চুয়াডাঙ্গার শরিফুলের সুইসাইডের জন্য কেউ দায়ী না

তুহিন খান

প্রকাশিত : আগস্ট ১৮, ২০২০

আমার লাইফে খুব আর্লি দুইটা আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। এত আর্লি যে, এখন প্রায় গায়েই লাগে না ব্যাপারগুলা। কেউ আত্মহত্যা করলে একটা চাপ ফিল করে জীবিত মানুশেরা, নানাভাবে চাপ রিলিফ করার চেষ্টা করে। তো ওইরকম একটা চাপের ফিল আমি পাইছিলাম, আজ থেকে প্রায় ৮-৯ বছর আগে, যখন আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু চুয়াডাঙ্গার শরিফ আত্মহত্যা করে।

এই ঘটনা আমি জীবনে অনেকরে বলছি— চা খাইতে খাইতে, বিড়ি টানতে টানতে, শুইয়া, বইসা, দাঁড়াইয়া। আয়েশ কইরা একটা আত্মহত্যার গল্প বলার মইধ্যে এক ধরনের ক্রুয়েলটি আছে, স্বীকার করি। কিন্তু গল্প তো এইভাবেই বলা লাগে। তাই লেইখা এই ক্রুয়েল গল্পটা কখনও আমি প্রকাশ করি নাই। আজকে কইরা ফেলি। আমার পার্সোনাল লাইফের গল্প হিশাবে না পইড়া, খালি গল্প হিশাবেই পড়তে পারেন আপনি। ভালো লাগবে।

সেইটা বোধহয় ২০১১-১২ সালের কথা। আমি তখন ঢাকার একটা কওমি মাদ্রাসায় কাফিয়া জামাতে পড়ি। দুনিয়াবিমুখ যাহেদ তালেবে এলেম বলতে যা বুঝায়, আমি ছিলাম মোটামুটি তাই— ফজরের জামাতে দেরি করা, আর মাঝেমাঝে সুন্নাতে মোয়াক্কাদা না পড়া-ব্যতীত, জগতের আর কোন পাপের সাথে তেমন কোন সম্পর্ক ছিল না। মোবাইল চালাই না, সারাদিন মাদ্রাসায় থাকি, পড়াশোনা করি, দুই ঈদের ছুটিতে মিযান ভাইর সাথে বাসায় যাই, মিযান ভাই আমারে বাপের একদম হাতে তুইলা দিয়া তারপরে নিজের দৌলতপুরের বাড়িতে যান— এই আমার নরমাল লাইফ। ঢাকা থাকি তখন প্রায় চার বছর হইছে, কিন্তু বাংলাবাজারই চিনি না, তখনও।

মিনার মাহমুদ আমার একজন প্রিয় গদ্যলেখক, উনিও ২০১২ সালে ঢাকার একটা আবাসিক হোটেলে সুইসাইড করেন। উনি লেখছিলেন: জিন্সের মত জীবন। আমার জীবন জিন্সের মত এত টাইটফিট চকচকা ছিল না, খুবই নরমাল একটা লাইফ। এতটাই নরমাল যে, জাপানি টরে কাপড়ের বিশাল জুব্বা ছাড়া আর কোন কাপড়ই চিনি না তখনও। জীবন মানে ট্রাংকে ভাঁজ দেওয়া দুইটা পাঞ্জাবিই কেবল। আস্তে আস্তে জীবনের ভাঁজ খোলে, ন্যাপথলিনের কড়া গন্ধের মতন যৌবনের ঝাঁঝ লাগে নাকে।

জেডিসি পরীক্ষা দেওয়ার নিয়ত করি। জেএসসির আলিয়া ভার্শন আরকি। তো দিব ক্যামনে? যশোরের একটা আলিয়া মাদ্রাসায় চুপচুপ ভর্তি হয়ে যাই। কিন্তু ক্লাশ তো করা হয় না, পড়ব ক্যামনে? কওমি মাদ্রাসায় এইসব বই পড়ার জো নাই। হুজুররা দেখলে খেল খতম। শুরু হইল একটা সংগ্রামী লাইফ।

মাদ্রাসার সারাদিনের পড়ার চাপে, এইগুলা পড়ার টাইমও তেমন পাই না। আবার বিকালে তো আমি ক্রিকেট খেলতাম। যেদিন বিকালে শ্যমলীর মাঠে একজনও টুপিপরা লোক নাই, সেদিনও এমনকি। এই খেলাধুলা কুরবানি দিলাম। বিকাল হইলেই ঝোলার মইধ্যে আলিয়ার বইগুলা নিয়া চইলা যাইতাম দূরের মসজিদে। উপায় ছিল না। মসজিদে বইসা দুনিয়াবি পড়ালেখা করার গিল্ট ফিল হইত। মাঝেমাঝে উদাস হইয়া মসজিদের জালনা ধইরা কান্দাকাটি করতাম।

যাহোক, ছুটিতে বাড়ি গেলে, মাদ্রাসায় ক্লাশ করার সুযোগ হইত। কোন এক শুভদিনে, আলিয়া মাদ্রাসায় প্রথম ক্লাশটা করলাম। সেই ২০০৩ সালের পরে, আবারও আমার, মা-বোনের বাইরে কোন নারীমুখ দর্শনের, তাদের সাথে বইসা গল্পগুজবের, সুযোগ হইল। যশোর ক্যান্টের ক্লাশ থ্রির মেয়েরা যেন আবার ১০ বছর পরে ফিরা আসল আমার জীবনে। ততদিনে আমি অবশ্য লম্বা জুব্বায় আবৃত এক শাদা দরবেশ; ছোটকালে পুলিশ হওয়ার ইচ্ছাটা আর নাই, পতেঙ্গা সৈকতে কেনা প্লাস্টিকের সানগ্লাশ পরা ছবিটাও তো হারাইছে বহুদিন! ফলে, পরিণত বয়সে মা-বোনের বাইরে দেখা এই প্রথম নারীদের মনে হইল আজনবি। মনে হইল, এদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক তো নাই আসলে! এরা কারা? ইগনোর করলাম নারীজাতিরে।

কিন্তু নারীজাতিরে ইগনোর করা যায় না। তারা জলের মত ঘুরেঘুরে কথা কয়। গভীর রাত্রে বরিশালগামী লঞ্চ থিকা দেখা শাদা বিকনবাতির মতন তাদেরও তীব্র অস্তিত্ব টের পাই ঘুমের ভিতরেও। মাইলপোস্টের মত জীবনের মোড়ে মোড়ে দাঁড়াইয়া তারা পথের ক্লান্তি বাড়াইতে থাকে। তাদের তুমুল ইনোসেন্সের কাছেও পরাজিত হইতে হয়; দরবেশের শাদা আলখেল্লায়ও আছড়াইতে থাকে তাদের, এমনকি ছোটখাটো নিঃশ্বাসের মুহূর্মুহু ঢেউ। নাটকীয়, কিন্তু বাস্তবতা নাটকীয় হইলে আমার কিছু করার নাই। ২০১২ সালের কোন এক সকালে, আলিয়া মাদ্রাসার করিডোরে হাঁটতে হাঁটতে, আমি আমার কৈশোরের ইনোসেন্স হারাইলাম। মা-বোনের বাইরেও যে নারীর তীব্র অস্তিত্ব আছে, টের পাইতে থাকলাম দমে দমে।

কিন্তু দম ফালানোর কি টাইম আছে আমার! ছুটি প্রায় শেষ। ঢাকা আসা লাগবে। তা তো খারাপ না। ঢাকা আমার আজীবন ভাল লাগে। আমার মাদ্রাসা, আমার বন্ধুরা, আমার উস্তাদগণ, আমার কিতাব-খাতা, আমার সব— এইসবই তো আমি ভালবাসছি আজীবন। কিন্তু সেইবার, যশোর ছাড়তে কষ্ট হইল অনেক। ট্রেন ছাড়ার আগে কার যেন রুমাল নড়তে থাকল পরানের গহীন ভিতর।

এইগুলাই হইছিল তখন। প্রথম প্রেমেপড়ার কাহিনী বলব, লোকের কি আমার অভাব! মাগফুর ভাই আছে, আছে আমার আরো আরো বন্ধুরা। সারারাত আড্ডা দেওয়ার মতন লোকও দেদার আছে। তাদের সাথে চলল তুমুল আড্ডা। মাগফুর ভাইর সাথে কাটাইলাম বহু নির্ঘুম রাত্রি, দিলাম শত শত আড্ডা, টপিক একটাই— প্রেমে পড়ছি।

প্রেমে পড়া সোজা, সুন্দর, সুখ সুখ ব্যাপার; কিন্তু প্রেম করাটা তত সুখের না মনে হয়। লাজুক ফাজুক না আমি কোনদিনই, কিন্তু প্রেম ব্যাপারটা প্রকাশ করা মেবি একটা যুক্তিহীন অদ্ভুত ঘটনা। একটা আশা-নিরাশার ইলজিকাল প্যারা; একটা সাধারণ মানুশের কাছে স্বপ্নের মত কিছু চাইতে যাওয়ার বেহুদা মুজাহাদা। একটা অপরিচিত মানুশরে গিয়া বলব: আই লাভ ইউ। মানে, এরচাইতে অর্থহীন আর এম্বারেসিং কাজ তো দ্বিতীয়টা নাই দুনিয়ায়। এই বলার অর্থ টর্থ কী, তাও অত পষ্ট না তখন। ইভেন জানিই না আমি যে, লোকে প্রেম করে যে বলে, আসলে কী কী করে ওইখানে!

ফলে, হাজার চেষ্টার পরেও সুমাইয়ারে আমি বলতে পারলাম না যে, আমি ওরে পছন্দ করি। হাজার লোকের কাছে বলা যায়, কিন্তু সুমাইয়ার কাছে না। বাট, আমি ছিলাম বাঙলা সিনেমার আদি ও আসল লয়াল প্রেমিক। ওয়ান সাইডেড, কিন্তু জিনিশ খাঁটি। দিনরাইত এক কইরা সুমাইয়ারে ভাবতে থাকলাম। এমনকি এমন হইল যে, পাশের বাসায় সুমাইয়া নামের বিরক্তিকর মেয়েটারেও হালকা নরম নজরে দেখলাম। আমার যে বইগুলা নিয়া ও আর ফেরত দেয় নাই, ওইসবের দাবি ছাইড়া দিলাম আজীবনের জন্য।

তবু সুমাইয়ার পাত্তা তো পাই না! পাব ক্যামনে? তার ব্যাপারে কিছুই জানি না। বন্ধুর সাথে মশওয়ারা করলাম। বন্ধু কইল: মফস্বলের প্রেমের প্রথম ধাপ হইল মেয়ের বাসা খুঁইজা বের করা, তার বাপরে চেনা, তার ছোট ভাই-বোন থাকলে তাদের লগে খাতির জমানো। আমি কাফিয়া জামাতের এক আনকোরা হুজুর, এমনকি সাইকেলটাও চালাইতে পারি না, আমি এই বিশাল যশোর শহরে তার বাড়িটা খুঁইজা বের করব ক্যামনে! খালি জানি, তার বাড়ি অমুক জায়গায়। সেই জায়গাটা কই, কাউরে জিগানোর সাহসটাও নাই তখন। ফলে, আল্লাহই ভরসা। প্রতিদিন আসরের পরে পায়দলে বের হইতাম তার বাড়ি খুঁজতে। আমার বাসা থিকা চারটা রাস্তা চারদিকে চইলা গেছে। একেকদিন একেকদিকে যাই, ওই জায়গার নাম খুঁজি দোকানের বিলবোর্ডে, লোকেদের জিগেশ করি। একেকদিন কই কই গেছি যে, তার কোন হিশাব আর নাই এখন। খুঁজতে খুঁজতে মাগরেবের আজান দেয়। আমি কাছের এক মসজিদে ঢুইকা নামাজ পড়ি। মোনাজাতে কই, আল্লাহ, তুমি বান্দার মনের আশা পুরা কর!

চারদিনের দিন তার বাসাটা পাইলাম। এমন নাটকীয় ঘটনা বলতে শরম লাগতেছে সত্যি, কিন্তু জীবন আমার শরমের চাইতেও বেশি সত্য হয়া জানালায় টোকা মারে দিনরাইত।তারে ইগনোর করব, সেই সাধ্য আমার ছিল না। চিনলাম প্রেমিকার বাসা। প্রথম ধাপে সফল। এই সাফল্যে আহ্লাদিত হইয়া একদিন ক্লাশে আইসা শুনি, সুমাইয়ার প্রেম হয়ে গেছে। এবং যেইটা হয় আরকি টিভি-সিনেমায়, ঠিক সেইটাই আমার জীবনেও কেন হবে— সিনেমা তো অলমোস্ট মিথ্যা— ভাইবাই পাইলাম না। আমার সেসময়ের সবচাইতে ঘনিষ্ঠ বন্ধু চুয়াডাঙ্গার এক সারের ডিলারের ছোট পোলা শরিফুলের সাথেই প্রেম হয়ে গেছে মেয়ের। প্রেমের দ্বিতীয় ধাপ অনেকের জন্য প্রপোজ, আমার প্রথম প্রেমের দ্বিতীয় ধাপেই শুরু হইল তুমুল বিরহ।

রাত তো জাগিই। ছ্যাকা খাইয়া কবি হওয়ার খায়েশ আমার জীবনেও ছিল না, ইন ফ্যাক্ট, কবিতা জিনিশটারেই হেইট করতাম। স্পেশালি উত্তরাধুনিক বাঙলা কবিতা। কিন্তু এই তথ্য সত্য যে, বহুদিন পরে ওই রাইতেই আমি একটা কবিতা লেখছিলাম, প্রায় ১০ বছর পরে লেখা প্রথম কবিতা। ও নিয়া আমার আর আফসুস নাই কোন। কপাল আমার, আমার খোদার হাতের লেখা!

দিন যায়, আসে রজনী। শরিফ-সুমাইয়ার প্রেম দেখতে দেখতে আমি হালকা বাপ্পারাজ বাপ্পারাজ ফিল পাই। বাঙলা মুভিতে বাপ্পারাজ হওয়া অন্তত কিছুটা হইলেও সুখের: দর্শক মহান ভাবে, লাস্ট সিনে মরার সময় সব ফোকাস থাকে বাপ্পারাজের উপ্রেই। কিন্তু আমারে ফোকাস করবে কে? বাস্তবতা কঠিন। ওদিকে, এটুক মাইনাই নিলাম যে, প্রেমের দৌড়ে বন্ধু শরিফরে বিট করা আমার কাজ না। ক্লাশ এইটে থাকতে, ওই বয়সেই, শরিফুল সুমাইয়ারে বিয়া করার জন্য প্রায় ২০ হাজার টাকা ব্যাংকে জমাইছিল। এহেন শরিফুলরে প্রেমে বিট দেওয়া আমার মত অকর্মার জন্য তখন পুরাপুরি ইম্পসিবল। ফলে, ব্যর্থতা জিনিশটারে হালকা সেক্রিফাইসের রুপ দিয়া, মনে মনে একটা পেসিমিস্ট সুখ নিয়া নিজের লাইফে মন দিলাম আমি।

কিন্তু, ওই তো, যা হয়। সে কেন জলের মত ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়। ক্রিকেট ইগনোর কইরা আসরের পরে মসজিদে গিয়া পড়াশোনা করা সোজা, কিন্তু সুমাইয়ারে ভুইলা থাকা কঠিন। আবার এইটাও ভাবলাম যে, লাইফে প্রথম একজনরে পছন্দ করলাম, অথচ তারে জানাইতেই পারলাম না— এইটা কোন কথা! সে প্রেম করতেছে করুক, কিন্তু এটলিস্ট তারে এইটা জানায়া দেওয়া তো কোন ক্রাইম না যে, আমিও তারে পছন্দ করি! তো ডিসিশন নিলাম, আমি যে তারে পছন্দ করি, এবং সব জানার পরে এখন আর তেমন কোন এক্সপেক্টেশান আমার নাই, কিন্তু এখনও আগের মতই পছন্দ করি— এইটা তারে জানানো দরকার। চিঠির লাস্টে তাদের দুইজনের সুখী জীবনের জন্যে, এক টুকরা শুভকামনা জানানোর মত বাপ্পারাজিয় স্টাইলটাও ফলো করার চিন্তা করলাম। কমবয়সী কিশোরের একদমই ইনোসেন্ট একটা ডিসিশন ছিল এইটা।

বিশাল একটা লাভ লেটার লেখলাম এক রাইতে। হাতে কলমে ক্যামনে ২৯ পৃষ্ঠার ওই লেটার আমি লেখছিলাম, লেখার পরে ক্যামনে হাতের চামড়া কাইটা `S` খোদাই করছিলাম, ক্যামনে বন্ধু আলামিনরে দিয়া সেই চিঠিটা পাঠাইছিলাম আর সুমাইয়া সেই চিঠি আদৌ পাইছিল বা পইড়া দেখছিল কিনা— কিছুই আমি জানি না। ওই চিঠির সাথে সাথে সুমাইয়ারে আমি আমার আনকনশাসে ঠেইলা দিলাম, ফ্রয়েড ছাড়া আর কারুরই সাধ্য নাই এবার তারে ওইখান থিকা উদ্ধার করে।

সুমাইয়ারে আমি প্রায় ভুইলাই গেছিলাম তারপরে। আমি প্রিটেন্ড করি, আমি সুখী হইতে চাই। আমি জীবনের প্রত্যেকটা মুহূর্তে ভান ধইরা হইলেও আগাইতে চাই আরো একটু সামনের দিকে। মাঝে যেটুক স্মৃতি, ওইটুক তো সুখস্মৃতিই আমার বলা যায়। প্রেমের স্মৃতি কখনো দুঃখের হয় না, আমার তো এমনই ধারণা। ওদিকে এইটের এক্সাম হইছে ততদিনে, আমি যশোর জেলায় ফার্স্ট হইছি, গোল্ডেন পাইছি, মাদ্রাসায় কদর বাড়ছে, অফিসে গেলেই স্টাফরা হাসিমুখে চা খাইতে দেয়, হালপুরসি করে। আমার লাইফে তো সুখ। ফলে, আমার প্রথম প্রেমের এই কমেডিটা এইখানেই শেষ হইতে পারত। কিন্তু ট্রাজেডি ছাড়া কমেডি পুরা হয় না নাকি। সেইজন্যেই বোধহয়, এক গরমের ছুটিতে যশোর গিয়া শুনলাম, শরিফ সুইসাইড করছে।

নিউজটা শোনার পরেই ওই চাপটা ফিল করলাম, যেইটা যেকোন জীবিত মানুশ কারুর সুইসাইডের নিউজ শুনলে ফিল করে। এইটার জন্য আমি দায়ী না তো? সুমাইয়ারে যে চিঠি দিছিলাম, তার সাথে কি এই ঘটনার কোনভাবে কোন কানেকশন আছে? নাকি এইটা নিছকই সুমাইয়ার বাপের শরিফের ব্যাপারটা জাইনা যাওয়া ও তৎ-পরবর্তী ঘটনাবলীর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া? প্রচণ্ড চাপে আমি নাওয়া-খাওয়া প্রায় ছাইড়া দিলাম। ক্লাশে যাই, বরাবর ওইপাশের বেঞ্চে বইসা সুমাইয়া, মাঝেমাঝে শব্দ কইরাই, কান্দে। স্যার ধমক দেয়। এইগুলা অলমোস্ট অসহ্য লাগে আমার। বন্ধুদের সাথে কোন কথাবার্তা বলার সাহস পাই না। জিগাইতেও পারি না কী হইছিল। আজ অবধি আমি কাউরে জিগেশও করি নাই। এমনকি সুমাইয়ারেও না।

তারপর একদিন বিকালে, চুয়াডাঙ্গার সীমান্তবর্তী এক এলাকায়, বন্ধু শরিফের কবরটা দেখতে আমি গেছিলাম। ঘরের দাওয়ায় বসা শরিফের বাপ আমারে দেইখা নড়লেন না। শরিফের মা`রে কোথাও পাইলাম না। কেউ কিছুই বলল না। আমি একটা চেয়ার টাইনা সন্ধা পর্যন্ত বাড়ির উঠানে বইসা থাকলাম। এই বাড়িটায় প্রত্যেকটা জীবন এত বেশি থির, স্লো, মোশনলেস— আমি নিজের বাঁইচা থাকার ফিলটুকুও যেন পাইতেছিলাম না আর। মাগরেবের আজানের পরে হুঁশ ফিরল। শরিফের কবর কই, এইটা বন্ধু আশরাফুল আমারে জানাইল। গেলাম কবর দেখতে। শরিফের মা বইসা আছেন কবরের পাশে। চুলখোলা। মোশনলেস। ওই প্রথম আমি কোন বন্ধুর কবরের পাশে গিয়া দাঁড়াই, আমার বন্ধু শরিফ, যে কিনা সুইসাইড করে মারা গেছে, যার জানাজার নামাজ পড়তে ইতস্তত করতেছিল গ্রামের মানুশ, তারই কবরের পাশে দাঁড়াইছি আমি ঠিক মাগরেবের ওয়াক্তে, আমার গায়ে পাঞ্জাবি, আমার মাথায় শাদা টুপি, আমার পায়ে চামড়ার জুতা, আমার পকেটে মোবাইল, আমার হাতে একটা ২ জিবি মেমোরি কার্ড, কার্ডে শরিফের সাথে কোন এক পিকনিকে তোলা ছবি আর কিছু ভিডিও, আমি হুজুর, আমি ভাল মানুশ, গিয়া দাঁড়াইছি এক পাপীর কবরের সামনে, মাগরেবের ওয়াক্তে!

আমি কী করব? মেমোরি কার্ডটা ফালাইয়া দিলাম দূরে, জঙ্গলে। শরিফের আম্মা আমারে দেইখা মাথায় কাপড় দিয়া বাড়ির দিকে গেলেন। আমি ফাতেহা পড়লাম, পাশের জমিন থিকা এক মুঠ মাটি উঠাইলাম, কবরের উপরে সেই মাটিটুক রাখলাম। তারপর এশা পর্যন্ত বইসা থাকলাম সেই নির্জন নিস্তব্ধ কবরের পাশে। বন্ধুর কবরের পাশে বইসা আমার নিজেরে খুব অসহায় মনে হইল।

রাতে খাওয়ার সময় সব গল্প শুনলাম ওর বাপের মুখে। দাওয়ায়ই খাইতে বসছিলাম আমরা, কলার মোচা আর মুরগির সালুন। শরিফের মা রানছে। যশোরে মেস নিয়া থাকত শরিফ, সেদিন সন্ধায় সব গোছগাছ কইরা আইসা পড়ছিল। শরিফের আব্বা সারের ডিলার; ইন্ডিয়া থিকা ভাল ভাল সার নিয়া আসে দেশে। সেই সারের গোডাউনে ঢুইকাই নাকি ফজরের ওয়াক্তে কীটনাশক খাইছিল শরিফ। খাওয়ার পরেও চেতনা হারায় নাই, অন্তত রান্নাঘর পর্যন্ত আইসা ওর মা`রে কইতে পারল যে: মা, আমি তো কীটনাশক খাইছি। এই পর্যন্ত বলার পরে, শরিফের মায়ের উদাম কান্না শোনা গেল। শরিফের বোনটারে দেখলাম না কোথাও, জিগেশও করলাম না ওর ব্যাপারে কিছু। আমি কেন জিগেশ করব? আমি কে?

শরিফের ভাইয়ের হিরো হুন্ডা আজরাইলের সাথে বাজি ধইরা হাসপাতাল পর্যন্ত যাইতে পারে নাই। মওতের চাইতে দ্রুতগামী, সর্বগ্রাসী কোন হুন্ডা তো তৈয়ার হয় নাই। চুয়াডাঙ্গার একটা সাধারণ হাসপাতালে, ২০১২ সালে, আমার প্রিয় বন্ধু শরিফ মারা যায়। মৃত্যুর সময় তার আশেপাশে আমরা কেউই ছিলাম না। তার এই সুইসাইডের কারণ নিয়া কেউ কোন তদন্ত করে নাই। `মেয়েছেলের কেস`— এইভাবেই এই অতি সাধারণ মৃত্যুটা লিপিবদ্ধ হইছে ওই গ্রামের মানুশের কালেক্টিভ কনশাসে।

চুয়াডাঙ্গা থিকা ফেরার পরে আমার জ্বর আসে। জ্বরের ভিতরে আমার মাথায় অনেক অপরিচিত মানুশের মুখ ভাসে। মানুশের জীবনটা আসলে কী, কেন, বাঁচার বা মরার ফায়দাই বা কী— এইসব হুদাই মাথায় আসে আমার। জ্বর বাড়ে। আমি নিয়ত করি, আর যশোর থাকব না। ছুটি চলাকালীনই, ঢাকা আইসা পড়ি। জ্বর ভাল হওয়ার পরে পড়াশোনায় মন দিই।

এই পুরা ঘটনার একমাত্র চাক্ষুশ সাক্ষী আমার বন্ধু আশরাফুল এখন ডিজিএফআইতে চাকরি করে। পত্রবাহক আলামিনরে ওই ঘটনার পরে অনেক খুঁইজাও আর পাই নাই আমি। তারা যশোর ছাইড়া গেছে গা। সুমাইয়ার সাথে আর কথা হয় নাই আমার, দীর্ঘদিন। এই মাত্র দুই বছর আগে এক রাতে সে আমারে নক দিছিল। ফেসবুকে। যে সুমাইয়া সরাসরি একটা কথাও কোনদিন আমার সাথে বলে নাই, সে আমারে নক দিয়া অনেক গল্প বলল। তার বিয়ের কথা, সংসারের গল্প। একটা ছেলে হইছে তার— সেই কথা। আমি কিছুই বললাম না। আমি কে? আমি কী বলব সুমাইয়ার সাথে আর?

তদ্দিনে চুয়াডাঙ্গার শরিফের এই করুণ মৃত্যুর ঘটনাটা আমি ভুইলা গেছি। জীবনে অনেকগুলা মুরগি আর কলার মোচাও খাইয়া ফেলছি তদ্দিনে, শরিফের বাড়িও আর কোনদিন যাই নাই। আমি কেন যাব? কার সাথে দেখা করতে যাব? শরিফ মইরা গেছে। তার কবরের মাটিও মেবি এখন মিশা গেছে রাস্তার সাথে। তার বোনের হয়ত বিয়া হইছে, মা আর বাপ বাঁইচা আছে বা মইরা গেছে। আমি জানি না।

একজন মানুশ স্বেচ্ছায় মইরা গেলে কী করা লাগে, আমি জানি না। কারে দোষ দেওয়া লাগে, জানি না। প্রত্যেকটা মানুশই কারুর না কারুর মরনে গিল্ট ফিল করে, চাপ ফিল করে। আমি আর কোনদিনই, কারুর মরনের জন্য গিল্ট ফিল করতে চাই না। ছেলে হারানো কোন বাপের গল্প শুনতে শুনতে, তার মা`র হাতের রান্না খাইতে চাই না। আমি প্রিটেন্ড করি। আমি সুখী হইতে চাই। তাও একেকটা সুইসাইডের খবর কানে তো আসে। পুরান চাপটা আবার ফিরা আসে। মনে হয় আমি শাদা পাঞ্জাবি আর টুপি পইরা, ঠিক মাগরেবের ওয়াক্তে দাঁড়ায়ে আছি কোন কবরের সামনে। যে মরছে, তার চেহারা জানি না, নাম ধাম জানি না। খালি তার মায়ের কথা ভাবলেই, আমার দুনিয়ার সব কলার মোচা একসাথে খাইয়া মইরা যাইতে ইচ্ছা করে।