ছায়াবীথি শ্যামলিমার প্রবন্ধ ‘চন্দ্রশেখর সীমা’
প্রকাশিত : আগস্ট ২১, ২০২৩
আমরা জানি, সকল নক্ষত্রের পরিণতি একই রকম হয় না। কিছু নক্ষত্র অতিনবতারার supernova মাধ্যমে নিঃশেষ হয়, আবার কিছু নক্ষত্র ধীরে ধীরে এর প্লাজমার বহিঃস্থ আবরণ মহাশূন্যে নিক্ষেপ করে। সুপারনোভার মাধ্যমে নক্ষত্রটি তার বহিঃস্থ আবরণ আলোর প্রায় ১০ শতাংশ গতিতে মহাশূন্যে নিক্ষেপ কোরে এর ঘন কেন্দ্রীণ ব্ল্যাকহোল বা নিউট্রন নক্ষত্রে পরিণত হয় । অপরপক্ষে ধীরে ধীরে যে নক্ষত্র এর প্লাজমা নিঃসরণ করে তা গ্রহান্বিত নীহারিকা planetary nebula গঠন করে । অতিনবতারা ও নিঃসরণ এই দুই শব্দের মাঝে অনেক অর্থ লুকিয়ে থাকলেও এই দুই ঘটনার জন্য একটা সীমা বা লিমিট আছে। সাধারনত আমাদের সূর্যের চাইতে ১.৪১ গুণের বেশি ভরসম্পন্ন নক্ষত্রদের অতিনবতারা ঘটার সম্ভাবনা থাকে। আর এর চাইতে কম ভর সম্পন্ন নক্ষত্র গ্রহান্বিত নীহারিকা গঠন করে । এই সীমাকেই চন্দ্রশেখর সীমা বলে যা ভারতীয়-আমেরিকান জ্যোতির্বিদ সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখর ১৯৩১ সালে গাণিতিক হিসেবনিকেশের মাধ্যমে বের করেন। এজন্য তিনি ১৯৮৩ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরুস্কারে ভূষিত হন।
সহজ কথায় চন্দ্রশেখর সীমা হলো, স্থিতিশীল শীতল শ্বেত বামন তারকার সম্ভাব্য সর্বোচ্চ ভর। ভর এর চাইতে বেশি হলে তারকাটি চুপসে কৃষ্ণবিবর বা নিউট্রন নক্ষত্রে পরিণত হবে। একটি শ্বেত বামন তারকার জন্য এই ভরের মান ১.৪১ সৌরভরের সমান। তার নামানুসারে এই সীমার নামকরণ করা হয়।
চন্দ্রশেখর ছিলেন প্রখর মেধার অধিকারী যিনি ব্রিটিশ ভারতের লাহোরের তামিল পরিবারে জন্মেছিলেন। চন্দ্রশেখর মাত্র ১৯ বছর বয়সে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক সম্পন্ন করেন । ১৯৩০ সালে তার ২০ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই তিনি যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সরকারি বৃত্তি পান। এরও প্রায় ১০ বছর আগে চন্দ্রশেখরের গ্র্যাজুয়েট সুপারভাইজার রালফ ফয়লার লুব্ধক তারকাব্যাবস্থার sirius-B নক্ষত্র পর্যবেক্ষণে কিছু অস্বাভাবিক ফলাফল পান। sirius-B শ্বেতবামন নক্ষত্রটি আমাদের সূর্যের চাইতেও মিলিয়নগুণ ঘনত্বসম্পন্ন। এত বেশি ঘনত্ত্ব নিয়ে কিভাবে একটি তারকা তার মহাকর্ষজনিত চাপের বিপরীতে স্থিতিশীল থাকতে পারে, তা নিয়ে তখন কোনো সুত্র বা তত্ত্ব প্রচলিত ছিল না।
রালফ তখন কোয়ান্টাম মেকানিক্স ব্যাবহার করে সম্ভাব্য একটি কারণ উদ্ঘাটন করেন। শ্বেত বামন তারার ভর বেশি হলে মহাকর্ষ একে সংকুচিত করে ফেলতে চায়। ফলে এর অন্তর্গত ইলেকট্রনগুলি উচ্চতর শক্তিদশায় পৌঁছে এবং এদের গতিবেগ বাড়ার সাথে সাথে চাপও বাড়তে থাকে। পদার্থের এ ধরনের পরিস্থিতিকে বলে অপজাত অবস্থা Degenerate Matter। মহাকর্ষের ক্রমবর্ধমান চাপে একই কোয়ান্টাম দশায় একাধিক ইলেকট্রন থাকার প্রবণতা দেখা যায়। ইলেকট্রন হলো এক ধরনের ফার্মিয়ন কণা যা ফার্মি-ডিরাক পরিসংখ্যান মেনে চলে। এরা পলির বর্জন নীতিও অনুমোদন করে। পলির বর্জন নীতি অনুযায়ী একই কোয়ান্টাম দশায় একাধিক ইলেকট্রন থাকতে পারে না। তাই একাধিক ইলেকট্রনকে একই কোয়ান্টাম দশায় আসতে বাধ্য করা হলে এরা একরকমের চাপ দেয় যা ফার্মি-চাপ বা অপজাত চাপ নামে পরিচিত। এই চাপের উপস্থিতিতে তারাটি অন্তর্মুখী মহাকর্ষ বলকে কোনক্রমে ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হয় এবং শ্বেত বামনে পরিনত হয়।
কিন্তু চন্দ্রশেখর ১৯৩১ সালে লক্ষ্য করলেন, একটি গুরত্বপূর্ণ বিষয় রালফ এড়িয়ে গেছেন। উচ্চ ঘনত্বসম্পন্ন এ ধরনের নক্ষত্রের অভ্যন্তরস্থ ইলেকট্রনগুলি নক্ষত্রের অভ্যন্তরে প্রায় আলোর গতিতে ভ্রমণ করে যা এক অস্বাভাবিক প্রভাব সৃষ্টি করে। তিনি ইলেকট্রনের অপজাত অবস্থার বিস্তারিত হিসেব করে দেখতে পান, এই অবস্থা সহ্য করার জন্য তারকার ভরের একটি নির্দিষ্ট সীমা থাকতে হয়। এই সীমা যদি পার হয় তাহলে তারকাটি আর তার মহাকর্ষের চাপ সহ্য করতে পারে না এবং সংকুচিত হতে শুরু করে। পরবর্তীতে দ্রুত ও বিভিন্ন অংশে ভিন্ন ভিন্ন ঘূর্ণন হার বিশিষ্ট তারার জন্য ডুরিসেন (১৯৭৫) দেখান যে, এই ভরের মান ৩ সৌরভরের সমান হতে পারে। তবে ১৯৩৫ সালে চন্দ্রশেখরের সহকর্মী তৎকালীন নামী জ্যোতির্পদার্থবিদ স্যার আর্থার এডিংউড দাবি করেন, শ্বেত বামন তার জ্বালানি শেষ করার আগে চিরকাল শ্বেতবামনই থাকবে। প্রকৃতির একটা নিয়ম আছে যা আমরা জানি না তা শ্বেতবামন নক্ষত্রদের স্থিতিশীল রাখে । তিনি অস্বীকার করলেও প্রকৃতির সেই নিয়মই হল চন্দ্রশেখর সীমা।
চন্দ্রশিখর সীমা নক্ষত্রদের মৃত্যুর ধরন নির্ণয় করলেও এই সীমা পারতপক্ষে জীবনের লাইফলাইন। কারণ, এই সীমা অতিক্রম করলেই কেবল নক্ষত্রের সুপারনোভা ঘটে। আর সুপারনভার ফলে নক্ষত্রের অভ্যন্তরীণ ভারী মৌল যেমন (লোহা,তামা,নিয়ন) মহাকাশে যেমন ছড়িয়ে পড়ে তেমনি উচ্চচাপ ও তাপমাত্রায় আরও কিছু ভারী মৌল (সোনা,রুপা) উৎপন্ন হয়। সুপারনভা না ঘটলে পৃথিবীর মতো পাথুরে গ্রহদের জন্ম হতো না । কারণ পাথুরে গ্রহদের মূল উপাদান হল ভারী মৌল । আমাদের পৃথিবীর অভ্যন্তরের গলিত লোহা-নিকেল , আমাদের দাঁতের ক্যালসিয়াম, আমাদের দেহের লৌহও একইভাবে সুপারনোভার ফলেই এসেছে। সুপারনভা যদি না ঘটত তবুও গ্রহদের জন্ম হতো। তবে সেই গ্রহগুলি হতো বৃহস্পতি-শনির মতো গ্যাসীয়।