েও হাদিস পাঠের উপকার আসবে না; বরঞ্চ ‘আমি তো জানি না’ বা ‘মা আনা বি কারি’র চেতনায় নিজের অজ্ঞতার স্বীকৃতি দিয়ে হেদায়াত ও হক পাবার লক্ষ্যে জীবন ও চিন্তাকে সাজাবার নিয়তে নিজেকে সমর্পণ করে পাঠ করলেই সেই ফায়দা পাওয়া যাবে, যে ফায়দা পাবার কথা।
হাদিস পাঠে ঘটে নবির পরোক্ষ সহবত; এও এক পরম প্রাপ্তি; বিগত, বর্তমান ও অনাগত অসীমের শ্রেষ্ঠতম মানুষের সহবতের শিখা জন্ম দিতে পারে ভুবনছাপানো আলোর প্লাবন! বুকের ভেতর ‘মুক্তি’র এই বাসনা পোষা ছাড়া, চৈতন্যের এই দশা ছাড়া, নবির কালাম পাঠে ফায়দার কি সম্ভাবনা! জগতে পণ্ডিতির পসরা সাজাতে কেউ নবির দ্বারস্থ হলেও, সে হয়তো একেবারে শূণ্য হাতে ফিরে আসবে না, কিন্তু প্রকৃত বরকত ও সহবতের তাছির থেকে বঞ্চিত হবে সে, মাহরুম হবে নিজের ও সম্প্রদায়ের সত্যিকার সফলতা থেকে, যে সফলতা ইহজগত-অতিক্রমী। অবশ্য আল্লাহ ভিন্ন কিছু চাইলে সেটাই চূড়ান্ত।
দুই.
হাদিসের স্তরবিন্যাস পরীক্ষা করবার পদ্ধতি ও হাদিসের শুদ্ধতা নির্ধারণে মুহাদ্দিসীনদের কঠোর নীতি-পদ্ধতির সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ ঘটলে বিস্মিত হতে হবে। হাদিস সংকলন শুরু হয় নবিজীর মৃত্যুর দুশো বছর পর— এই ভুল মতের পর্যালোচনা পাবেন সুলাইমান নদবির খুতবাতুল মাদ্রাজে, ও ড.হামিদুল্লাহর গবেষণায়। কীভাবে সাহাবি ও তাবেয়িনগণ অভূতপূর্ব সতর্কতার পরিচয় দিয়েছেন হাদিস বর্ণনায়, কীভাবে তাঁরা নবিজীর ব্যবহৃত শব্দের হুবুহু স্মরণ রাখতেন স্মৃতিতে ও আমলে, কীভাবে চেনা যায় ভুল ও মিথ্যা হাদিস— এসব নিয়ে সহজবোধ্য ভাষায় আলোচনা পাওয়া যাবে ড.আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীরের বইয়ে। কেন হাদিসের সনদকে (চেইন অব রেফারেন্স) কঠোরভাবে যাচাইয়ের প্রয়োজন হয়, কীভাবে পরীক্ষা করা হয় টেক্সটের ভাষা ও ভাব, কোরআন ও হাদিসের ভাষাগত পার্থক্যসহ আরো বহুবিধ সুক্ষতর বিষয় পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণের অধীনে আনা হয়।
হাদিস সংগ্রহ ও যাচাই-বাছাইয়ে মুহাদ্দেসীনদের জীবনব্যাপী সাধনা, নিষ্ঠা ও শ্রম আপনাকে অশ্রুসিক্ত করবে। শুদ্ধতার জন্য এই শ্রম ও কঠোরতার কারণ নিহিত হাদিসকে মুমিনের প্রাত্যহিক জীবনে রূপায়িত করবার অনিবার্যতায়, প্রতিক্ষেত্রে হেদায়েত ও উসওয়া`র আবশ্যকতায়। শুধু ভবিষ্যতে কেউ এসে হাদিসগ্রন্থ থেকে সাহিত্যের আস্বাদন নেবে এই উদ্দেশ্যে নয়, বা ব্যাখ্যার মুক্তক্রীড়ায় বিহ্বল হবে, সে জন্যেও নয়! কেদারায় বসে চিন্তা ও যাপনে ন্যূনতম পরিবির্তনের ইচ্ছা ব্যতিরেকেই গবেষণার নামে বিদ্যার দিগগজ হবে, সে জন্যেও নয়। মনে রাখা প্রয়োজন, ইসলামের বিভিন্ন দিক নিয়ে বারোশো বছরের বিপুল স্কলারশিপ গড়ে উঠেছে। সেই ঐতিহ্যের সাথে যার ইলমি যোগাযোগ, তার থেকে আত্মঅহংকারে আর নিজের উপর আস্থার মরীচিকায় দূরে থেকে যে ফায়দা চাইবে, বিভ্রান্তির চোরাবালিতে নিমজ্জনের সম্ভাবনা তার তীব্র।
আওয়ামের এজেন্সি নিহিত আস্থাশীল আলেমের সন্ধান করাতে, নিজেই মুহাদ্দিস ও ফকিহ সাজাতে নয়। ইসলামি জ্ঞানের এক শাখা সাহায্য করে আরেক শাখাকে। ধরা যাক, কেউ হয়তো আকিদা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, কেউবা হাদিস আর কেউবা ফিকাহ শাস্ত্রে। কেউ সারাজীবন কাটিয়ে দিয়েছেন হাদিস অধ্যয়নে, কেউবা মাসআলা-মাসায়েল উদ্ধারে, কেউবা বিশেষজ্ঞ শরিয়তের মাকাসিদ বিষয়ে। কেউ কোরআনের বালাগাত-ব্যাকরণ ও বিচিত্র ভার্বাল নুয়ান্সেস নিয়ে গবেষণা করে কাটিয়ে দিয়েছেন যুগ-যুগান্তর। প্রতিটি শাখা দাবি করে আমরণ সাধনা। আবার, প্রতিটি শাখাই একে অপরে অনুপ্রবিষ্ট। হাদিস বিশেষজ্ঞগণ সহীহ হাদিস তুলে আনেন, ফুকাহারা সেগুলো থেকে উদ্ধার করেন তাৎপর্য, বৈপরীত্যগুলির সমন্বয় করেন এবং জীবন সমস্যা সমাধানে স্থান-কাল বিবেচনায় সেগুলোর প্রায়োগিকতা পরীক্ষা করেন, নিজেকে এনগেইজ করেন সমকালের বিভিন্ন জ্ঞানগত অর্জনের নিরীক্ষাতেও।
যিনি আলেম, যিনি মুজতাহিদ তিনি অভুতপূর্ব কোনো ব্যখ্যা হাজির করেন না; ব্যাখ্যা করবার ও বুঝবার শতবর্ষব্যাপী ঐতিহ্যের ভেতর দাঁড়িয়ে কাল ও বাস্তবতার সচেতনতা ও বুঝ দিয়ে তিনি উম্মাহর ও ইনসানের দিশারি হন। ইসলামি প্রজ্ঞার জগতে কোনো শাস্ত্রই অপর শাস্ত্র থেকে অমুখাপেক্ষী থাকতে পারে না।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ