আবরারের খুনিদের বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ (ফাইল ছবি)
ছাত্র রাজনীতি এবং ‘ফার্স্ট বয়’ সংস্কৃতি
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : অক্টোবর ১০, ২০১৯
বহুজনকে বলতে শুনি ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। নিশ্চয় তাঁদের অনেকে ইতিবাচক উদ্দেশ্য নিয়েই বলেন। কিন্তু আমার প্রশ্ন, তাঁরা কি সমাজের মূল সত্যিটা দেখতে পান? আবরার নিহত হওয়ার পর দেখছি, আরো অনেক বেশি ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। বুঝতে পারছি এটা তাঁরা আবরার নিহত হওয়ার বেদনা থেকে বলছেন। কিন্তু আবরার নিজে প্রাণ দিয়েছে কেন? রাজনীতি না করার জন্য? নাকি রাজনীতি করার জন্য? স্বচ্ছ্ কাচের মতো পরিষ্কার এ কথা, আবরার প্রাণ দিয়েছে রাজনীতি করতে গিয়ে, রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকার জন্য নয়। বিশ্ব রাজনীতির এবং নিজ রাষ্ট্রের বহু কিছু আবরার যে মেনে নিতে পারেনি, নিজের মতো করে প্রতিবাদ জানিয়েছে; সেটাই তো রাজনীতি। যদি আবরারের মতো সকলেই রাজনীতি সচেতন হতো, রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকতো, তাহলে আবরারকে এভাবে প্রাণ দিতে হতো না। ছাত্ররা রাজনীতি না করলে, সচেতন না থাকলে একদল গুণ্ডারাই মাঠ দখল করে রাখবে। স্বার্থপর ভদ্র সমাজ সেটাই বুঝতে পারে না। হঠাৎ দুর্ঘটনা ঘটে গেলে কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করতে পারেন মাত্র।
যখন আবরার নিহত হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু ছাত্রছাত্রী তার বিচারের দাবিতে একত্র হলো। কিন্তু অনেক আগেই তাঁরা একত্র হতে পারলো না কেন? যদি এই ছাত্রছাত্রীরা গুণ্ডারা আবরারকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাঠে নামতো, আবরার নিহত হতো না। মৃত্যুর পরের এই দাবি দাওয়ার আন্দোলন, মৃত্যুর বিচার চাওয়ার চেয়ে, যদি ছাত্রছাত্রীরা সকলে রাজনীতিতে যুক্ত থাকতো, বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং এই রাষ্ট্রে তাদের অধিকারগুলি সম্পর্কে সচেতন থাকতো, গুণ্ডারা কি আদৌ আবরারকে রুম থেকে ডেকে নেয়ার সাহস দেখাতো? ছাত্রছাত্রীদের বিবেক মরে যায়নি, মনুষ্যত্ব হারায়নি বলে তারা বিচার চাইতে রাস্তায় নেমেছে। কিন্তু খুব দ্রুত তারা সব ভুলে যাবে, খুব দ্রুত তাদের মিছিল সমাবেশ ছোট হয়ে আসবে। কারণ স্বতঃস্ফূর্ত এবং তাৎক্ষণিক আবেগের এই আন্দোলন বেশিক্ষণ চলতে পারে না। রাষ্ট্র, সরকার, প্রশাসন তা জানে; জানে বলেই এই নিয়ে হত্যাকারীদের পক্ষের লোকদের তেমন উদ্বেগ নেই। রাজনীতি বিচ্ছিন্ন ছাত্রছাত্রীরা তাদের বন্ধুর জন্য, তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের নির্মম মৃত্যুর শোকে আজ একত্রিত হয়েছে, বিচার চাইছে। কিন্তু নাজিম হিকমদের কবিতার মতো, ‘মানুষের এই শোকের আয়ু বড় জোর এক বছর’। কিন্তু প্রতিটি ছাত্রছাত্রী যদি রাজনীতি সচেতন হতো, সংগঠিতভাবে তারা এইসব সঙ্কট মোকাবেলা করতো ভিন্ন পথে। রাষ্ট্রকে ভাবতে হতো তার ভয়াবহ পরিণাম নিয়ে।
বহু হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আমরা ভুলে গেছি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সেটাই স্বাভাবিক। কিছুদিন পর আবার এরকম মৃত্যু ঘটবে আর একজনের, তখন আবার আমরা নানা শোকসভা, প্রতিবাদ দেখতে পাবো। পুনরাবৃত্তি চলবে একই ঘটনার। কিন্তু আমরা কি পুনরাবৃত্তি চাই, নাকি সমাজ থেকে এই ধরনের নৃশংসতা দূর করতে চাই? যদি চাই দীর্ঘস্থায়ী সমাধান রাজনীতিতে যুক্ত হতে হবে সকল ছাত্রছাত্রীদের, যারা গুণ্ডামির বিরুদ্ধে থাকতে চায়। গুণ্ডামির বিরুদ্ধে থাকতে হলে সেই মতাদর্শের জন্য তাদের লড়াই করে যেতে হবে প্রতিদিন। গুণ্ডারা যা করছে তা রাজনীতি নয়, ক্ষমতাবানদের লেজুরবৃত্তি। যদি তরুণ সমাজ, যুব সমাজ সকলে এর বিরুদ্ধে একত্রিত হয় মতাদর্শকে সামনে রেখে, জনগণের পক্ষে যদি দাঁড়াতে পারে যুব সমাজ আর ছাত্রছাত্রীরা; গুণ্ডারা পিছু হটবে। পরে দেখা যাবে ওদের পায়ের নীচে আর মাটি নেই। পিতামাতারা যদি এরকম হত্যাকাণ্ড আর দেখতে না চান, যদি নিজের সন্তানের মঙ্গল চান; বলে দিন নিজের সন্তানকে রাজনীতি করতে। সন্তানকে বলেন সমাজ থেকে জীবনের প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণ করতে। সন্তানকে বলে দিন রাষ্ট্র, সমাজ, জনগণকে নিয়ে ভাবতে। কিন্তু যদি মনে করেন, আপনার সন্তান শুধু খাবে আর পড়বে আর ভবিষ্যতে কাড়ি কাড়ি টাকা কামাই করবে, আবরারের জন্য তাহলে আপনাদের মায়াকান্না দেখানোর দরকার নেই।
বহুজন মন গড়াভাবে মনে করেন, রাজনীতি করা মানেই সন্তান নষ্ট হয়ে যাওয়া। কিন্তু আমি নাম ধরে মেধাবী বহুজনের কথা বলতে পারবো, যাঁরা ছাত্র রাজনীতি করেছেন, পড়াশুনাও ভালো ছিলেন। বাংলাদেশের বহু বড় বড় পদে বসে রয়েছেন তাঁদের অনেকেই। দায়িত্ববান মানুষ হয়েছেন, বহু মানুষের কাছে সম্মান কুড়াচ্ছেন। মাখন রুটি খেতে পারাটাই যাদের বিচারে একমাত্র সুখ, নিজের চোখ আর কান খোলা রাখেন না তাঁরা। কারণ চোখ কান খোলা রেখে সমাজ বিশ্লেষণ করার শিক্ষাটাই তাঁরা পাননি। ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করার কথা বলা মানে কি, ছাত্রদের রাজনীতি করাটা খারাপ? ছাত্র রাজনীতি না থাকলে কি আমরা বায়ান্ন, একাত্তর পেতাম? না পেতাম না। কিন্তু ছাত্র রাজনীতির কারণেই যে আমরা বায়ান্ন একাত্তর পেয়েছি তা নয়, সত্যিকার অর্থে আন্দোলনের মূল শক্তি ছিলো সাধারণ জনগণ, গ্রামের খেয়ে খাওয়া মানুষ। ছাত্ররা নেতৃত্বে ছিলেন। ফলে ছাত্র রাজনীতি বাদ দেওয়ার কথা যারা বলছেন, বুঝতে পারছেন যে আপনারা ভাষা আন্দোলন আর মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, যাঁরা ছাত্র রাজনীতি বাদ দেবার কথা বলছেন, কখনো তাঁরা দেশের স্বার্থে মানুষের স্বার্থে ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন না। সর্বদা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। সরকার বিরোধী কোনো মিছিলে তারা অংশ নেননি সারা জীবনে। কিন্তু সব সুবিধা ভোগ করছেন আর বড় বড় কথা বলছেন।
মানুষের ত্যাগ তিতিক্ষার মূল্যটাই তাঁরা বোঝেন না। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়ে যাবার পর যে আমরা তার সুফল পেলাম না, তার একটা বড় কারণ ছাত্রদের বৃহত্তর অংশের রাজনীতি থেকে দূরে সরে থাকা। বাংলাদেশের প্রতিটি আন্দোলনে ছাত্র রাজনীতির ভূমিকা রয়েছে, কিন্তু মনে রাখতে হবে খুবই সামান্য ছাত্ররা সে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলো। ভদ্রঘরের সন্তানরা কখনো আসলে রাজনীতিতে থাকে না কিন্তু আন্দোলনের সুফলটা তারাই ভোগ করে বেশি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভদ্রঘরের বা মহাবিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ছাত্রদের সংখ্যা পনেরো শতাংশও হবে না। মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা সামনাসামনি লড়েছেন তাঁদের পঁচাশি শতাংশ গ্রামের দরিদ্র অখ্যাত সাধারণ মানুষ। মুক্তিযুদ্ধ সম্পন্ন করে তাঁরা ফিরে গেছেন নিজের পেশায়, লুটপাটে অংশ নেননি। মুক্তিযুদ্ধ করবার জন্য পুরস্কার চাননি কখনো। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁরা বড় বড় কথাও বলেন না। কিন্তু ভিন্ন দিকে দেখা যাবে একাত্তরে লড়াই করেননি, ছিলেন ভদ্রঘরের যুবক; চায়ের টেবিলে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এঁরাই বড় বড় কথা বলেন। যখন একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধের সময়কার বিভিন্ন ঘটনার সমালোচনা করেন, তখন এঁরা ক্ষেপে যান। মুক্তিযুদ্ধের মহান চেতনাধারী হয়েছেন তাঁরা।
বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করতে চাইছেন যাঁরা তাদেরকে প্রশ্ন, ছাত্র রাজনীতির যে সঙ্কট সেটা কি ছাত্ররা তৈরি করেছে, না অন্য কেউ? ছাত্ররা কি রাজনীতি করে নিজে নিজেই খারাপ হয়ে যায়? পূর্ব পাকিস্তানে ভয়াবহ কুখ্যাত গুণ্ডা ছিলেন সাইদুর রহমান পাচপাত্তর, আমার তিনি মামাত ভাই ছিলেন। যিনি আত্মীয়-স্বজন পরিবারের মানুষের কাছে ছিলেন অসম্ভব প্রিয় একজন মানুষ, তিনি ঢাকায় পড়তে এসে গুণ্ডা হলেন। তাঁর বাবা চান মামা ছিলেন কীরকম একজন মাটির মানুষ। সাইদুর ভাই কি নিজের শক্তিতে গুণ্ডা হয়েছিলেন নাকি এই সমাজ রাষ্ট্র তাঁকে গুণ্ডা বানিয়েছিলো? নির্মমভাবে তিনি প্রাণ দেন অন্যদের ছুরিকাঘাতে। তিনি গুণ্ডামি করতে করতে এমন জায়গায় চলে গিয়েছিলেন, তাঁর মৃত্যুতে তাঁর আত্মীয়রা ছাড়া আর কেউ কান্নাকাটি করেননি। বরং খুশি হয়েছিলেন বহু মানুষ। স্বাধীনদেশে সেই অবস্থাটা রয়ে গেল কেন? ছাত্রদের গুণ্ডামিটা নতুন কিছু নয়, বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে। আমার ব্যক্তিগত মত হলো, সাইদুর রহমানরা কী করে মোনায়েম খানের ছত্রছায়ায় বিরাট গুণ্ডা হয়ে যান, ত্রাস সৃষ্টি করে বেড়ান তা নিয়ে বড় বড় গবেষণা গ্রন্থ লেখা দরকার। যাঁরা আবরারকে হত্যা করেছে, তারা কিন্তু আবরারের মতোই আর এক বাবা মায়ের সন্তান। কিন্তু এই সমাজ, রাষ্ট্র না চাইলে তারা কি এইরকম আচরণ করার মতো ক্ষমতাধর হতে পারতো?
বাবা মা অভিভাবকদের নতুন করে ভাবতে হবে, তার সন্তান রাজনীতি করবে কি করবে না। সন্তানকে তিনি কি বন্ধুদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে প্রথম হতে বলবেন। নাকি সব বন্ধুদের সঙ্গে মিলেমিশে একসঙ্গে বেঁচে থাকার পরামর্শ দেবেন? সন্তানকে কি তিনি স্বার্থপরের মতো একা একা বাঁচার জন্য ‘বড় বাবু’র পা চাটতে বলবেন, নাকি বন্ধুদের সঙ্গে মিলেমিশে মাথা উঁচু করে হাঁটতে শেখাবেন। বর্তমানের যে শিক্ষা ব্যবস্থা, এ শিক্ষা তাঁর সন্তানকে বিশেষ কিছু শেখাতে পারে না, হয়তো দু-চারটা ক্ষেত্রে দক্ষ করে তুলতে পারে। প্রকৃত শিক্ষাটা আসে জীবন সংগ্রাম থেকে, কঠির সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। রাজনীতির ময়দানে দাঁড়িয়ে আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে; প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে ইতিহাস, সমাজ বিজ্ঞান, দর্শন ইত্যাদি পাঠ করে। বর্তমান শিক্ষা কী দেয় আমাদেরকে সে সম্পর্কে অমর্ত্য সেন চমৎকার একটি কথা বলেছেন।
বর্তমান ভারতের শিক্ষা সম্পর্কে অমর্ত্য সেন লিখেছেন, ‘ভারতীয় শিক্ষা বিদেশ থেকে বহুল প্রশংসা পেয়ে থাকে। আমাদের জানানো হয়, এত দিন পর্যন্ত যে সব ভাল ভাল চাকরিগুলোতে পশ্চিমীদের নিরঙ্কুশ প্রাধান্য ছিল সেগুলি এখন সুশিক্ষিত ভারতীয় বিশেষজ্ঞদের দখলে চলে যাচ্ছে।’ তিনি আরো জানাচ্ছেন যে, পশ্চিমী শিক্ষাজগতে ব্যবস্থাপনা, প্রশাসন, সাহিত্য, চিকিৎসা, প্রকৌশল এবং বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত গবেষণার ক্ষেত্রে প্রধান প্রধান পদগুলিতে ভারতীয়দের প্রকৃত উপস্থিতি শুধুমাত্র পশ্চিমীদের আশঙ্কারই ব্যাপার নয়, এটি একটি সত্যি ঘটনা। বিশ্বে বড় বড় পদগুলো সেইসব ভারতীয়দের দখলে চলে যাচ্ছে যাঁরা প্রধানত ভারতীয় শিক্ষা অর্জন করেছেন। নিশ্চিত রূপেই তাঁরা ভারতীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের গৌরব ছড়াচ্ছেন। পশ্চিমী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়েও ভারতীয়রা চমৎকার ফল করেন। অধ্যাপক সেন মনে করেন, ভারতীয়দের এই সাফল্যের পেছনে একটি চমক বা ঝলমলে কাহিনী রয়েছে। কারণ যে ভারতের শিক্ষার গৌরব নিয়ে সারা দুনিয়া বা পাশ্চাত্যে এতো হৈ চৈ, সে ভারতের একটি বড় সংখ্যক মানুষ নিরক্ষর। জনসংখ্যার বড় একটি অংশ বিদ্যালয়ে যাবারই সুযোগ পায় না। যে দেশের ব্যাপক মানুষ নিরক্ষর, সকল শিশুর বিদ্যালয়ে যাবার সুযোগ নেই; সে দেশের কিছু কিছু মানুষ তাহলে কী করে সারা দুনিয়ায় বিদ্যার গৌরব ছড়াচ্ছেন? প্রশ্নটি অমর্ত্য সেনের। তিনি প্রশ্নটির জবাবও দিচ্ছেন এভাবে যে, ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার যেখানে এরকম বিশৃঙ্খল অবস্থা সেখানে উজ্জ্বল গৌরবের ছবিটি কীভাবে সম্ভব হলো! তিনি বলছেন সেখানে রয়েছে জঘন্যতম একটি শব্দ ‘ফার্স্ট বয়’।
জনাব সেন দেখাচ্ছেন যে, ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতিটি স্তরেই শ্রেণীকক্ষে ‘প্রথম হওয়া’ বালকটিকে নিয়ে মোহাচ্ছন থাকে। সমাজের সর্বত্র, সরকারী নীতি নির্ধারণে এদের গুরুত্ব অধিক। শিক্ষকরা প্রতিটি শ্রেণীকক্ষে ‘প্রথম হওয়া’ ছাত্রদের সাফল্য নিয়ে মেতে ওঠেন এবং এইসব বিস্ময়বালকদের মধ্যে অনেকেই সারাজীবন ধরে স্মৃতিচারণ করতে থাকেন যে, তাঁরা ছিলেন তাঁর শ্রেণীর প্রথম হওয়া ছাত্র। বাস্তবিকভাবেই ভারত উপমহাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রথম হওয়া একটি বড় ঘটনা এবং শ্রেণীকক্ষের বাইরেও প্রথম হওয়া বালকটি সাফল্য পেয়ে থাকে নিজের জীবনকে প্রতিষ্ঠা করবার প্রতিটি ক্ষেত্রে। অধ্যাপক সেন মন্তব্য করছেন, প্রথম হওয়ার লক্ষণটি যখন শিক্ষা-ব্যবস্থাটিকে আচ্ছন্ন করে ফেলে তখন শঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ থাকে। তিনি বলতে চান, যখন ‘প্রথম’ হওয়ার কারণে সমাজের একেবারে গুটি কয়েক হয়ে ওঠে সুবিধাভোগী; তখন লক্ষ লক্ষ ভারতীয় শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়েই যেতে পারছে না। যারা বিদ্যালয়ে যেতে পারছে না তাদের প্রতিযোগিতা করার সুযোগই তো নেই। দ্বিতীয়ত শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারটিও যুক্ত। যাঁরা ব্যক্তিজীবনে সাফল্য পান তাঁরা যে-ধরনের উঁচুমানের বিদ্যালয়ে যেতে পারেন, সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের সে সুযোগ নেই। খুব নিম্নমানের বিদ্যালয়ে পড়ে তো সবসময় উচ্চমানের বিদ্যালয়ের সাথে প্রতিযোগিতা করা চলে না। যদিও সেন শিক্ষার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের প্রতিযোগিতারই পক্ষে নন বলেই মনে হয়।
বাংলাদেশের বাবা মায়ের বিরাট স্বপ্ন থাকে সন্তানকে ”ফার্স্ট বয়” হিসেবে দেখার। বিরাট একটা সঙ্কটের শুরু সেখান থেকে। সকলেই যেন অন্ধের মতো এই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। সন্তানকে কেন শিক্ষিত করতে চান প্রশ্নটা কখনো নিজেকে করেন না। কিন্তু মনে মনে একটা হিসেবে রয়ে গেছে, সন্তার তাঁর প্রচুর টাকা আয় করবে। সাধারণত বাংলাদেশের একজন মা-বাবা সন্তানকে যখন চিকিৎসাশাস্ত্র পড়তে পাঠান কখনো কি বলে দেন, চিকিৎসক হয়ে মানুষের সেবা করবে, অন্যায়ভাবে রোগীর কাছ থেকে টাকা নেবে না; দরিদ্র এবং অসহায় রোগীদের প্রতি সদয় হবে। যখন সন্তান সরকারি চাকরি পান, বাবা-মা কি বলে দেন যে, ঘুষ খাবে না; সাধারণ জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে যাবে না। যতো বড় কর্মকর্তাই হও না কেন, পরের ক্ষতি করবে না; মানুষকে সম্মান করবে। বরং উল্টোটা ঘটে, সন্তান বড় কর্মকর্তা হলে মা-বাবা অন্যদের উপর কর্তৃত্ব করেন। সত্যি বলতে এই সমাজে গুণ্ডারা যা প্রকাশ্যে করেন, ভিতরে ভিতরে আমরা তাই লালন করি। ফলে কয়েকজন গুণ্ডাদের প্রতি আমাদের যে সাময়িক ক্ষোভ, শিক্ষিত বেশিরভাগ মানুষই আমরা তাদের থেকে খুব ভিন্ন মতাদর্শ লালন করি না। মনের গহীনে আমাদের প্রতিযোগিতায় সকল ছাড়িয়ে যাওয়ার মতো একটি কুৎসিত গুণ্ডাই লুকিয়ে আছে।
মহাবিদ্যালয়ে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে সকল ছাত্রছাত্রীকে সচেতন হয়ে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে হবে কারণ তারা ভোটাধিকার প্রাপ্ত নাগরিক। রাজনীতি মানে শুধু ঘরের রাজনীতি নয়, বাইরের রাজনীতির সঙ্গেও যোগসূত্র থাকতে হবে। বিশ্ব পরিমণ্ডলকে তাদের বুঝে উঠতে হবে রাজনীতির ভিতর দিয়ে, বর্তমানের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কখনো তাদেরকে তা শেখাবে না। রাষ্ট্র কখনো বিশ্ব-পরিধির নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকে না, সকলকে সেটা বুঝতে হবে। যাঁরা ছাত্র রাজনীতির বিরুদ্ধে কথা বলছেন, তাঁদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলছি; আপনারা যে রাজনীতি বন্ধ করতে চাইছেন সেটা বন্ধ হয়ে যাওয়াই ভালো। কিন্তু ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করতে বলতে পারি না। যারা আগামী দিনের রাষ্ট্র চালাবে রাজনীতি থেকে তাদের দূরে সরে থাকতে বলবো কেন? বরং তাদেরকে বলতে হবে, রাজনীতি করতে আরো সুস্থিরভাবে। সেইসঙ্গে বলতে হবে, যে রাজনীতি পঁচেগলে গেছে তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নতুন রাজনীতিতে যুক্ত হতে। ছাত্রসমাজের সে রাজনীতি হবে, বিশেষ দলের পক্ষে অন্ধভাবে শ্লোগান দেয়া নয় বরং বিশেষ মতাদর্শের সঙ্গে থাকা, যে মতাদর্শ বৃহত্তর জনগণের কাছে তাদের নিয়ে যাবে। শিক্ষার্থীদের সুস্পষ্টভাবে জানতে হবে, দেশের বৃহত্তর জনগণ তাদের শিক্ষার খরচ জোগাচ্ছে। ফলে বৃহত্তর জনগণের প্রতি তাদের দায়দায়িত্ব আছে, ঋণ স্বীকার করবার রয়েছে। বাবা মায়ের দেয়া সামান্য টাকায় তারা বুয়েটে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পড়ছে না। পড়ছে অনেক বেশি জনগণের টাকায়। দেশের সেইসব জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়াটা, শিক্ষার লক্ষ্য হতে পারে না।
ছাত্রছাত্রীদের সংগঠিতভাবে রাজনীতি করতে হবে, সকল মাস্তানী গুণ্ডামি শিক্ষাঙ্গন থেকে দূর করার জন্য। শুধু আবরার হত্যার বিচার চাওয়ার ভিতর দিয়ে এই সঙ্কটের সমাধান হবে না। সকল ছাত্রছাত্রীরা সংগঠিত হলেই বাক স্বাধীনতা ফিরবে, আবরারদের প্রাণ বাঁচবে। সকল ছাত্রছাত্রীরা শুধু সংগঠিত হলে বিপদও আছে, তখন তারাই আবার মাস্তান হয়ে দাঁড়াবে সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে। সংগঠিত হতে হবে মতাদর্শকে সামনে রেখে, যে মতাদর্শ সকল জনগণের ভাগ্য ফেরাবে। রাজনীতি করার সঙ্গে সঙ্গে তাই শিক্ষার্থীদের সমাজ-ইতিহাস-রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে প্রচুর পড়াশুনা করতে হবে। বাংলাদেশের বাম-ডান সব রাজনীতির সঙ্কটটা হলো, জ্ঞানের চর্চা বাদ দিয়ে কিছু নেতার পিছনে বা দলের পিছনে শ্লোগান দেয়া। যাঁরা ছাত্র রাজনীতি বাদ দিতে বলছেন, তাঁরা হয়তো এই ধরনের রাজনীতি বাদ দিতে চাইছেন যেখানে শিক্ষার্থীরা সুবিধাবাদী রাজনীতির অন্ধ বলি হচ্ছে। ঠিক আমরাও তাই চাই, সঠিক রাজনীতিতে ফিরে আসা। রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আর এক নাম জ্ঞানার্জন, সে কথাটা আমরা ভুলে গেছি। জ্ঞানচর্চা বাদ দিয়ে রাজনীতি হয় না। বাংলাদেশে জ্ঞানচর্চা বাদ দিয়ে বাম-ডান সব রাজনীতি হয়েছে এতোকাল। বাম রাজনীতিক নেতাদের প্রজ্ঞার প্রতিফলন ঘটে হজ্জ্ব করার মধ্য দিয়ে, ডানদের কথা নাই বা বললাম।
মনে রাখতে হবে, বাম-ডান সকল রাজনীতিকদের দায় রয়েছে আজকের এসব ঘটনার জন্য। বিচ্ছিন্নভাবে কারো উপর দায় চাপিয়ে দিয়ে আর যাই হোক, সঙ্কটের সমাধান হবে না। অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, দায় দুপক্ষেরই। সবকিছুর পরেও বামদের তবুও কিছু ইতিবাচক ভূমিকা আছে। কিন্তু ডানরা পুরোপুরি স্থবির যেন। ক্ষমতায় যাবার জন্য আগ্রহী মেরুদণ্ডহীন রাজনৈতিক দলগুলি কী দায়িত্ব পালন করেছে আবরার বা অন্যান্য হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়। ছাত্রছাত্রীদেরকে তাই বলবো, অন্যদের দিকে না তাকিয়ে নিজের বিচারবুদ্ধি বিবেক দিয়ে সংগঠিত হতে। নিজেদের মূল পড়াশুনার পাশাপাশি রাজনৈতিক পড়াশুনা চালিয়ে যেতে। রাজনৈতিক পড়াশুনা বাদ দিয়ে কেবল মাত্র পেশাগত পড়াশুনা বিকলাঙ্গ পড়াশুনা। চিকিৎসক, প্রকৌশলীরা যদি রাজনীতি না বোঝেন নিজের পেশার মান বাড়াবেন কী করে, জনগণের কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেবেন কী করে। চাকরি করতে হবে তখন আমলাতন্ত্রের দয়ায়, নিজের পেশার সম্মান কমিয়ে টাকা উপার্জন হবে মাত্র। বিদ্যালয়ের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্ররা পেশাদারী দক্ষতা অর্জনের পরেও, প্রশাসনের দ্বারা কেমন নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে হয়, সেটা কি টের পাওয়া যাচ্ছে না? রাজনীতি এমন একটা বিষয় এর প্রভাব এড়িয়ে কেউ চলতে পারে না। প্রতিদিন কাঁচাবাজার করতে গেলেও সেখানে রাজনীতি-অর্থনীতি রয়েছে। সত্যি বলতে আমাদের গভীর যে আবেগের জায়গাটা, মানুষের প্রেম-ভালোবাসা তাও রাজনৈতিক-অথনৈতিক ঘটনাবলী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। রাজনীতি থেকে দূরে সরে থেকে কোনো লাভ নেই। ছাত্রছাত্রীদের রাজনীতি বন্ধ করে দিতে বলার মধ্যেও কোনো ইতিবাচক চিন্তা নেই। দরকার সঙ্কট কাটিয়ে উঠবার জন্য নতুন পথের সন্ধান করা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থেকেই।