ছঁ`ছি

শিমুল বাশার

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৭, ২০১৯

যেই আমি এই গল্পটা করছি, সে আমি তখন ক্লাস ফোর কিংবা ফাইভে আর ঝর্নাদির বিয়ের বয়স। একথা চন্দ্রা শুনলো কি শুনলো না, তা ঠিক বোঝা গেল না। গালে হাত দিয়ে চেয়ে রইল দূরের নির্মাণাধীন ঢালু ভবনটার দিকে কিংবা তারও দূরে যেখানে আর কিছু দেখাই যায় না। পূবাকাশের গোধূলির রং আস্তে আস্তে যখন পশ্চিমের দিকেও গাঢ় হতে থাকে, ঝর্নাদি তখন কলসি কাঁখে নিয়ে চারপাশ আরো বেশি রাঙাতে রাঙাতে হেঁটে আসতো সরকারি কলতলায়।

আমার মনে হতো, জমিদার পরিবারের মেয়েরা বুঝি এমনই হয়। জমিদারতো দেখিনি কোনোদিন। তবে বাবার মুখ থেকে শুনেছি, ঝর্নাদির বাবার দাদা জমিদার ছিলেন আবার এটাও হতে পারে একথা বাবা কখনোই বলেন নাই হয়তো আমার কল্পনাতেই ঝর্নাদির অমন একটা অস্তিত্ব সেই শৈশব থেকে বেড়ে ওঠেছে।

কলতলায় অন্য যারা পানি নিতে আসতেন তাদের বেশিরভাগই ছিল হিন্দু পরিবারের। ঝর্নাদির প্রতি অজানা এক টানে কিছুটা কাছে এগিয়ে গেলে কলতলায় আসা অন্য দিদি-মাসিদের গল্পে শুনতে পেতাম, দূর-দূরান্তের কোনো এক রাজকুমার ঝর্নাদির বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে।

কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে চন্দ্রা তখনো অন্যদিকেই তাকিয়ে আছে। ঠিক বোঝা যাচ্ছে না এ গল্পে তার আদৌ কোনো আগ্রহ আছে কি নেই। বললাম, ঝর্নাদি পোড়ামাটি রংয়ের কোমর থেকে চাপকলের মুখে কলসটা রাখলে আমি কলের হ্যান্ডেলে ঝুলে ঝুলে তার কলসে পানি চেপে দিতাম। আর দেখাতাম আমার কত শক্তি! কলস পানিতে ভর্তি হয়ে গেলে ভরা কলসটা কাঁখে তুলে নিয়ে ঝর্নাদি বাসায় দিকে চলে যেত। কত সুন্দর করে হাঁটতো ঝর্নাদি! আমি চেয়ে থাকতাম তার চলে যাবার দাগ কাটা পথটার দিকে, অপেক্ষা করতাম আবার ফিরে আসার। ঝর্নাদি আবার আসতো। আমাকে কলতলায় দেখে মুচকি মুচকি হাসতো। আমি আবার হ্যান্ডেলে ঝুলে কল চেপে খালি কলস ভরে দিতাম। ঝর্নাদি সেই পানি নিয়ে বাসায় চলে যেত। আবার খালি কলস কাঁখে নিয়ে ফিরে আসতো কলতলায়। এভাবে একদিন সন্ধ্যা গড়িয়ে গেল। ঝর্নাদি আমার কাছে জানতে চাইলো, কেন আমি সন্ধ্যায় পড়তে বসি না?

গল্পের এপর্যায়ে আবার চন্দ্রার দিকে তাকালাম আমি। চন্দ্রা এবার গল্পটায় কিছুটা মন দিয়েছে বলে মনে হলো। সে এবার চেয়ে আছে আমারই দিকে। জানালাম, ঝর্নাদি এম্নিতেই খুব কম কথা বলতো, হাসতো বেশি। সেদিন আমাকে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করলো। বললো, ‘তোমারতো দেখি সত্যিই অনেক শক্তি হইছে!’ একথা শুনে আমি সোৎসাহে সারা শরীর শূন্যে ঝুলিয়ে দিয়ে আবার কল চাপতে লাগলাম। এবার আরো দ্রুত কলস ভরে গেল। চলে গেল ঝর্নাদি... সে এবার সত্যিই কিছুটা অবাক আমার এত্ত শক্তি দেখে। হঠাৎ দেখি ঝর্নাদি ফিরে আসছে, সাথে তার ছোট বোন গীতাও। গীতার কাঁখেও আরেকটা কলস। গীতা কলতলায় এসে জানালো, সেও কল চাপবে আমার মতো করে এবং ঝর্নাদিকে বলতে লাগলো, ‘এভাবে অন্তত এক কলস পানি ছঁ`ছির হাত থেকে বাঁচবে।’ আমি আরো বড় হবার পর জেনেছি, মুসলমানদের ছঁ`ছি পানি ঝর্নাদিরা খায় না।

চন্দ্রা সাথে সাথে বলে ওঠলো, এটা নিয়ে সে একটা গল্প লিখতে চায়। এভাবে অনেকক্ষণ চেষ্টার পর চন্দ্রার মনোযোগ আকর্ষণ করা গেল। তাকে আজ এই প্রথম একটু ইমপ্রেসিভ দেখলাম। ইদানী“ চন্দ্রাকে কিছুটা আনইমপ্রেসিভই মনে হয়। কফি টেবিলের আরেক পাশে বসা মুন্না আমার চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘ঝর্নাদি এখন কোথায়?’

আমি ভাবতে থাকলাম, ঝর্নাদি আপনি কোথায়? কেমন আছেন? ইন্ডিয়াতে ভালো আছেন তো?