চা পানের যত অজানা স্বাস্থ্য উপকারিতা

ছাড়পত্র ডেস্ক

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২৪

জনপ্রিয় পানীয়গুলোর মধ্যে অন্যতম একটি চা। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য অনুযায়ী, পানির পরই বিশ্বে সর্বাধিক পান করা তরল হচ্ছে চা। কম-বেশি সবাই চা পান করে থাকেন। এটি অনেকের কাছেই শুধু একটি পানীয় বা অভ্যাস। তবে এর স্বাস্থ্যগুণও রয়েছে।

 

সংবাদমাধ্যম বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্যামেলিয়া সিনেসিস নামের চিরহরিৎ গুল্ম থেকে তৈরি করা হয় চা। ছোট গাছের পাতা ও পাতার কুঁড়ি সংগ্রহের পর তা থেকে উৎপাদন করা হয় চা। ব্ল্যাক টি বা র’ চা, গ্রিন টি বা সবুজ চায়ের মতো নানা নাম শোনা গেলেও একই উদ্ভিত থেকে ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে বা পরিস্থিতিতে চাষ করা হয়ে থাকে এসব।

 

কেন কফির থেকে এগিয়ে চা: ক্যাফেইনের কারণে চায়ের মতো পানীয়ের ক্ষেত্রে সবসময় একটু বেশিই ঝোঁক থাকে মানুষের। সকালে ঘুম থেকে উঠে চাঙা হতে অনেকটাই শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করে চা। কফি জনপ্রিয় হলেও তা চায়ের থেকে কিছুটা পিছিয়ে। মূলত ক্যাফেইনের পরিমাণের জন্যই এটা পিছিয়ে। একই পরিমাণ এককাপ কফিতে যদি ৮০ থেকে ১১৫ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন থাকে, সেখানে একই পরিমাণ চায়ে মাত্র ৪০ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন থাকে। অর্থাৎ কফির থেকে অর্ধেকেরও কম ক্যাফেইন থাকে চায়ে।

 

যুক্তরাজ্যের সারে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, একই দিন একই পরিমাণ চা-কফি পানের পর মনোযোগের ব্যাপারে অভিন্ন ফল দেখলেও রাতে ঘুমানোর সময় কিছুটা সমস্যা হয়ে থাকে কফি পান করা ব্যক্তিদের। বিপরীতে যেসব মানুষ চা পান করেন, তাদের ঘুম তুলনামূলক দীর্ঘ সময়ের ও প্রশান্তিদায়ক হয়ে থাকে।

 

মানসিক চাপ রোধ: রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে এবং সুস্বাস্থ্যের জন্য জরুরি উপাদান অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে চায়ের মধ্যে। এ কারণে চা পান করলে স্নায়ু ভালো থাকে। কর্মব্যস্ত জীবনে যে মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়, সেখান থেকে শরীরে অক্সাইডস নামের এক ধরনের উপাদান সৃষ্টি হয় বলে জানিয়েছেন সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফসল উদ্ভিদ বিজ্ঞান ও চা উৎপাদন প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ড. এ এফ এম সাইফুল ইসলাম।

 

এছাড়া চায়ের মধ্যে বিদ্যমান অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরে প্রবেশ করলে অক্সাইডাসগুলো ধ্বংস করে দেয়। এতে মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। আবার চা পানের ফলে মন চাঙা থাকে। শরীরও সতেজ হয় এবং কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

 

চা পানের ফলে মানুষের স্নায়ু যে শান্ত হয়, সেটি কয়েকটি গবেষণায়ও দেখা গেছে। অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ভেষজ চা পানকারীদের তুলনায় যারা নিয়মিত চা পান করেন, তাদের তুলনামূলক শান্ত প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে থাকে। আবার অন্য একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা প্রতিদিন কমপক্ষে তিন কাপ চা পান করেন, তাদের মধ্যে হাতাশার ঝুঁকি চা পান না করা ব্যক্তিদের তুলনায় ৩৭ শতাংশ কম থাকে।

 

রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি: চা পান যে শুধু মানসিক চাপ হ্রাস করে, বিষয়টি তা নয়। বিভিন্ন গবেষণায় রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতেও চা পানের উপকারিতার বিষয়টি উঠে এসেছে। ২০০৯ সালে এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিন কয়েক কাপ চা পানে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমে। উপকারিতা ঠিক কতটুকু তা সঠিকভাবে জানা না গেলেও পাঁচ থেকে ৪০ শতাংশের মধ্যে রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে ওই গবেষণায়। এছাড়া চায়ে থাকা অন্যান্য পুষ্টি উপাদান মানুষের বিপাকে সাহায্য করে। যা শরীরের ইনসুলিনকে কোনো ক্ষতি না করেই রক্তের গ্লুকোজকে দুর্দান্তভাবে সামলায়। আবার অন্য গবেষণায় দেখা গেছে, রং চা পানের পর শরীরের কোষ থেকে ১৫ গুণ বেশি ইনসুলিন নির্গত হয়। পর্যাপ্ত পরিমাণে ইনসুলিন নির্গত হলে নিয়ন্ত্রণে থাকে ডায়াবেটিস।

 

হৃৎপিণ্ড ভালো রাখতে: চা পানের অনেক উপকারিতার মধ্যে একটি হচ্ছে হৃৎপিণ্ড ভালো রাখে। নেদ্যারল্যান্ডের ১৩ বছর ধরে এক গবেষণায় বলা হয়েছে, চায়ের মধ্যে বিদ্যমান অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হৃৎপিণ্ডকে কিছুটা সুরক্ষা দিয়ে থাকে। প্রায় ৪০ হাজার মানুষকে নিয়ে গবেষণা করা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, চা বেশি পান কর মানুষের হৃদরোগের শঙ্কা এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত হ্রাস পায়। আর প্রতিদিন কয়েক কাপ করে চা পানে এই প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়া সম্ভব।

 

যুক্তরাজ্যে ২০২২ সালে পাঁচ লাখ চা পানকারীদের নিয়ে একটি গবেষণা করা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, অধিক চা পান করার সঙ্গে মৃত্যুঝুঁকি কমার সম্পর্ক রয়েছে। প্রতিদিন যারা দুই কাপ বা এরও বেশি চা পান করেন, তাদের চা না পান করা মানুষদের তুলনায় যেকোনো কারণে মৃত্যুঝুঁকি ৯ থেকে ১৩ শতাংশ পর্যন্ত কম থাকে। আবার চা পানের কারণে হৃদরোগ ও স্ট্রোক থেকে মৃত্যর ঝুঁকিও অনেক কমে যায়। তবে এ জন্য চায়ের তাপমাত্রা, দুধ বা চিনি যুক্ত করা বা ক্যাফেইন বিপাকের হারের মতো নানা অবস্থা নির্বিশেষে এমন ফলাফল পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে গবেষণায়।

 

ক্যানসার প্রতিরোধ: চা পানে ক্যানসার প্রতিরোধে উপকার পাওয়া যায়। বাংলাদেশ সরকারের কৃষি তথ্য সার্ভিসের চা নিয়ে প্রকাশ করা এক প্রবন্ধে বলা হয়েছে, চায়ে কিছুটা পুষ্টিগুণ থাকলেও পলিফেনলেস, ফ্ল্যাবোনয়েডস ও ক্যাটেচিন নামক উপাদান বিদ্যমান থাকায় ফ্রি রেডিক্যালস তৈরি হতে বাধা সৃষ্টি করে এবং কোষের ক্ষতি হওয়ায় ব্যাঘাত ঘটায়। এতে ক্যানসার প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে চা। এছাড়া চায়ে থাকা পলিফেনলসের পরিমাণ ২৫ শতাংশের অধিক থাকায় উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণেও সাহায্য করে।

 

চা পানের ক্ষতিকর দিক: যেকোনো কিছুই অতিরিক্ত ভালো নয়। একইভাবে চা-ও অতিরিক্ত পান করা উচিত নয়। পরিমাণের থেকে বেশি চা পানে নানা জটিলতার মুখেও পড়তে পারে শরীর। অতিরিক্ত চা পানের ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের কৃষি তথ্য সার্ভিসের প্রবন্ধে বলা হয়েছে, চায়ের ক্যাফেইন ঘুমের চক্রে প্রচণ্ড প্রভাব ফেলার সম্ভাবনা রাখে। অতিরিক্ত চা পানের কারণে ঘুমের ভারসাম্য নষ্ট হয়। চায়ে থাকা থিওফাইলিন নামক রাসায়নিক উপাদান শরীরের ডিহাইড্রেশনের কারণ হতে পারে। যা থেকে হজমে সমস্যা হয়ে থাকে। ফলে কোষ্ঠকাঠিন্যের মতো সমস্যা হয়।

 

অন্তঃসত্ত্বা নারীদের চা পান করা উচিত নয়। এতে থাকা ক্যাফেইন ভ্রুণের বিকাশে বাধা প্রদান করতে পারে। যা থেকে পরবর্তীতে গর্ভপাত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আবার অতিরিক্ত চা পান থেকে প্রোস্টেট ক্যানসারও হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।