ছোটগল্পে আশির দশক

অমিতাভ পাল

প্রকাশিত : আগস্ট ০৪, ২০১৯

বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্পের যে শক্তিশালী ধারা ষাটের দশক পর্যন্ত সমান স্বাচ্ছন্দে হাঁটছিল, সত্তরে এসে তা যেন হারিয়ে ফেলেছিল পথ। এর একটা কারণ হতে পারে, পশ্চিমবঙ্গের সেরা সব গদ্য লিখিয়ের সময় ততদিনে ফুরিয়ে গিয়েছিল। তবে বাংলাদেশে ঘটনাটা এরকম ছিল না বলেই আমার মনে হয়। এখানে ঘটেছিল অন্য আরেকটা ব্যাপার। সেই ব্যাপারটার নাম মুক্তিযুদ্ধ।

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের দেশটাকে দৃশ্যত ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে দিয়েছিল। চেতনাগত যে শক্তি ধীরে ধীরে জমা হয়ে আমাদের এগিয়ে দিয়েছিল স্বাধীনতার দিকে, তার বিস্ফোরণের পর আমরা যেন পড়েছিলাম ফেটে যাওয়া গোলার খোসার মতো। এর না ছিল তেজ, না ছিল একাগ্রতা। আর দৃশ্যের জগতে যুদ্ধশেষে আমরা পেয়েছিলাম এমন এক পটভূমি, যার পুরাটাই ভেঙেচুরে খানখান হয়ে যাওয়া।

‘কেবলি দৃশ্যের জন্ম হয়’ জীবনানন্দের এই কবিতার লাইনটা সেইসময় আক্ষরিক অর্থেই সত্যি হয়ে দেখা দিয়েছিল। আর জন্ম নেয়া সেই দৃশ্যগুলি ছিল আমাদের এতদিনকার পরিচিত সব দৃশ্যের থেকে আলাদা। এত ভাঙচুর, এত লাশ, এত মর্মস্পর্শীতা এর আগে এই জাতি কোনোদিন দেখেনি— এই নৃশংসতাও না। ফলে আমাদের মননে জন্ম হয়েছিল এমন এক বিস্ময়ের, যার সাথে অপরিচয়ের কারণে তাকে ঠিক ভাবনার মধ্যে ধরতে পারছিলাম না আমরা।

চেষ্টা যে চলছিল না, তা না। বরং সত্তরের তেজী তরুণরা এই দৃশ্যগুলিকে আটকেছিলেন নাটকের মধ্যে। শিল্পের চরম সীমায় উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়া এই নাটকগুলিই (রচনায় এবং অভিনয়ে) ছিল বাংলাদেশে সত্তরের সেরা সাহিত্য। তারপর ধীরে ধীরে আশির দশকের সূর্য উঠলো আকাশে। এটা এমন এক দশক, যার নাগরিকেরা ব্যর্থতা, হতাশা আর প্রতিশ্রুতিভঙ্গের পুষ্টি নিয়েই জন্মেছিল। ফলে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বিপর্যস্ত ভাব এদের ওপর কোনো প্রতিক্রিয়া তৈরি করেনি তো বটেই, বরং তাদের নিজেদের জীবনের তিক্ততার কাছে এই বিপর্যয় ছিল সামান্য ভূমিকা মাত্র।

তাই মুক্তিযুদ্ধ এবং সেই সংক্রান্ত বিষয়গুলির দিকে মনোনিবেশ না করে তারা হেঁটে গিয়েছিল সামনের দিকে, যেখানে এক অন্যরকম বাস্তবতায় অন্যরকম সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। এবং এই অন্যরকম বাস্তবতা এবং অন্যরকম সমস্যার জন্ম দিয়েছিল আন্তর্জাতিক পৃথিবী।

সেই সময়টাতে এই বিশ্বের অনেক সুস্থিরতাকেই মনে হচ্ছিল ঠুনকো। আমি বলবো না যে এরকম সময় আর কখনো আসেনি, বারবারই পৃথিবীতে সময়ের পুনরাবৃত্তি হয় এবং আশির দশকের ওই সময়টাও ছিল অন্যান্য অনেক সময়ের মতোই। কিন্তু পুনরাবৃত্ত দুই সময়ের মধ্যেও একটা পার্থক্য গড়ে ওঠে গ্রহণ-বর্জনের কারণে। আশির দশকেও তাই-ই হয়েছিল। আগের সময়খণ্ডগুলির তৈরি করা মাপকাঠিতে কোন কিছুকেই আর ধরা যাচ্ছিল না। প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল শনাক্তকরণের নতুন পদ্ধতির, বর্ণনার ভাষার জন্য দরকার পড়ছিল নতুন শব্দের, নতুন চরিত্রও মুখ দেখাচ্ছিল যেকোন দরজা জানালা দিয়ে।

ফলে এই সময়ের সাহিত্যে দেখা দিল এক অন্যরকম পরিপ্রেক্ষিত। বিশেষ করে সবচেয়ে লাভ হলো ছোটগল্পের। সত্তরে স্তিমিত হয়ে পড়া এই জলধারাটি যেন পেল নতুন বৃষ্টির জল। সত্য এবং কঠোর নিরপেক্ষতার কোলে বসে এটা হয়তো বলা যায়, আশির দশকে ছোটগল্পের যে স্ফূরণ, নতুনভাবে জেগে ওঠা একটা মৃতপ্রায় নদীর যে শক্তি, তার যথেষ্ট সামর্থ ছিল না একা একাই সমুদ্রে যাওয়ার। কিন্তু সেসময়ই লাতিন আমেরিকার এক নতুন প্রকৌশলকেন্দ্রিক শিল্পধারা জগত প্লাবিত করার কারণে বাংলাদেশে যারা নতুন সময়কে ধরবার জন্য আকুল হয়ে পথ হাঁটছিলেন। তারা পেলেন এক নতুনভাবে দীপ্যমান টর্চলাইট। আর সঙ্গে আলো থাকলে কে না সাহসী হয়, উদ্দীপ্ত হয়!

গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ডাইশন আশির দশককে এই সুবিধাটুকু দিয়েছিল। আর এর ফলে বাংলাদেশের ছোটগল্পের পাঠকরা পেলেন এক নতুন সাহিত্যের স্বাদ। ফাস্টফুডের দোকানগুলি যেভাবে কোনঠাসা করে ফেলেছে ডালভাতের হোটেলগুলিকে- সেভাবে না হোক, নাটকের স্তিমিত হয়ে পড়াটা চোখে পড়ে এই সময়েই। তাই বলে আশির দশকের গদ্যসাহিত্যকে ফাস্টফুড বলছি না আমি, তবে নতুন একটা জগত, নতুন মানুষজনের সান্নিধ্য এই দশকের গদ্যের স্বাদে একটা ভিন্নতা যে এনেছিল, বইপত্র উল্টালেই সেটা টের পাওয়া যায়।

বাংলাদেশ মৌলিকভাবে কবির দেশ হওয়ায় গদ্য কিছুটা অবহেলিতই। যে পরিমান তারুণ্যের জ্বালানি কবিতা রচনার চুল্লিতে পোড়ে, তার কিয়দংশও খরচ হয় না গদ্যকে একটা নতুন চেহারা দেবার প্রয়োজনে। হলে আশির দশকে যে গদ্যধারার সূচনা হয়েছিল, যাতে অনেক তরুণ ঋষিকঠিন সংযমে ঢেলে দিয়েছিলেন সাধনার সবটুকু শক্তি, সেটা আরেকটু অগ্নিপ্রবর হতো। আর আগুনের যা কাজ, নিজের আশপাশকে পুড়িয়ে হাত বাড়ায় পরের দিকে, সেটাও হয়তো সম্ভব হতো গদ্যদাহ্যতার প্রাচুর্যে।

গদ্যের আগ্রহ ভেজা কাঠের মতো হলেও আশির দশকের গদ্য লেখকের অভিযান তাতে দমে যায়নি। বরং একটা তপোধীর জেদকে সম্বল করে তারা এগিয়ে গেছেন কর্তব্যের সেই সুমহান শীর্ষবিন্দুতে, হোটেলের জানালা দিয়ে যা কাঞ্চনজঙ্ঘার মতো দেখতে আকর্ষণীয়, কিন্তু উঠতে গেলে পিছিয়ে যায় প্রায় সবাই-ই।

ভাগ্যিস এটা হয়েছিল এবং হচ্ছে। তাই আমরা যারা গদ্যকে ভালোবাসি, গল্পের কোলে শুয়ে কাটাতে চাই রোমাঞ্চকর দুপুর, তারা বেঁচে আছি এইসব লেখকের ফসল খেয়েই।

লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক ও গণমাধ্যমকর্মী