চৌদ্দ লাইনের প্রতিটা স্তবক একেকটি গ্যাস বেলুন

মাহফুজুর রহমান সজীব

প্রকাশিত : জুন ২৯, ২০২০

সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের কবিতার বই ‘দশ মহাবিদ্যা’ ২০২০ সালে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয়। প্রকাশক বৈভব। আমার মতো আনাড়ি কবিতার বইটি খুলে যখন দেখি পুরোটাই সনেট, তখন নিজের জ্যাকেটের পকেটে নিজেকে ঢুকিয়ে ফেলি। তারপর কয়েক ঘণ্টা সেখানে থেকে বেরিয়ে সাহস নিয়ে বইটা পড়ে ফেলি প্রথমে এক দফা। কোনো মানে খুঁজতে যাইনি তখন। এই প্রথম পাঠে মনে হয়েছে, বিশাল খাঁচায় বন্দি ছোট ছোট হাজার হাজার পাখির ঠোঁটে একেকটি শব্দ জুড়ে দিয়ে যেন খাঁচা খুলে দিয়েছেন ঈশ্বরের নির্দেশে কোনো এক এঞ্জেল। মুখরিত শব্দগুলো! এরপর দেখি মিথের কত চরিত্র এখানে! কোনো মিথই পড়া নাই আমার তেমন। তাই এই জায়গাগুলো চির অধরাই থাকবে আমার। এরপর ১৪ লাইনের প্রতিটা স্তবকের ছাঁচে রেখে দেয়া জায়গাগুলোকে মনে হলো একেকটি গ্যাস বেলুন বিভিন্ন কালারের। গ্যাস বেলুনের সুতোগুলো জড়ো করে বাসার বারান্দাগুলোতে যেন বেঁধে বেঁধে রাখলাম।

দ্বিতীয় দফায় মানে বের করে করে পড়তে গেলাম এবং প্রথম প্রকরণে ১৪ লাইনেরই সনেটে মুড়ে রাখা প্রবেশক বুঝতে পারলাম এইতো সেই কবির বন্ধুর মেয়ে! ছবি আঁকতো যে! এতটা অল্প বয়সেই পৃথিবী ছেড়ে নিজেকে উঠিয়ে নিয়ে চলে গেছে সে। মোমের মতো গলে গেলাম আমি। কবির ভেতর এই চলে যাওয়া পোড়া দাগ হয়ে আছে। আদর করে `মা` ডাকা এই আর্টিস্টের চলে যাওয়া কবি কিভাবে মানতে পারেন! তাই বেদনায়, হাহাকারে যেন অ্যালবাট্রস হয়ে শূন্য সমুদ্রে উড়ে যেতে যেতে কবি বলেন,

শীতল অনল, মা গো, সুরভি অনল
ঝরে গেলি অতীতের ঘাসের তলায়।

এরপর আমি যত বুঝে বুঝে পড়ার চেষ্টা করেছি, সামনে যেতে যেতে ততবার ঘুরে ফিরে আমার মন এই সনেটেই এসে পড়তে থাকে। বইটি দশটি ভাগে বিভক্ত। দশ মহাবিদ্যা বলতে হিন্দুধর্মে দেবি অর্থাৎ দিব্য জননীর দশটি বিশেষ রূপের সমষ্টিগত নামই তো বোঝায়। সেই দশটি নাম কালী, তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলা, মাতঙ্গী ও কমলা। এই দশটি নামেই কবি দশ মহাবিদ্যার কবিতাগুলো সাজিয়েছেন সনেটের পোষাক পরিয়ে। এরপর শুধু পাজল রাখা সামনে। কোনও কোনও পাজল ভেঙে মিনিং দাঁড় করাতে পেরে আনন্দ পেয়েছি। যেখানে দাঁড় করাতে পারি নাই সেখানে মাথা নত করে সরে আসছি নিজের পাঠ সীমাবদ্ধতার দরুণ, আবার কোথাও মনে হয়েছে কবিতা লেখার বিরল সহজাত দক্ষতা থাকায় কবি কিছু জায়গা এমনিতেই শব্দ নিয়ে ইচ্ছে মতন খেলে গেছেন যেগুলো ফড়িঙের মতো উড়ছিল আমার সামনে, যেগুলোর মিনিংও জরুরি নয় বের করার।

‘আমার কবর তুমি, তবু, বেঁচে আছে।’ এক জায়গায় এই লাইনটা পেলাম। এমন অনেক লাইনই আছে যখন থেমে গিয়ে মজে যেতে হয়। পুরো বইটা সূক্ষ্ম-সূক্ষ্ম স্যাটায়ারে পূর্ণ। এই বই নিয়ে রিভিউ লেখার সাধ্য আমার নাই। বাট তাও পাঠ করায়, পাঠ যে করেছি আরেকটা বই সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের সেটাই বড় হয়ে আসছে। তবে হ্যাঁ, এই বইটা তিনতলা থেকে ফেলে দিলো আমাকে। সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের লেখা আবিষ্কারের নেশায় তার কয়েকটা বই পড়ে ফেলে মনে করেছিলাম এইতো ধরে ফেলেছি আমার প্রিয় কবিকে। তিনি যেই দশতলায় থাকেন আমার মনে মনে সে বাড়ির সিঁড়ি ভেঙে তিনতলায় উঠেছিলাম। ভেবেছিলাম এই দশ মহাবিদ্যা পড়ে ৯ তলাতে উঠে যাব সটান। বাট তিনতলা থেকেই নিচে পড়ে গেলাম। সারা গায়ে ধুলোবালি-মাটি নিয়ে ঘাওড়া আমি পুনরায় আমার মনে মনে থাকা কবির বাড়ির দিকে যাচ্ছি। একদিন এই দশ তলাতেই দশ মহাবিদ্যা শিখেই উঠবোই।

সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ পাঠকের সাথে চমৎকার যোগাযোগ করেন মজা করে করে কবিতাতেই। দেখেছি এমন তার অনেক কবিতায়। এই বইও তার ব্যতিক্রম নয়। সেই জায়গাগুলো পড়ে নির্ভেজাল আনন্দ পেয়েছি। এটা তার নিয়মিত পাঠক ধরতে পারেন অনায়াসেই। সনেট ভীতি আছে আমার, আছে আবার মিথ ভীতিও। তাও আবার দশ মহাবিদ্যা! আমি তাও নেমেছি এই জলে। সাঁতার কাটার সাহস না হলেও ডুব দিয়েতো এসেছি। এত এত ঘাবড়ে যাওয়া বিষয়ের প্রলেপ থাকলেও কবি কি অবলীলায় কতগুলো জায়গায় যেন পাঠকের সাথে মজা করে কথা বলে গেলেন!

বই থেকে আমার সবচেয়ে প্রিয় ৯টা লাইন।

১.
তোমাকে পেয়েছিলাম হঠাৎ হারায়ে ফেলার চেয়েও দ্রুত।
২.
শুক্র শনি রবি সোম মঙ্গল বুধবার, বিদায়! আমার মনে তোমার ম্লানিমা।
৩.
আত্মা পাও সভ্যতার কৃমিমাংস খুঁটে?
৪.
ফলে-ফুলে-জলে-মূলে-লতাগুল্মে আলো।
৫.
আলোর পায়রার মতো দেহো তারে ছেড়ে।
৬.
দৃশ্য বদলে যেতে-যেতে দীপ্র ফিরে আসি।
৭.
আমরা দু`টি হায়ারার্কি বদলে বদলে আছি।
৮.
যে চাঁদ আমার শুধু সে চাঁদ ছাড়ে কে?
৯.
লোহার বুদ্বুদে বন্দি ঘুমন্ত সময়।

এই বইয়ের সবচেয়ে প্রিয় আরও পাঁচটি জায়গা।

১০.
মৃত্যু একটা পরিণতি, পরিণাম নয়,
অর্থাৎ বাইরের নয়, ঘরেরই ব্যাপার_
জন্মের আযান থেকে মৃত্যু পয়দা হয়।"

১১.
মাটির বাসনা শুইঙ্গা দ্যাখো, বেটা,
মাটিতে সান্ধায় যদি ভিনদিশি লাঙল
ভূমিপুত্রকন্যাদের একোই শূলব্যথা
মরহুম রুহুতে বাজে।

১২.
মৌতই-তো তারার, যারা আজিও জীবিত,
মুর্দার মরণ নাই। নিত্য মৃত্যুভীত
ছুটছে যারা, খেতেছে হোঁচোট, একসময়
কবরেই আছড়ে পড়তে, কাষ্ঠ-বাকশোময়
আলো আর আঁধারের কুস্তোকুস্তি যত।

১৩.
আমারে ভাসায়ে দিল বেতের ঝুড়িতে,
নীলে; তুমি তুলে নিলে, রাজার দুলারি,
নাঙ্গা রাঙা বুকে। আমি প্রথম উড়িতে
শিখিনু পাহাড় থেকে পাহাড়ের খাঁড়ি-
পিতা মরুচর, আমি হলেম পাহাড়ি
গোর্খা, বেল্টে বাঁকা-কুকরি, তাতে কাটি আম
আম্রপালী গাছে, তুমি যাও বলিহারি।

এই পুরো সনেটটা যে আমি কতবার পড়লাম! যতবার পড়ি ততবার আমি আমার গহীনে অচেনা এক অনুভূতিতে জুঁই ফুলের মতো নুইয়ে পড়ি।

১৪.
আমি নাই, তাই আমি আছি। জোনাকিরা
নিবে থেকে, থেকে যায় নিবে যে-রকম-
আলোতে আলোই দ্যাখো, কাফনের ব্রীড়া,
কেকারে ঢাকিয়া রাখে যেমতো পেখম।
আমার কবর তুমি, তবু, বেঁচে আছো।
কবরে-কি আমি থাকি? না-ই মনে হয়।
আমাকে বুকের মাংস যবে বেচিয়াছ
সেথায় মাংসের ভুখ নাই মনে হয়
আর। নাকি থাকে? তাও? যদি থাকে তাও,
কিনেছ নিজেরে বেচে আমার অভাব
বুকে? মাংসে? রজমান্তে এ-নীরবতাও
নিমিত্ত। কারণ নয়। ঘরের আসবাব
নয়। আসবাবের ঘর। কার্য বা কারণ
মর্গান লা ফে-র বুকে খোঁড়ে পেনড্রাগন।

এই সনেটটা বইয়ের সবার প্রথমে। দাগ কেটে গেছে ভেতরে। কতবার যে পড়লাম! এই দাগের আশে-পাশে কত যে ছোট ছোট মন খারাপের বর্ণিল ফুল গজে উঠেছে, আমি জানি। কবির হৃদয় নিঙড়ে আসা এই সনেটে আজীবনের জন্য পৃথিবী থেকে এক বুক অভিমান ভরে চলে যাওয়া অভিমানী মেয়েটার প্রতি মায়ার আর্দ্রতা কচি ঘাসের মতো ছড়িয়ে আছে। ওপাড়ে ভালো থেকো মা তুমি।

১৫.
শীতল অনল, মা গো, সুরভি অনল
ঝ`রে গেলি অতীতের ঘাসের তলায়;
কনকলতার মতো, ফ্যালোপিয় নল
ঝুলে থাকল সিলিংফ্যানে; শোলার গলায়
কালো দাগ-আজরাইলের আংটি যেন, যাহে
স্বয়ংবরে নিলি তুই; ধনুঃ নহে, তুলি
ভেঙে, তোরে নিল তুলি` অসুর-বিবাহে:-
পিছনে নায়র তোর, সোনার পুত্তলি,
নিদুয়া সায়র হ`য়ে প`ড়ে রৈল পাড়ে!
কারে মারলি, কারে রাখলি-বিষুবীয় পাপ
গ`লে নামল ভিসুভিয় লাভা কার ঘাড়ে,
নিজেকে ছাড়া-তো কাউকে করলি না, মা, মাফ?
খুদগর্জি হ`ল না, বল? যে তোর মাথায়
কন্যা হ`য়ে ধন্যা ছিল মাতার মাতায়?

৭২ পৃষ্টার বইটির দাম চারশো টাকা। বইটি হাতে পেতে অর্ডার দিন এই লিঙ্কে https://www.rokomari.com/book/197112/dosh-mohabidya

একুশে বইমেলা ২০১৮